০৯:৫১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রস সংগ্রহের মৌসুমে ব্যস্ত গাছিরা

শীত যত বাড়ছে খেজুরের রসের চাহিদাও তত বাড়ছে। ফেনীর গ্রামীণ জনপদের ঘরে ঘরে এই রস দিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের পিঠা ও পায়েস। তাই তীব্র শীত
উপেক্ষা করে খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য সময় পার করছেন ফেনীর গাছিরা। সুস্বাদু এই রস আগুনে জ্বাল দিয়ে বানানো হয় বিভিন্ন রকমের পাটালি ও লাল গুড়। ফলে কাজের চাপে দম নেয়ার সময় পান না তারা। খেজুর ও রস বিক্রি করেও আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন এখানকার গাছিরা। রস বিক্রিতে সময় পার করছেন স্থানীয় অনলাইন উদ্যোক্তারা। গাছিদের কাছ থেকে রস সংগ্রহ করে পৌঁছে দিচ্ছেন শহরের বিভিন্ন ফ্ল্যাট বাসায়। হেমন্তের শেষ থেকে বসন্তের শুরু পর্যন্ত পুরো মৌসুম গাছিরা কাজ করেন। মৌসুমের চার মাসে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা আয় হয় তাদের। বছরের অন্য মাসগুলোতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ও কাজীরহাট বাজারে দা-ছুরিতে শাণ দেওয়ার কাজ করেন অনেকে।

শরীরে প্যাঁচানো দড়ি। কোমরের পেছনে বাঁশের তৈরি ঝুড়ি। ভেতরে বাটালি, হাঁসুয়া ও কাস্তে। এসব নিয়েই তরতর করে খেজুরগাছ বেয়ে উঠেন গাছি নুর ইসলাম (৫০)। শীত এলেই ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার উত্তর চর সাহাভিকারী এলাকায় খেজুরগাছ প্রস্তুত করতে দেখা যায় নুর ইসলামকে। তিন দশক ধরে গাছ প্রস্তুত ও রস সংগ্রহের কাজ করছেন। শীত বাড়তে থাকায় গত তিন সপ্তাহ ধরে রস সংগ্রহের জন্য গাছির কাজ শুরু করেছেন। পুরো শীত মৌসুমে চলবে রস সংগ্রহ ও গাছ কাটার কাজ।

গাছিরা জানান, গাছিরা প্রতিদিন বিকেলে খেজুর গাছের সাদা অংশ পরিষ্কার করে ছোট-বড় কলসি (মাটির পাত্র) বেঁধে রাখে রসের জন্য। পরদিন সকালে রস সংগ্রহ করা হয়। শীত মৌসুমের শুরুতেই খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করা হয়। বছরের পাঁচ মাস রস সংগ্রহ করা যায়। এ রস থেকে বিভিন্ন রকমের পাটালি ও লাল গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা।

অনলাইন উদ্যেক্তা তাকিয়া ফুড প্রোডাক্টসের পরিচালক নজরুল ইসলাম সোহাগ জানান, শীতের পিঠা ও পায়েসের জন্য খেজুরের রস ও গুড়ের বাড়তি চাহিদা রয়েছে। তবে খেজুর গাছ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই একসময় হয়তো খেজুর রসের ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বেশি বেশি খেজুরগাছ রোপণ করা প্রয়োজন।

উপ-সহকারি কৃষি অফিসার আবদুল্যাহ আল মারুফ সবুজ বাংলাকে বলেন, শীত মৌসুমের শুরুতেই কৃষি বিভাগ গাছিদের রস সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন পরামার্শ দিয়ে যাচ্ছি। খেজুর গাছ ফসলের কোনো প্রকারের ক্ষতি করে না। এই গাছের জন্য বাড়তি কোনো খরচ করতে হয় না। যা সকলে এই গাছ যে কোথাও বাড়ির পাশে লাগাতে পারে।

গাছি নুর ইসলাম বলেন, ‘খেজুরগাছ থেকে পুরো দমে রস সংগ্রহ শুরু হলে কাজে একজন শ্রমিক নিই। দুজন মিলে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত গাছ কেটে হাঁড়ি ঝুলিয়ে দিই। সারা রাত রস পড়তে থাকে। ভোর থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত রসের হাঁড়ি নামাই। কিছু রস বিক্রি হয়। বাকি রস দিয়ে গুড় তৈরি করে বিক্রি করি।’

বাপ-দাদার হাত ধরেই এই গাছি পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন নুর ইসলাম ফেনীর উত্তর চর সাহাভিকারী এলাকার বিভিন্ন সড়ক ও বাড়ির আঙিনায় অন্তত শতাধিক খেজুরগাছ আছে। রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করতে গাছপ্রতি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা নেন তিনি। আবার নিজেও গ্রামে-গঞ্জের ৭০ থেকে ৮০টি খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন। সেই রস থেকে গুড় তৈরি করে বিক্রি করেন। আবার রসও বিক্রি হয়। প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত উপজেলার কাজীরহাট বাজার এলাকায় রস বিক্রি করেন নুর ইসলাম।

ফেনী সিভিল সার্জন ডাঃ শিহাব উদ্দিন সবুজ বাংলাকে বলেন, ঐতিহ্যের ধারক এই খেজুরের রসের মাধ্যমে সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়ছে নিপা ভাইরাস। তবে ৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফোটানো হলে নিপা ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে না। তাই নিপা ভাইরাস থেকে রক্ষায় খেজুর রস ফুটিয়ে খাওয়া উচিত।

জনপ্রিয় সংবাদ

রস সংগ্রহের মৌসুমে ব্যস্ত গাছিরা

আপডেট সময় : ০৫:১৪:৩৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৪

শীত যত বাড়ছে খেজুরের রসের চাহিদাও তত বাড়ছে। ফেনীর গ্রামীণ জনপদের ঘরে ঘরে এই রস দিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের পিঠা ও পায়েস। তাই তীব্র শীত
উপেক্ষা করে খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য সময় পার করছেন ফেনীর গাছিরা। সুস্বাদু এই রস আগুনে জ্বাল দিয়ে বানানো হয় বিভিন্ন রকমের পাটালি ও লাল গুড়। ফলে কাজের চাপে দম নেয়ার সময় পান না তারা। খেজুর ও রস বিক্রি করেও আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন এখানকার গাছিরা। রস বিক্রিতে সময় পার করছেন স্থানীয় অনলাইন উদ্যোক্তারা। গাছিদের কাছ থেকে রস সংগ্রহ করে পৌঁছে দিচ্ছেন শহরের বিভিন্ন ফ্ল্যাট বাসায়। হেমন্তের শেষ থেকে বসন্তের শুরু পর্যন্ত পুরো মৌসুম গাছিরা কাজ করেন। মৌসুমের চার মাসে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা আয় হয় তাদের। বছরের অন্য মাসগুলোতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ও কাজীরহাট বাজারে দা-ছুরিতে শাণ দেওয়ার কাজ করেন অনেকে।

শরীরে প্যাঁচানো দড়ি। কোমরের পেছনে বাঁশের তৈরি ঝুড়ি। ভেতরে বাটালি, হাঁসুয়া ও কাস্তে। এসব নিয়েই তরতর করে খেজুরগাছ বেয়ে উঠেন গাছি নুর ইসলাম (৫০)। শীত এলেই ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার উত্তর চর সাহাভিকারী এলাকায় খেজুরগাছ প্রস্তুত করতে দেখা যায় নুর ইসলামকে। তিন দশক ধরে গাছ প্রস্তুত ও রস সংগ্রহের কাজ করছেন। শীত বাড়তে থাকায় গত তিন সপ্তাহ ধরে রস সংগ্রহের জন্য গাছির কাজ শুরু করেছেন। পুরো শীত মৌসুমে চলবে রস সংগ্রহ ও গাছ কাটার কাজ।

গাছিরা জানান, গাছিরা প্রতিদিন বিকেলে খেজুর গাছের সাদা অংশ পরিষ্কার করে ছোট-বড় কলসি (মাটির পাত্র) বেঁধে রাখে রসের জন্য। পরদিন সকালে রস সংগ্রহ করা হয়। শীত মৌসুমের শুরুতেই খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করা হয়। বছরের পাঁচ মাস রস সংগ্রহ করা যায়। এ রস থেকে বিভিন্ন রকমের পাটালি ও লাল গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা।

অনলাইন উদ্যেক্তা তাকিয়া ফুড প্রোডাক্টসের পরিচালক নজরুল ইসলাম সোহাগ জানান, শীতের পিঠা ও পায়েসের জন্য খেজুরের রস ও গুড়ের বাড়তি চাহিদা রয়েছে। তবে খেজুর গাছ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই একসময় হয়তো খেজুর রসের ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বেশি বেশি খেজুরগাছ রোপণ করা প্রয়োজন।

উপ-সহকারি কৃষি অফিসার আবদুল্যাহ আল মারুফ সবুজ বাংলাকে বলেন, শীত মৌসুমের শুরুতেই কৃষি বিভাগ গাছিদের রস সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন পরামার্শ দিয়ে যাচ্ছি। খেজুর গাছ ফসলের কোনো প্রকারের ক্ষতি করে না। এই গাছের জন্য বাড়তি কোনো খরচ করতে হয় না। যা সকলে এই গাছ যে কোথাও বাড়ির পাশে লাগাতে পারে।

গাছি নুর ইসলাম বলেন, ‘খেজুরগাছ থেকে পুরো দমে রস সংগ্রহ শুরু হলে কাজে একজন শ্রমিক নিই। দুজন মিলে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত গাছ কেটে হাঁড়ি ঝুলিয়ে দিই। সারা রাত রস পড়তে থাকে। ভোর থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত রসের হাঁড়ি নামাই। কিছু রস বিক্রি হয়। বাকি রস দিয়ে গুড় তৈরি করে বিক্রি করি।’

বাপ-দাদার হাত ধরেই এই গাছি পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন নুর ইসলাম ফেনীর উত্তর চর সাহাভিকারী এলাকার বিভিন্ন সড়ক ও বাড়ির আঙিনায় অন্তত শতাধিক খেজুরগাছ আছে। রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করতে গাছপ্রতি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা নেন তিনি। আবার নিজেও গ্রামে-গঞ্জের ৭০ থেকে ৮০টি খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন। সেই রস থেকে গুড় তৈরি করে বিক্রি করেন। আবার রসও বিক্রি হয়। প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত উপজেলার কাজীরহাট বাজার এলাকায় রস বিক্রি করেন নুর ইসলাম।

ফেনী সিভিল সার্জন ডাঃ শিহাব উদ্দিন সবুজ বাংলাকে বলেন, ঐতিহ্যের ধারক এই খেজুরের রসের মাধ্যমে সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়ছে নিপা ভাইরাস। তবে ৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফোটানো হলে নিপা ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে না। তাই নিপা ভাইরাস থেকে রক্ষায় খেজুর রস ফুটিয়ে খাওয়া উচিত।