🔰 আর্থিক ও মানসিক বিড়ম্বনায় লেখকরা
🔰 বিনোদনের নতুন মাধ্যম আসায় কমছে পাঠকের সংখ্যা
🔰 মানসম্মত লেখক ধরে আনতে পারছেন না প্রকাশক
🔰 লেখক তৈরিতে প্রকাশের পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব আছে
আপনি কী করেন? আমি একজন লেখক? এর পাশাপাশি আপনি আর কী করেন? লেখক নিরুত্তর। পেশায় তরুণ লেখক কিন্তু এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হননি এমনটি খুঁজে পাওয়া ভার। বাংলাদেশে লেখালেখিকে পেশা হিসেবে কেউ বেছে নিতে চাইলে তাকে সীমাহীন অর্থকষ্ট এবং মানসিক বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অন্যদিকে, প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে যারা যুক্ত তারাও মনে করেন এই অঙ্গনটি এখনও দেশে পেশা হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। এর কারণ হিসেবে তারা রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অদক্ষতা দায়ী বলে মনে করেন।
তারা মনে করেন, প্রকাশনা শিল্প না তৈরি হওয়ার পেছনে, নতুন পাঠক তৈরি করতে না পারার পেছনে প্রকাশক ও লেখক উভয়ই দায়ী। প্রকাশক সেই মানের লেখক ধরে আনতে পারছে না, আর সেই মানের লেখক তৈরি হচ্ছে না বলে ক্রমাগতভাবে মানহীন বই তৈরি হচ্ছে যা পাঠক নিতে চায় না।
বরেণ্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, বই কিনে কেউ কখনও দেউলিয়া হয় না। কিন্তু দিন দিন বাংলাদেশে লেখকের সংখ্যা বাড়লেও পাঠকের সংখ্যা কমছে বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। গত ২০২৩ সালের অমর একুশে বইমেলায় ৪৭ কোটি টাকার বই কিনেছেন ক্রেতারা, আগের বছর এই অঙ্ক ছিল ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অন্যদিকে, বর্তমানে ঢাকায় চলমান বাণিজ্য মেলায় গত শুক্রবার ২৬ জানুয়ারি একদিনেই শুধু প্রবেশ টিকিট বিক্রি হয়েছে ২৬ লক্ষ টাকার। কেন বাংলাদেশে লেখালেখা পেশা হিসেবে দাঁড়াতে পারছে না এ প্রসঙ্গে লেখক ও সাংবাদিক এস এম আবুল হোসেন বলেন, আমাদের দেশে লেখা বোঝার মতো পাঠকের সংখ্যা কম। দিন দিন পাঠকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে ৫০-৮০’র দশকে যে শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল, এইট-নাইন-টেনে ঐ বয়সে শিক্ষার্থীরা যে ধরনের লেখা পড়ে বড় হয়েছে বা যাদের লেখা পড়ে বড় হয়েছে সেই মানের লেখক এখন আর বাংলাদেশে নেই। সেই মানের লেখক না থাকার কারণে পাঠক তৈরিতে একটা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া পাঠককে আকৃষ্ট করার মতো তেমন লেখা আসছে না। একটা সময় পর্যন্ত হুমায়ন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ এদের কিছু উচ্চমার্গীয় লেখা আছে আর কিছু লেখা আছে সহজ সরলভাবে লেখা। পাঠকের মধ্যে দুইটা শ্রেণি আছে যারা হুমায়ুন আজাদ বা সৈয়দ শামসুল হকদের মতো লেখার ভক্ত আবার কেউ কেউ হুমায়ন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন এই জাতীয় লেখকের লেখার ভক্ত। এই দুই জাতীয় লেখার মানই কমে গেছে। এখন এত মাত্রায় লেখক তৈরি হয়েছে যে, তাদের লেখার মান এত নিম্ন, গ্রাফটা এত নিম্নে চলে এসেছে পাঠক লেখাতে এখন আর কোনো মজা পায় না। আর লেখার মধ্যে নতুনত্ব নাই। গতানুগতিক লেখা আর শব্দচয়নও হয় না। খুবই সাদামাটা যেকেউ একটা লিখেই ছেড়ে দেয়। যে কারণে পাঠক অনেক সময় একটা বই হাতে নিয়ে ২, ৩, ৪ পাতা পড়ার পরে পরের পাতা উল্টানোর মতো ধৈর্য না থাকে তখন করে কি, পাঠক বই পড়াটা ছেড়ে দেয়। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করার কারণে সবাই ফেসবুক, ইউটিউব এগুলো নিয়ে অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকার কারণে বই বা পাঠের উপরে তাদের সেই মোহটা নাই। একটা সময় পাঠক অপেক্ষা করত কখন একটা প্রিয় লেখকের বই বাজারে আসবে। এরজন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করত। কখনও কখনও লেখককে জিজ্ঞেস করত আপনার নতুন বই কবে আসছে? এটার কারণ হচ্ছে তখন বিকল্প বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এখন বিকল্প বিনোদনের ব্যবস্থা হয়ে যাবার কারণে পাঠকের সংখ্যা কমে আসছে। আর এজন্য দায়ী লেখকরাও। পাঠক ধরে রাখতে পারছে না। সেই মানের লেখক বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে না। যারা তৈরি হচ্ছে তাদের বই কিন্তু ঠিকই কিনছে পাবলিক। এ ক্ষেত্রে প্রকাশকরা তেমনভাবে ভূমিকা রাখতে পারছে না উল্লেখ করে আবিষ্কার প্রকাশনীর প্রকাশক দেলোয়ার হাসান বলেন, বাংলাদেশে লেখালেখি পেশা হিসেবে দাঁড়াচ্ছে না বা প্রকাশনা শিল্প হিসেবে দাঁড়াচ্ছে না এটা রাজনীতি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অদক্ষতার জন্য হচ্ছে। যেখানে কথা বলার সুযোগ নেই, যেখানে রাজনীতি করার সুযোগ নেই, মত প্রকাশের সুযোগ নেই, সেখানে লেখকরা লিখতে পারে না। প্রকাশনা শিল্পেও এখন পর্যন্ত দক্ষ লোকের অভাব। এখানে প্রকাশকরা এটাকে ব্যবসা হিসেবে দেখে। কিন্তু শিল্প হিসেবে তারা চিন্তা করতে পারে না। সাহিত্য যে সমাজের দর্পণ এটা প্রকাশকদের বড় অংশ বোঝে না। অধিকাংশ প্রকাশকই টাকার বিনিময়ে বই বের করে। আর টাকার বিনিময়ে বই করলে এর মান কি হবে বোঝা যায় না। যেখানে এক শ্রেণির লেখক বই করার জন্য টাকা দিচ্ছে সে ক্ষেত্রে যারা সত্যিকারের লেখক তারা লেখার জন্য টাকা পাচ্ছে না। তারা মনে করছে উল্টো টাকা দেব কেন?
এ প্রসঙ্গে এস এম আবুল হোসেন বলেন, এখন প্রকাশনার সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে। অতিমাত্রায় প্রকাশনা বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রকাশনার মান কমে গেছে। কারণ এখন যে কেউ বই বের করতে পারে। আগে প্রকাশক নিজ উদ্যোগে বই বের করত। আর এখন লেখক প্রকাশকের কাছে টাকা দিয়ে বই বের করে। তখন প্রকাশক আর বইয়ের মান চিন্তা করে না। প্রকাশক তখন চিন্তা করে তার প্রকাশনার তালিকায় একটা বই যুক্ত হলো। তাছাড়া এখন সরকারিভাবে প্রচুর পরিমাণে বই কেনা হয়। কিছু অসাধু প্রকাশক এই অখাদ্য বইগুলোকে সরকারি লাইব্রেরিগুলোতে অনায়াসে দিয়ে দিতে পারছে। লাইব্রেরিগুলোতে এখন সেই পরিমাণ পাঠক আর হয় না। আগে পাড়া মহল্লায় প্রচুর পরিমাণ পাঠক উপস্থিত থাকত। এখন সেটা নাই। এই পাঠক না থাকার কারণে, যত্রতত্র প্রকাশনা সংস্থা হয়ে যাওয়ার কারণে যে কেউ বই বের করতে পারে। এসব কারণে এখন বইমেলায় বই কেনার চেয়ে আড্ডা দেওয়ার লোক বেশি হয়, বইমেলায় বই কেনার চেয়ে ফুচকা খাওয়ার লোক বেশি হয়। এর কারণ হিসেবে প্রকাশক ও লেখক উভয়ই দায়ী। প্রকাশক সেই মানের লেখক ধরে আনতে পারছে না, আর সেই মানের লেখক তৈরি হচ্ছে না বলে ক্রমাগতভাবে মানহীন বই তৈরি হচ্ছে যা পাঠক নিতে চায় না। কিন্তু অনুবাদ বই অনেক চলে। অনেকেই অনুবাদ বই কেনে। কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, বাংলাদেশে লেখালেখি পেশা না হওয়ার প্রধান কারণ নিরাপত্তাহীনতা।
প্রকাশকরা লেখককে টাকা দেয় না। বিক্রেতা প্রকাশককে টাকা দেয় না। তবে, বিক্রেতা, প্রকাশক ও পাঠক বেড়েছে। ধীরে ধীরে লেখকও বাড়বে। তারা মূল্য পাবে। প্রকাশক দেলোয়ার হাসান বলেন, বাংলাভাষাকে স্টাবলিশড করার জন্য জোরদার কোনো চেষ্টা চলছে না। বরঞ্চ আরবি ভাষা শিক্ষার কোটি কোটি টাকার বই বিক্রি হচ্ছে। ইংরেজি শিক্ষার জন্য মানুষ কোটি কোটি টাকার বই কিনছে। সে তুলনায় বাংলা ভাষা শিক্ষার জন্য কতটুকু বই বিক্রি হচ্ছে? এমনকি সমাজের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য যে বই কেনা দরকার সেটাও কেনা হচ্ছে না। বই কেনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও মনগড়া ইতিহাসের বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। প্রকাশনা শিল্পের ঘাটতির দিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের পুরো একটি সেটাপ প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত। এডিটিং প্যানেল, প্রুফ দেখা, ছাপা, বাঁধাই, কাটিং, এই পুরো সেটাপ একটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বহন করার ক্ষমতা খুব কম। অন্যদিকে দিন দিন আমাদের পাঠক সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যেহেতু মানুষকে সৎ হওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছেনা, অসৎরা ভাল জীবনযাপন করছে। বই পড়লে সৎ হতে হবে। সৎ হলে ভাল জীবনযাপন করতে পারবেনা। বই পড়লে নদী ভরাট করতে, গাছ কাটতে, পরিবেশ দূষণ করতে পারবেনা। তাই যারা এসব করে তারা বই পড়ছে না। সমস্ত জাতিকে এখন এটা অন্ধকারে টেনে নেয়া হচ্ছে। বই পড়ার যে অভ্যাস সেটা দিন দিন মানুষের মধ্যে কমে যাচ্ছে। প্রকাশক দেলোয়ার হাসান বলেন, সমাজে যদি মত প্রকাশের স্বাধীনতা আসে, যদি সত্য বলার জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়, মিথ্যা সাহিত্যের মনগড়া পুরস্কার বন্ধ করা হয়, যদি পাঠক তৈরি করা হয়, তাহলে বড়মাপের লেখক তৈরি হবে। এই কাজটা একা প্রকাশকের কাজ না। এটা রাষ্ট্রের যারা ক্ষমতা পরিচালনায় আছে তাদেরও দায়িত্ব। বড় মাপের লেখক তৈরি করতে চাইলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে নকল করার প্রবণতা থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে।























