সন্তানদের শিক্ষা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা
🎁 বছরের শুরুতেই শিক্ষা সামগ্রীসহ লাগছে জামা-জুতা
🎁 থেমে নেই প্রাইভেট-কোচিং খরচও
🎁 পুনঃভর্তির নামে টাকা আদায় বন্ধ ও শিক্ষাসামগ্রী সরবরাহের দাবি
সন্তানের ভালো লেখাপড়ার আশায় রাজধানীর নামি একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন বেসরকারি একজন কর্মজীবী একরাম। লটারির মাধ্যমে ভর্তির সুযোগও পান তিনি। কিন্তু হঠাৎ চাকরিতে সমস্যা হওয়ায় নির্ধারিত ৮ হাজার টাকা ফি যোগাড়ে ব্যর্থ হয়ে সেই সুযোগ হাতছাড়া করেন তিনি। বাধ্য হয়েই বাসার কাছে কম খরচের একটি স্কুলেই ভর্তি করান সন্তানকে।
একই সমস্যার মুখোমুখি হন সাতক্ষীরার বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে স্বল্প বেতনের চাকরিজীবী আব্দুল্লাহ। তার তিন সন্তান পড়েন জেলাটির একটি বেসরকারি স্কুলে। ভালো লেখাপড়ার আশায় সরকারি স্কুল ছেড়ে ওই স্কুলে ভর্তি করালেও তার ব্যয় নিয়ে এখন দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি। কারণ নিয়মানুযায়ী বার্ষিক পরীক্ষার নতুন শ্রেণিতে উত্তীর্ণের সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে নির্ধারিত ফি দিয়ে ভর্তি করতে হবে সন্তানদের। বছরজুড়ে নানা খরচ মিটিয়ে এখন একসঙ্গে তিন সন্তানের ভর্তি খরচ যোগাড়ে হিমশিম অবস্থা তার। যে কারণে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার আশায় নতুন শিক্ষাবর্ষের এক মাস শেষ হলেও তাদের ভর্তি সম্পন্ন হয়নি। আর শিক্ষকদের কটু কথার ভয়ে এতদিন ক্লাসেই উপস্থিত হয়নি তারা।
শুধু একরাম বা আব্দুল্লাই নয়, একইভাবে সন্তানদের শিক্ষা ব্যয় মেটাতে চরম হিমশিম খাচ্ছেন মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের অধিকাংশ অভিভাবক। বছরজুড়ে টিউশন ফি, কোচিং-প্রাইভেট, খাতা-কলম-ব্যাগসহ নানা খরচ সামলিয়ে লেখাপড়া চালানো নিয়ে বেশ দুঃশ্চিন্তায় পড়ছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে বছরের শুরুতেই বড় ধাক্কায় পড়তে হয় অভিভাবকদের। কারণ বেসরকারি স্কুলগুলোতে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত নতুন ভর্তির ন্যায় এক শ্রেণি থেকে আরেক শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রেও সমান টাকা আদায় করা হয়। একইস্কুলে প্রতি বছর ভর্তিতে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের এই নিয়মে চরম ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা। তবে এ বিষয়ে সরকারি মহল থেকে তেমন কোনো তদারকি নেই বলে জানা গেছে।
এদিকে স্কুল পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যের পাঠ্যবই সরবরাহ করা হলেও নতুন ভর্তির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের নতুন খাতা-কলম, ব্যাগ আর জামা-জুতারও চাহিদা দেখা দেয়। সন্তানদের এসব চাহিদা মেটাতে বেশ অর্থকষ্টের মধ্যে পড়ছেন অভিভাবকরা। পাশাপাশি নতুন করে কোচিং বা প্রাইভেটে ভর্তির খরচও এখন অনেকটা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। গত বছর থেকে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমে ব্যবহারিক সামগ্রী প্রয়োজন পড়ে বেশি। এজন্য গত বছর নানা রঙের কাগজ, কলম, আঠাসহ নানা সামগ্রী কিনতে বাড়তি খরচের পাশাপাশি চরম হয়রানির মধ্যে পড়েন সংশ্লিষ্ট অভিভাবকরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পরবর্তী ক্লাসে ভর্তির নামে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় বন্ধ এবং সরকারিভাবে শিক্ষাসামগ্রী সরবরাহের জন্য দাবি জানিয়েছেন অভিভাবক নেতারা। একই সঙ্গে সরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষার মান বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ারও আহ্বান জানান তারা।
এ বিষয়ে ঢাকার অভিভাবকদের সংগঠন-অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল হক দুলু সবুজ বাংলাকে বলেন-একই স্কুলে উত্তীর্ণ হওয়ার পর নতুন শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে শুধু নিয়মিত মাসিক টিউশন ফি নেয়া যেতে পারে। কিন্তু স্কুলগুলো কৌশলে পুরো ভর্তির টাকা আদায় করে থাকে। এটা সরকারিভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করে বন্ধ হওয়া দরকার। কারণ নতুন কারিকুলামে শিক্ষাব্যয় মিটিয়ে সন্তানদের পড়ালেখা চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই সরকারিভাবে শিক্ষাসামগ্রী সরবরাহেরও দাবি জানান তিনি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জারি করা বেসরকারি স্কুলের ভর্তি নীতিমালায় বলা হয়েছে, নতুন শিক্ষার্থী ভর্তিতে সেশন চার্জসহ ভর্তি ফি সর্বসাকুল্যে মফস্বল এলাকায় ৫০০ টাকা, পৌর (উপজেলা) এলাকায় ১ হাজার টাকা, জেলা সদর এলাকায় ২ হাজার এবং ঢাকা ছাড়া অন্যান্য মেট্রোপলিটন এলাকায় ৩ হাজার টাকার বেশি হবে না। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় অবস্থিত এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে ৫ হাজার টাকার অতিরিক্ত আদায় করতে পারবে না। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় অবস্থিত আংশিক এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন এবং এমপিও বহির্ভূত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেয়ার জন্য শিক্ষার্থী ভর্তির সময় মাসিক বেতন, সেশন চার্জ ও উন্নয়ন ফিসহ বাংলা মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা এবং ইংরেজি ভার্সনে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা নিতে পারবে। উন্নয়ন খাতে কোনো প্রতিষ্ঠান ৩ হাজার টাকার বেশি আদায় করতে পারবে না। একই প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক ক্লাস থেকে পরবর্তী ক্লাসে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতি বছর সেশন চার্জ নেয়া যাবে। তবে পুনঃভর্তির ফি নেওয়া যাবে না। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্ট তহবিলের জন্য ভর্তির সময় শিক্ষার্থী প্রতি ১০০ টাকা গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট হিসাব খাতে জমা দিতে হবে। ৭০ টাকা অবসর এবং ৩০ টাকা কল্যাণ তহবিলের সংশ্লিষ্ট হিসাব খাতে জমা দিতে হবে। নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, দরিদ্র, মেধাবী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী ভর্তিতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উল্লিখিত ফি মওকুফের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ভর্তির ফি বাবদ সরকার নির্ধারিত ফিয়ের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা যাবে না, নিলে সরকার প্রতিষ্ঠানে এমপিও বাতিলসহ আইননানুগ ব্যবস্থা নেবে বলেও বিভিন্ন সময় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়। তবে বাস্তবে নানা ফাঁক ফোকরে বেসরকারি স্কুলগুলো পুনঃভর্তির নামে বাড়তি টাকা আদায় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া ইংরেজি মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি টিউশন ফি ও পুনঃভর্তির ফি আদায় করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে কয়েক মাস আগে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়-ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো দিন দিন টিউশন ফি বাড়িয়েই চলেছে। এছাড়া আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে বছর বছর স্কুলগুলো রি-এডমিশন ফি নিচ্ছে। কিছু কিছু বড় স্কুল আবার রি-এডমিশন ফি-কে ১২ মাসের মধ্যে ভাগ করে টিউশন ফি অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিয়েছে। বেশিরভাগ স্কুল রি-এডমিশন ফি ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আবার কিছু কিছু স্কুলে মাসিক টিউশন ফি ৮০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর ভর্তি ফি ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত। কোনো কোনো স্কুলে ভর্তি ফি ২ লাখ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত।
এছাড়া কিছু কিছু স্কুল ডেভেলপমেন্ট ফি, ইউটিলিটি ফি, বিবিধ ফি সহ বিভিন্ন নামে ফি আদায় করছে।এ অবস্থায় অভিভাবকদের পক্ষে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর রি-এডমিশন ফি নেওয়া অবিলম্বে বন্ধ করা এবং মাসিক টিউশন ফি যৌক্তিকীকরণসহ বেশ কিছু দাবি জানানো হয়। গত বছরের শুরুতে প্রকাশিত ইউনেস্কো গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যয়ের ৭১ শতাংশই বহন করে শিক্ষার্থীদের পরিবার। যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ পাকিস্তানেও এ হার কম; প্রায় ৫৭ শতাংশ। এই ৭১ শতাংশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় আবার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারির তুলনায় তিনগুণ শিক্ষা ব্যয় বহন করতে হয় অভিভাবকদের। যা বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের ক্ষেত্রে এ ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় নয়গুণ।
স/ম






















