বিশ^জুড়ে বাড়ছে ক্যানসার। এটি প্রতিরোধে সচেতন হওয়ার প্রতি জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিবছর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ১০ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। এটা এইচআইভি এইডস, ম্যালেরিয়া বা যক্ষ্মার চেয়ে অনেক বেশি। যদি আমরা এখনই ক্যানসার প্রতিরোধে সচেতন না হই ২০৩০ সালে ক্যানসারে মৃত্যু ১৩ মিলিয়নে দাঁড়াবে। আবার বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) বলছে, ২০৫০ সালে এই সংখ্যা ৭৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
ক্যানসারের এই বাস্তবতার মধ্যেই আজ পালিত হবে বিশ^ ক্যানসার দিবস। সারা বিশে^র ন্যায় বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে কর্মসূচিটি পালন করা হবে। এ উপলক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে র্যালি-আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ক্লোজ দি কেয়ার গ্যাপ : এভরিওয়ান ডিজার্ভস একসেস দি ক্যানসার কেয়ার যার বাংলা মর্মার্থ করা হয়েছে আসুন ক্যানসার সেবায় বৈষম্য দূর করি।
দ্য ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার (আইএআরসি) এর হিসেব অনুযায়ী, কেবল ২০২২ সালেই বিশ্বে ২ কোটি নতুন ক্যানসার রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং ৯৭ লক্ষ মানুষ মারা গেছে, যার মধ্যে ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ধূমপানকে ফুসফুস ক্যানসারের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সংস্থাটির মতে, তামাক ব্যবহার পরিহারসহ অন্যান্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ক্যানসারে মৃত্যু ঝুঁকি ৩০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আইএআরসি এর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২২ সালে ক্যানসারে মৃত্যু সংখ্যা ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৯৮ জন। তামাক ব্যবহারের উচ্চপ্রবণতা এ মৃত্যু পরিস্থিতিকে আরো উদ্বেগজনক করে তুলছে। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে, ২০১৭ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ (৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। কর্মক্ষেত্রে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় ৮১ লক্ষ মানুষ। গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় আড়াই কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। তামাক ব্যবহারজনিত অসুখে দেশে বছরে ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ মারা যায়। ৬৫ শতাংশ ক্যানসার মৃত্যু হচ্ছে স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে। এমনকি উন্নত দেশগুলোতে বসবাসকারী স্বল্প আয়ের মানুষ, আদিবাসী, অভিবাসী শরণার্থী এবং
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্যানসার আক্রান্তের হার অনেক বেশি। যারা বেঁচে ছিল তাদের মধ্যে পরবর্তী পাঁচ বছরে ৫৩ দশমিক ৫ মিলিয়নের ক্যানসার শনাক্ত হয়েছে। এ তথ্য প্রমাণ করে প্রতি পাঁচ জনে জীবিত অবস্থায় ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে। এতে প্রতি নয় জনে একজন পুরুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং প্রতি ১২ জনে একজন নারী ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আইএআরসির তথ্যানুযায়ী ১৮৫টি দেশের ৩৬টি ক্যানসার নিয়ে তথ্যানুসন্ধান করে ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি যে ক্যানসারগুলোতে মৃত্যু হয়েছে এর মধ্যে আছে ফুসফুস ক্যানসার, স্তন ক্যানসার এবং কোলন ক্যানসার। ফুসফুস ক্যানসারে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন রোগী আক্রান্ত হয়েছে। নারীদের স্তন ক্যানসারে দুই দশমিক তিন মিলিয়ন নারী আক্রান্ত হয়েছে এবং কোলন ক্যানসারে এক দশমিক নয় মিলিয়ন আক্রান্ত হয়েছে।
হুর তথ্যমতে, মাত্র ১১৫টি দেশ তাদের ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসার জন্য ৩৯ শতাংশ বেসিক ক্যানসার ম্যানেজমেন্ট চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ফুসফুস ক্যানসারের ক্ষেত্রে তামাক ক্যানসার সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ। তামাকের ধোঁয়ায় প্রায় ৭ হাজারটি রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, যার মধ্যে ৭০টি ক্যানসার সৃষ্টিকারী এবং এগুলো ফুসফুস, শ্বাসতন্ত্র এবং মুখের ক্যানসারসহ অন্তত ১২ ধরনের ক্যানসার সৃষ্টি করে থাকে। পরোক্ষ ধূমপানেও ক্যানসার হতে পারে। হু’র নন কমিউনিকেবল ডিজিজ বিভাগের মহাপরিচালক বেনতে মিকেলসেন বলেন, বিশজুড়েই ক্যানসার রোগীর চিকিৎসা ব্যয়ে স্বল্পতা রয়েছে বিশেষ করে স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে এই মাত্রা অনেক বেশি। ডাকসুর সাবেক ভিপি অধ্যাপক মাহফুজা খানম বলেন, ক্যান্সার আক্রান্ত হলে মানুষ অর্ধেক মৃত হয়ে যান। কিন্তু থেমে গেলে চলবে না। এ সময় মানসিক এবং আর্থিকভাবে তাদের পাশে দাঁড়ানো খুবই জরুরি। চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. শুভাগত চৌধুরী সমাজের সবাইকে ক্যান্সার প্রতিরোধে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, কিশোরীদের এইচপিভি ভ্যাকসিন দিলে সারাজীবনে ক্যান্সার হবে না। কিন্তু এ দেশের তরুণদের মধ্যে স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা কম। শিশুদের টেলিভিশনের সামনে বসিয়ে রাখা হচ্ছে। হাতে স্মার্টফোন তুলে দেওয়া হচ্ছে। তাদের খেলাধুলা, ব্যায়াম করা দরকার। অসতর্কতা, অস্বাস্থ্যকর খাবার, মাদকাসক্তি, অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের কারণে ক্যান্সার ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ছে। আলোচনায় রোকেয়া পদকজয়ী জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হালিদা হানুম বলেন, নারীদের ক্যান্সার প্রতিরোধে পরিবারের পুরুষ সদস্যদেরও ভূমিকা রয়েছে। নারী অঙ্গের ক্যান্সার নিয়ে কেবল নারীদেরই নয়, পুরুষদেরও ধারণা থাকা ও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা’র (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, খসড়া তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন দ্রুত চূড়ান্ত করতে হবে। এটি যত বিলম্বিত হবে ক্যানসারসহ তামাক ব্যবহারজনিত বিভিন্ন রোগে মৃত্যু ততই বাড়তে থাকবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, বিশ্ব ক্যান্সার দিবস উপলক্ষে ৪২ জন ক্যান্সার লড়াকুর অভিজ্ঞতা নিয়ে সংকলিত ‘এখানে থেমো না : ক্যান্সার লড়াকুদের বয়ান’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লেকচার থিয়েটার ভবনের সিরাজুল ইসলাম লেকচার হলে সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এ বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। বইটির লেখক অধ্যাপক ডা. এসএম শহিদুল্লাহ বলেন, আমার পরিবারে আমরা আট জন ক্যান্সার আক্রান্ত। এর মধ্যে ৫জন মারা গেছেন বাকি ৩ জন সুস্থ আছি। বর্তমানে আমি ৮ ঘণ্টা অফিস করি। ক্যান্সার যোদ্ধা সিফাত আরেফিন প্রতীক বলেন, ক্যান্সার আক্রান্তদের কাউন্সেলিং, ক্যান্সার সার্ভাইভার কাউন্সেলিং এবং আক্রান্তদের স্বজনদের কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে আমরা সাহস যুগিয়ে যাচ্ছি। বিশ্লেষক মহল বলছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং ব্যক্তিসচেতনতা বৃদ্ধি করে ক্যানসার থেকে ভয় মুক্ত হয়ে এটিকে বোঝা এবং এ সম্পর্কে যত ভুল ধারণা দূর করে এবং নিজেদের আচরণের পরিবর্তন করে ক্যানসার থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
শিরোনাম
বিশ্ব ক্যানসার দিবস আজ
বছরে ১০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়
-
তাসকিনা ইয়াসমিন - আপডেট সময় : ১১:৪৬:৫৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
- ।
- 62
জনপ্রিয় সংবাদ























