উত্তপ্ত মিয়ানমার পরিস্থিতি
মিয়ানমারের বহু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আমাদের দেশে ঢুকছে। সাময়িক আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে এখনও তাদের দেশে ফেরত পাঠানো যায়নি। যেভাবেই হোক, তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে হবে। এখানে তাদের অবস্থান দীর্ঘায়িত হলে দেশের জন্য বিষফোঁড়া হতে পারে
অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষক, ঢাবি
মিয়ানমারে গোলাগুলি চলছেই। ওপারের আর্টিলারি ও মর্টার শেল গত দেড় বছরে বহুবার পড়েছে বাংলাদেশে। ধারাবাহিক কূটনৈতিক নীতি ভঙ্গের কারণে অনিরাপদ সীমান্ত থেকে এ দেশের বহু মানুষ বাড়িঘর ছেড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে আবারও উত্তেজনা বেড়েছে। মিয়ানমারের যুদ্ধের হাওয়া ঢুকেছে বাংলাদেশে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গুলিবর্ষণ, মর্টার শেল নিক্ষেপসহ প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা বারবার কেঁপে উঠছে। দেশটি থেকে ছোড়া গুলি, মর্টার শেল এপারে এসে পড়ছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি (সোমবার) মিয়ানমারের মর্টার শেলের আঘাতে বাংলাদেশে দুজন নিহত হয়েছেন। গত সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত সীমান্তের দুটি বসতঘরে মর্টার শেল এবং আরো পাঁচটি ঘরে গুলি লাগে। মঙ্গলবার মিয়ানমার থেকে আসা গুলিতে বাংলাদেশের এক নাগরিক আহত হয়েছেন। সীমান্তের আতঙ্কিত বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন। এর মধ্যে আরাকান আর্মির হামলা থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গাদের মতো দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) এ দেশে স্রোতের মতো প্রবেশ করছে।
দেশটির এ পরিস্থিতি নতুন করে চিন্তায় ফেলেছে বাংলাদেশকে। আগে থেকে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা এরই মধ্যে কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। আবারও যদি রোহিঙ্গাদের ঢল নামে কিংবা সেখানকার অন্য কোনো জনগোষ্ঠী সীমান্ত অতিক্রম করে, তাহলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠবে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের মর্টার শেলে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে দুজনের মৃত্যুর ঘটনায় দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা।
এদিকে মিয়ানমার যুদ্ধ ইস্যুতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক দুর্বলতাকে কেউ কেউ দায়ী করছেন। মিয়ানমার সীমান্ত সংঘাত বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিতে ফেলতে পারে বলেও মনে করছেন দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এ যুদ্ধের ওপর মিয়ানমার জান্তা সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। রোহিঙ্গাদের মতো মিয়ানমার বাহিনী বিজিপির প্রবেশকে বাংলাদেশের জন্য নতুন বিষফোঁড়া হিসেবে দেখছেন তারা। তাই শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সব সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করে দেশটির ওপর চাপ তৈরি করা উচিত বলে তারা মনে করছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমান্তে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড থাকা অবস্থায় অতীতেও ১৬ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা দেশে ঢুকেছে। বাংলাদেশে এখনো এসব রোহিঙ্গা আশ্রিত। তাদের একজনকেও স্বদেশে পাঠানো যায়নি। এখন সেই
দেশের বিশেষ বাহিনী অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করছে, সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও আসছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার নীরব। যদি সীমান্তে ধারাবাহিক উত্তেজনা চলতে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের নাগরিকদের জানমালের আরো ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা দেখছেন বিশ্লেষকরা। কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সীমান্তজুড়ে এক লাখের বেশি মানুষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। হতাহতের ঘটনা, আতঙ্ক ও নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে সীমান্তবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা প্রশাসন। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহিন ইমরান ও বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন বলেছেন, এরই মধ্যে বান্দরবানের নাইক্ষংছড়ি সীমান্তের অতিঝুঁকিপূর্ণ ২৪০টি পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তারা। গতকাল বুধবার পর্যন্ত বিজিবি সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজারের কাছে টেকনাফের হায়কং সীমান্ত দিয়ে আরও ৬৪ সৈন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, যার ফলে বাংলাদেশে মোট সৈন্য, সীমান্তরক্ষী, পুলিশ ও অভিবাসন কর্মকর্তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২৮-এ। এদিকে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেছেন, ‘আমরা ধৈর্য ধারণ করে মানবিক দিক থেকে আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছি। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনাও সে রকমই। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ধৈর্য ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’ তিনি আরো জানিয়েছেন, নতুন করে ৬৫ জন রোহিঙ্গা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছিল। টেকনাফে বিজিবির সদস্যরা তাদের প্রতিহত করে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছেন। অন্যদিকে দেশটিতে চলমান যুদ্ধে একের পর এক পরাজয়ের খবর আসছে জান্তা বাহিনীর। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে, সীমান্ত এলাকায় পরাজিত হয়ে বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। এরই মধ্যে গত তিন দিনে জান্তা বাহিনী আরো একাধিক ঘাঁটি এবং ৬২ জন সেনা হারিয়েছে। বুধবার আরও দুটি ঘাঁটি দখলে নিয়েছে বিদ্রোহীরা। সাগাইং, ম্যাগওয়ে ও মান্দালয় অঞ্চলসহ কাচিন ও কারেন রাজ্য থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) এবং জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে এই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। সাগাইং শহর বর্তমানে পিডিএফ যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যা পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছে জান্তা বাহিনী। পিডিএফ জানায়, মিয়ানমারের শাসক বাহিনী সাগাইং অঞ্চলের হোমলিনের শোয়ে পাই আই শহর পুনরুদ্ধার করার মিশন ত্যাগ করেছে। সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলায় ১০ দিন ধরে পিডিএফের সঙ্গে লড়াই করে না পেরে অবশেষে পিছু হটে জান্তা বাহিনী। গত ২৬ জানুয়ারি থেকে জান্তা বাহিনীর প্রায় ৪০০ জন সদস্য এবং মিত্র শন্তি শান্নি ন্যাশনালিটস আর্মি (এসএনএ) শহরটি পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছিল। গত বছরের ২২ নভেম্বর থেকে শহরটি নিজেদের দখলে রেখেছে পিডিএফ বাহিনী। সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সীমান্তবর্তী স্কুলগুলো বন্ধ ও সবাইকে আতঙ্কিত না হয়ে সজাগ থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সীমান্তে এখন প্রতিটি সময় বাংলাদেশের জন্য সতর্কের। ওই দেশের বহু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আমাদের দেশে ঢুকে পড়েছে। সাময়িক আশ্রয় নিয়েছে। এ দেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে, এখনো তাদের ফেরত পাঠানো যায়নি। এর মধ্যে ওই দেশের বাহিনীও এখন ঢুকছে। যেভাবেই হোক, তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে হবে। এখন জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ খুবই জরুরি। তাদের অবস্থান দীর্ঘায়িত হলে আমাদের জন্য বিষফোঁড়া হতে পারে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, এটা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ, বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধের প্রতিফল হিসেবে কিছু গোলাগুলি আমাদের এখানে এসে পড়ছে। যুদ্ধের কারণে যে গোলা এখানে এসে পড়ছে, তা বন্ধ হওয়া নিয়ে আমি সংশয়ে আছি। এখন আমাদের এমন একটা কৌশল তৈরি করতে হবে, যেন কোনো পক্ষই (আরাকান বিজিপি ও মিয়ানমার আর্মি) বাংলাদেশের দিকে গোলা বা কামান তাক না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
স/ম























