১২:১১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

অব্যাহত অভিযানেও চলছে অবৈধ ক্লিনিক হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টার

➢ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে নিঃস্ব হচ্ছেন রোগীরা
➢ নিবন্ধিত ১৩ হাজার ৬১১টি, অনিবন্ধিত ১ হাজার ২৮৫টি
➢ ভুয়া ডাক্তার-নার্স-টেকনিশিয়ানের ছড়াছড়ি
➢ দুর্ঘটনা ঘটলে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের
➢ হাসপাতাল পরিচালনায় মানতে হবে ১০ নির্দেশনা
➢ ঢাকায় সরকারি ৪ হাসপাতালে র‌্যাবের জালে ৪১ দালাল

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেসরকারিভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কঠোর দিকনির্দেশনা থাকলেও কেউ তা মানছেন না। দেশে নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে অধিকাংশ রোগী ও তাদের স্বজনদের অনেকটা জিম্মি করে সেবার নামে বাণিজ্য শুরু করেছে একশ্রেণির মানুষ। এতে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। অবৈধ এসব প্রতিষ্ঠানে নেই ডিগ্রিধারী অভিজ্ঞ চিকিৎসক-নার্স ও টেকনোলজিস্ট। নেই পর্যাপ্ত জনবল ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জরুরি প্রয়োজনীয় মেশিন। ভুয়া ডাক্তারের কবলে পড়ে ভুল চিকিৎসায় শিশুসহ অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন। অভিযোগ উঠেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানের গতি কমে এলে সক্রিয় হয়ে ওঠে কথিত স্বাস্থ্য সেবামূলক এসব প্রতিষ্ঠান। কখনো অনাকাক্সিক্ষতভাবে এসব প্রতিষ্ঠানে দুর্ঘটনায় হতাহত ঘটলে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। এদিকে সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে গতকাল বুধবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে সরকারি ৪টি হাসপাতালে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে ৪১ জন দালালকে গ্রেপ্তার করেছে। অব্যাহত অভিযানেও চলছে অবৈধ স্বাস্থ্য সেবামূলক এসব প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এরই মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও রোগীর সেবা নিশ্চিতে সেবামূলক এসব প্রতিষ্ঠানকে ১০টি নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকগুলো অনেকটাই ফ্রি স্টাইলে পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের নেই অনুমোদন। যাদের আছে মেয়াদ শেষে তারাও নবায়ন করেন না। মানা হয় না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শর্ত। আর এসব খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে উল্টো মালিক পক্ষের তোপের মুখে পড়ছে সাংবাদিকরা। এর আগে একাধিকবার লাইসেন্সবিহীন হাসপাতালগুলোর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অনুমোদন ছাড়াই রাজধানীর শনির আখড়ার লাইফ হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনা করা হচ্ছে। লাইসেন্সের বিষয়ে জানতে চাইলে ক্ষুব্ধ হন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্য স্টাফরা। লাইসেন্স থাকলেও ছয় বছর ধরে নবায়ন না করার অভিযোগ রয়েছে ডেমরার মেডিহোপ হাসপাতালের বিরুদ্ধে। যাত্রাবাড়ীর ইউনিক হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্সের মেয়াদও ফুরিয়েছে ৬ বছর আগে। মাতুয়াইলের আনোয়ার মেডিক্যালে সাইনবোর্ড ছাড়া ফ্ল্যাট বাসায় চলে অস্ত্রোপচার। নেই অভিজ্ঞ ডাক্তার-নার্স। মালিকের কাছ থেকেই নার্সের কাজ শিখেছেন বলে জানান কর্মরতরা। লাইসেন্স নিয়ে অভিযোগ রয়েছে মোহাম্মদপুরের পিপলস ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে। সাংবাদিক পরিচয় শুনেই চটে যান প্রতিষ্ঠানের প্রমাসনিক কর্মকর্তারা। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের বিস্তীর্ণ জনপদে গড়ে উঠেছে ডলফিন, মেডিকেয়ার, রিভারসাইড, ফাস্ট এইড, ল্যাব কর্নারসহ অন্তত ২০ থেকে ৩০টি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে অলি-গলিতে গড়ে উঠেছে ওষুধ বিক্রির ফার্মেসি। কিন্তু নেই কোনো অভিজ্ঞ ফার্মাসিস্ট। এসব হাসপাতালে কোনো রোগী গেলেই কর্তব্যরত ডাক্তার কমিশন বাণিজ্যের আড়ালে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধপত্র দেন। এতেই নিঃস্ব হচ্ছেন অনেক রোগী ও তাদের স্বজনেরা। সম্প্রতি গাইনী সমস্যা নিয়ে ডলফিনে ভর্তি হন এক নারী। ওই নারী এক শিশু জন্ম দিলে ডাক্তার শিশুটিকে ঢামেকে পাঠান। কিন্তু ঢামেকে নবজাতক ইউনিটে সিট না থাকায় শিশুটিকে নিয়ে যাওয়া হতদরিদ্র মন্টু মিয়া ও তার স্বজনরা পড়েন দালালের খপ্পরে। দালালরা তাকে নিয়ে যান চাঁনখারপুল মোড়ে আহমেদ হাসপাতালে। সেখানে তাকে এনআইসিইউতে ৪ দিন ভর্তি রাখার কথা বলে চিকিৎসা করেন সংশ্লিষ্টরা। এরপর শিশুটি মারা গেছে জানিয়ে লাখ টাকার ওপরে বিল ধরিয়ে দেন। অনেক আকুতি-মিনতি জানিয়ে অর্ধেক টাকা দিয়ে লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরেন মন্টু। এদিকে মিরপুরের কালশীতে এশিয়ান ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং এএইচএস ডায়ালাইসিসি অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে দেখা যায় রিসিপশনিস্ট কাউন্টারের সামনে ব্যবসায়িক ট্রেড লাইসেন্স ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সঙ্গে তোলা মালিকপক্ষের ছবি টাঙিয়ে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। লাইসেন্সের আবেদন না করেই দুই হাসপাতালে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এদিকে চিকিৎসক ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যুক্ত জরুরি প্রয়োজনীয় মেশিন না থাকায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ৪ প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে বলে দৈনিক সবুজ বাংলাকে জানান চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। তিনি বলেন, বিভিন্ন অনিয়ম খুঁজতে স্বাস্থ্য বিভাগের অভিযান শুরু হয়েছে। অনিয়ম পাওয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে এক হাজার ২৮৫টি অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। গত সপ্তাহে চলা অভিযানে বিভিন্ন বিভাগ ও জেলায় বেশ কিছু অবৈধ হাসপাতাল বন্ধ ও জরিমানা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় কর্মকর্তাদের তথ্যে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ৪১৫টি অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক রয়েছে ঢাকা বিভাগে। এরপর ময়মনসিংহে ২৫২টি, চট্টগ্রামে ২৪০টি, খুলনায় ১৫৬টি, রংপুরে ১১১টি, রাজশাহীতে ৫৫টি, বরিশালে ৪৮টি ও সিলেট বিভাগে আটটি অবৈধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, অবৈধ ক্লিনিকগুলোর কোনোটি ক্লিনিকের লাইসেন্স নিয়ে এর সঙ্গে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কোনোটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নিয়ে এর সঙ্গে ক্লিনিক পরিচালনা করে এসেছে। আবার কোনোটি শুধু লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে সে কপি ডেস্কের সামনে ঝুলিয়ে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগী দেখেন সরকারি চিকিৎসকরা। দেশে প্রাথমিক নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের সংখ্যা ৫০ হাজারের মতো, যেগুলোর বেশির ভাগই এক প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা মোবাইল নাম্বার দিয়ে ১০ থেকে ১২টি নিবন্ধন করেছে। অনেকের নিবন্ধন নম্বর থাকলেও প্রতিষ্ঠান আলোর মুখ দেখেনি। তবে সারা দেশে অনুমোদিত বেসরকারি হাসপাতাল আছে পাঁচ হাজার। আর অনুমোদন নিয়ে চলছে ১০ হাজার ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে নিবন্ধিত মোট বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ১৩ হাজার ৬১১টি। লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করেছে ২২ হাজার ৪২৭টি। নতুন হাসপাতাল তৈরির আবেদনের সংখ্যা ১৮ হাজার ৬২৫টি। এর বাইরেও রাজধানীসহ সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে কয়েক হাজার হাসপাতাল ও ক্লিনিক- যার সংখ্যা হতে পারে অর্ধ লক্ষাধিক। এসব প্রতিষ্ঠানে অভিজ্ঞ চিকিৎসক-নার্স-টেকনোলজিস্ট তো দূরের কথা, ভুয়া ডিগ্রির লোকজন দিয়ে এসব অবাধে চলছে প্রশাসনের নাকের ডগায়।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, বেসরকারি ক্লিনিক হাসপাতালের অরাজক অবস্থার জন্য কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার ঘাটতি আর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারা বলেন, যত প্যাথলজি আছে, হাসপাতাল আছে সব অটোমেশিন। অনুমোদন ছাড়া কিছুতেই শুরু করা যাবে না, এটা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া দ্রুত তাদের লাইসেন্স দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আর কেউ যদি অসাধুভাবে কোনো ক্লিনিক হাসপাতাল খুলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। তবে জরিমানা করে কোনো লাভ হবে না, জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই এর একটা উন্নতি হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা জানান, অনুমোদনহীন হাসপাতাল-ক্লিনিকে রোগীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত টাকা আদায় ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভুল রিপোর্ট দেওয়াসহ নানান অভিযোগ এলে টনক নড়ে সরকারের। চলে অভিযান। কিন্তু জরিমানা দিয়েই এসব প্রতিষ্ঠান আবারও শুরু করে ব্যবসা। এগুলোর লাগাম টানা এখন সময়ে দাবি।

চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবা চলে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। সে কলেবরে প্রাইভেট সেক্টরে নজরদারির জন্য জনবলের ও কাঠামোর যে বিস্তৃতি দরকার, সেটি কিন্তু খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। অধিদপ্তরের জনবল অপ্রতুল। সারা দেশের সিভিল সার্জন ও বিভাগীয় পরিচালকদের অবস্থা আরো করুণ। দু-তিনজনের লোকবল নিয়ে চলছে। এই জনবল ও কাঠোমো দিয়ে নজরদারি করতে চাইলেও তা সম্ভব নয়।
এদিকে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে সুন্নতে খৎনার সময় দুই শিশুর প্রাণহানির ঘটনাকে কেন্দ্র করে খৎনার বিষয়ে পরিবারগুলোর মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন দুর্নীতির কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর মানুষ আস্থা হারাচ্ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান বলেন, সারা দেশে ১ হাজার ২৮৫ অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিকের সন্ধান পেয়েছি। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আমরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ১৮টি হাসপাতাল পরিদর্শন করেছি। এর মধ্যে দু’টির লাইসেন্স নেই, দু’টি মানহীন এবং দু’টিতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। এই ছয়টি হাসপাতাল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অন্য ১২টি হাসপাতালেও সেবার মান, যন্ত্রপাতি ও পরিচ্ছন্নতাসহ বিভিন্ন ত্রুটি পেয়েছি। তাদেরও শাস্তির আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। ত্রুটিযুক্ত ও অবৈধ হাসপাতাল বন্ধে এ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি আরো বলেন, দেশের ক্লিনিক ও হাসপাতাল নিয়ে নতুন ১০টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেউ এর ব্যতয় ঘটালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান ডা. আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান।

সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিকের বিষয়ে আমি জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করি। এর বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। কাউকে ছাড় দেব না। যার যে যোগ্যতা সে সেখানেই কাজ করবে, এর বাইরে কিছু না। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতে এত অসঙ্গতি, এর কোনোটার দায়ই মন্ত্রী হিসেবে এড়ানো সম্ভব নয়। তবে স্বাস্থ্যসেবা খাতের অনিয়ম রোধে যে কোনো দিন মন্ত্রী হিসেবে অভিযানে নামবো। একার পক্ষে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সবার সহযোগিতায় অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হবে। মন্ত্রী বলেন, খৎনা করতে গিয়ে একটা শিশু মারা গেল, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। ভুল জায়গায় চিকিৎসা নেওয়ার চেয়ে চিকিৎসা না নেওয়াই ভালো। সঠিক জায়গায় চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
ঢাকায় সরকারি ৪ হাসপাতালে র‌্যাবের জালে ৪১ দালাল : রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকায় সরকারি চার হাসপাতালের সামনে থেকে সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের ৪১ সদস্য র‌্যাবের জালে ধরা পড়েছেন। এসময় র‌্যাব-২ এর সহযোগিতায় গতকাল বুধবার দুপুর ১২টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এ অভিযান পরিচালনা করেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। হাসপাতাল ৪টি হলো শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান এবং ঢাকা শিশু হাসপাতাল।

র‌্যাব-২ এর উপ-অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ নাজমুল্লাহেল ওয়াদুদ বলেন, গতকাল আকস্মিকভাবে হাসপাতালগুলোর সামনে অভিযান পরিচালনা করি। শেরেবাংলা নগর এলাকায় সরকারি চার হাসপাতালের সামনে র‌্যাব-২ এর ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে চক্রের ৪১ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে ১৮ জন, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে ১৫ জন, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের সামনে থেকে চারজন এবং ঢাকা শিশু হাসপাতালের সামনে থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এসব হাসপাতালে আসা রোগীদের অনেকটা জিম্মি করেই দালাল চক্রের সদস্যরা অর্থ হাতিয়ে নেয়। তারা দালাল চক্রের সক্রিয় সদস্য। চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তারে র‌্যাব-২ এর অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

উল্লেখ্য, রাজধানীর বাড্ডার সাঁতারকুলে ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনার অভিযোগের পর লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এরই মধ্যে গত সপ্তাহে মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিক্যাল চেকআপ সেন্টারে আরেক শিশু আহনাফ তাহমিদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এরপর লাইসেন্সবিহীন হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

জনপ্রিয় সংবাদ

স্মৃতিসৌধে তারেক রহমান

অব্যাহত অভিযানেও চলছে অবৈধ ক্লিনিক হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টার

আপডেট সময় : ১১:০০:২৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

➢ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে নিঃস্ব হচ্ছেন রোগীরা
➢ নিবন্ধিত ১৩ হাজার ৬১১টি, অনিবন্ধিত ১ হাজার ২৮৫টি
➢ ভুয়া ডাক্তার-নার্স-টেকনিশিয়ানের ছড়াছড়ি
➢ দুর্ঘটনা ঘটলে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের
➢ হাসপাতাল পরিচালনায় মানতে হবে ১০ নির্দেশনা
➢ ঢাকায় সরকারি ৪ হাসপাতালে র‌্যাবের জালে ৪১ দালাল

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেসরকারিভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কঠোর দিকনির্দেশনা থাকলেও কেউ তা মানছেন না। দেশে নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে অধিকাংশ রোগী ও তাদের স্বজনদের অনেকটা জিম্মি করে সেবার নামে বাণিজ্য শুরু করেছে একশ্রেণির মানুষ। এতে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। অবৈধ এসব প্রতিষ্ঠানে নেই ডিগ্রিধারী অভিজ্ঞ চিকিৎসক-নার্স ও টেকনোলজিস্ট। নেই পর্যাপ্ত জনবল ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জরুরি প্রয়োজনীয় মেশিন। ভুয়া ডাক্তারের কবলে পড়ে ভুল চিকিৎসায় শিশুসহ অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন। অভিযোগ উঠেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানের গতি কমে এলে সক্রিয় হয়ে ওঠে কথিত স্বাস্থ্য সেবামূলক এসব প্রতিষ্ঠান। কখনো অনাকাক্সিক্ষতভাবে এসব প্রতিষ্ঠানে দুর্ঘটনায় হতাহত ঘটলে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। এদিকে সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে গতকাল বুধবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে সরকারি ৪টি হাসপাতালে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে ৪১ জন দালালকে গ্রেপ্তার করেছে। অব্যাহত অভিযানেও চলছে অবৈধ স্বাস্থ্য সেবামূলক এসব প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এরই মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও রোগীর সেবা নিশ্চিতে সেবামূলক এসব প্রতিষ্ঠানকে ১০টি নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকগুলো অনেকটাই ফ্রি স্টাইলে পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের নেই অনুমোদন। যাদের আছে মেয়াদ শেষে তারাও নবায়ন করেন না। মানা হয় না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শর্ত। আর এসব খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে উল্টো মালিক পক্ষের তোপের মুখে পড়ছে সাংবাদিকরা। এর আগে একাধিকবার লাইসেন্সবিহীন হাসপাতালগুলোর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অনুমোদন ছাড়াই রাজধানীর শনির আখড়ার লাইফ হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনা করা হচ্ছে। লাইসেন্সের বিষয়ে জানতে চাইলে ক্ষুব্ধ হন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্য স্টাফরা। লাইসেন্স থাকলেও ছয় বছর ধরে নবায়ন না করার অভিযোগ রয়েছে ডেমরার মেডিহোপ হাসপাতালের বিরুদ্ধে। যাত্রাবাড়ীর ইউনিক হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্সের মেয়াদও ফুরিয়েছে ৬ বছর আগে। মাতুয়াইলের আনোয়ার মেডিক্যালে সাইনবোর্ড ছাড়া ফ্ল্যাট বাসায় চলে অস্ত্রোপচার। নেই অভিজ্ঞ ডাক্তার-নার্স। মালিকের কাছ থেকেই নার্সের কাজ শিখেছেন বলে জানান কর্মরতরা। লাইসেন্স নিয়ে অভিযোগ রয়েছে মোহাম্মদপুরের পিপলস ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে। সাংবাদিক পরিচয় শুনেই চটে যান প্রতিষ্ঠানের প্রমাসনিক কর্মকর্তারা। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের বিস্তীর্ণ জনপদে গড়ে উঠেছে ডলফিন, মেডিকেয়ার, রিভারসাইড, ফাস্ট এইড, ল্যাব কর্নারসহ অন্তত ২০ থেকে ৩০টি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে অলি-গলিতে গড়ে উঠেছে ওষুধ বিক্রির ফার্মেসি। কিন্তু নেই কোনো অভিজ্ঞ ফার্মাসিস্ট। এসব হাসপাতালে কোনো রোগী গেলেই কর্তব্যরত ডাক্তার কমিশন বাণিজ্যের আড়ালে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধপত্র দেন। এতেই নিঃস্ব হচ্ছেন অনেক রোগী ও তাদের স্বজনেরা। সম্প্রতি গাইনী সমস্যা নিয়ে ডলফিনে ভর্তি হন এক নারী। ওই নারী এক শিশু জন্ম দিলে ডাক্তার শিশুটিকে ঢামেকে পাঠান। কিন্তু ঢামেকে নবজাতক ইউনিটে সিট না থাকায় শিশুটিকে নিয়ে যাওয়া হতদরিদ্র মন্টু মিয়া ও তার স্বজনরা পড়েন দালালের খপ্পরে। দালালরা তাকে নিয়ে যান চাঁনখারপুল মোড়ে আহমেদ হাসপাতালে। সেখানে তাকে এনআইসিইউতে ৪ দিন ভর্তি রাখার কথা বলে চিকিৎসা করেন সংশ্লিষ্টরা। এরপর শিশুটি মারা গেছে জানিয়ে লাখ টাকার ওপরে বিল ধরিয়ে দেন। অনেক আকুতি-মিনতি জানিয়ে অর্ধেক টাকা দিয়ে লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরেন মন্টু। এদিকে মিরপুরের কালশীতে এশিয়ান ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং এএইচএস ডায়ালাইসিসি অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে দেখা যায় রিসিপশনিস্ট কাউন্টারের সামনে ব্যবসায়িক ট্রেড লাইসেন্স ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সঙ্গে তোলা মালিকপক্ষের ছবি টাঙিয়ে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। লাইসেন্সের আবেদন না করেই দুই হাসপাতালে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এদিকে চিকিৎসক ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যুক্ত জরুরি প্রয়োজনীয় মেশিন না থাকায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ৪ প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে বলে দৈনিক সবুজ বাংলাকে জানান চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। তিনি বলেন, বিভিন্ন অনিয়ম খুঁজতে স্বাস্থ্য বিভাগের অভিযান শুরু হয়েছে। অনিয়ম পাওয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে এক হাজার ২৮৫টি অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। গত সপ্তাহে চলা অভিযানে বিভিন্ন বিভাগ ও জেলায় বেশ কিছু অবৈধ হাসপাতাল বন্ধ ও জরিমানা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় কর্মকর্তাদের তথ্যে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ৪১৫টি অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক রয়েছে ঢাকা বিভাগে। এরপর ময়মনসিংহে ২৫২টি, চট্টগ্রামে ২৪০টি, খুলনায় ১৫৬টি, রংপুরে ১১১টি, রাজশাহীতে ৫৫টি, বরিশালে ৪৮টি ও সিলেট বিভাগে আটটি অবৈধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, অবৈধ ক্লিনিকগুলোর কোনোটি ক্লিনিকের লাইসেন্স নিয়ে এর সঙ্গে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কোনোটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নিয়ে এর সঙ্গে ক্লিনিক পরিচালনা করে এসেছে। আবার কোনোটি শুধু লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে সে কপি ডেস্কের সামনে ঝুলিয়ে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগী দেখেন সরকারি চিকিৎসকরা। দেশে প্রাথমিক নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের সংখ্যা ৫০ হাজারের মতো, যেগুলোর বেশির ভাগই এক প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা মোবাইল নাম্বার দিয়ে ১০ থেকে ১২টি নিবন্ধন করেছে। অনেকের নিবন্ধন নম্বর থাকলেও প্রতিষ্ঠান আলোর মুখ দেখেনি। তবে সারা দেশে অনুমোদিত বেসরকারি হাসপাতাল আছে পাঁচ হাজার। আর অনুমোদন নিয়ে চলছে ১০ হাজার ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে নিবন্ধিত মোট বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ১৩ হাজার ৬১১টি। লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করেছে ২২ হাজার ৪২৭টি। নতুন হাসপাতাল তৈরির আবেদনের সংখ্যা ১৮ হাজার ৬২৫টি। এর বাইরেও রাজধানীসহ সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে কয়েক হাজার হাসপাতাল ও ক্লিনিক- যার সংখ্যা হতে পারে অর্ধ লক্ষাধিক। এসব প্রতিষ্ঠানে অভিজ্ঞ চিকিৎসক-নার্স-টেকনোলজিস্ট তো দূরের কথা, ভুয়া ডিগ্রির লোকজন দিয়ে এসব অবাধে চলছে প্রশাসনের নাকের ডগায়।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, বেসরকারি ক্লিনিক হাসপাতালের অরাজক অবস্থার জন্য কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার ঘাটতি আর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারা বলেন, যত প্যাথলজি আছে, হাসপাতাল আছে সব অটোমেশিন। অনুমোদন ছাড়া কিছুতেই শুরু করা যাবে না, এটা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া দ্রুত তাদের লাইসেন্স দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আর কেউ যদি অসাধুভাবে কোনো ক্লিনিক হাসপাতাল খুলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। তবে জরিমানা করে কোনো লাভ হবে না, জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই এর একটা উন্নতি হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা জানান, অনুমোদনহীন হাসপাতাল-ক্লিনিকে রোগীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত টাকা আদায় ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভুল রিপোর্ট দেওয়াসহ নানান অভিযোগ এলে টনক নড়ে সরকারের। চলে অভিযান। কিন্তু জরিমানা দিয়েই এসব প্রতিষ্ঠান আবারও শুরু করে ব্যবসা। এগুলোর লাগাম টানা এখন সময়ে দাবি।

চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবা চলে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। সে কলেবরে প্রাইভেট সেক্টরে নজরদারির জন্য জনবলের ও কাঠামোর যে বিস্তৃতি দরকার, সেটি কিন্তু খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। অধিদপ্তরের জনবল অপ্রতুল। সারা দেশের সিভিল সার্জন ও বিভাগীয় পরিচালকদের অবস্থা আরো করুণ। দু-তিনজনের লোকবল নিয়ে চলছে। এই জনবল ও কাঠোমো দিয়ে নজরদারি করতে চাইলেও তা সম্ভব নয়।
এদিকে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে সুন্নতে খৎনার সময় দুই শিশুর প্রাণহানির ঘটনাকে কেন্দ্র করে খৎনার বিষয়ে পরিবারগুলোর মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন দুর্নীতির কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর মানুষ আস্থা হারাচ্ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান বলেন, সারা দেশে ১ হাজার ২৮৫ অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিকের সন্ধান পেয়েছি। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আমরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ১৮টি হাসপাতাল পরিদর্শন করেছি। এর মধ্যে দু’টির লাইসেন্স নেই, দু’টি মানহীন এবং দু’টিতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। এই ছয়টি হাসপাতাল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অন্য ১২টি হাসপাতালেও সেবার মান, যন্ত্রপাতি ও পরিচ্ছন্নতাসহ বিভিন্ন ত্রুটি পেয়েছি। তাদেরও শাস্তির আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। ত্রুটিযুক্ত ও অবৈধ হাসপাতাল বন্ধে এ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি আরো বলেন, দেশের ক্লিনিক ও হাসপাতাল নিয়ে নতুন ১০টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেউ এর ব্যতয় ঘটালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান ডা. আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান।

সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিকের বিষয়ে আমি জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করি। এর বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। কাউকে ছাড় দেব না। যার যে যোগ্যতা সে সেখানেই কাজ করবে, এর বাইরে কিছু না। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতে এত অসঙ্গতি, এর কোনোটার দায়ই মন্ত্রী হিসেবে এড়ানো সম্ভব নয়। তবে স্বাস্থ্যসেবা খাতের অনিয়ম রোধে যে কোনো দিন মন্ত্রী হিসেবে অভিযানে নামবো। একার পক্ষে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সবার সহযোগিতায় অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হবে। মন্ত্রী বলেন, খৎনা করতে গিয়ে একটা শিশু মারা গেল, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। ভুল জায়গায় চিকিৎসা নেওয়ার চেয়ে চিকিৎসা না নেওয়াই ভালো। সঠিক জায়গায় চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
ঢাকায় সরকারি ৪ হাসপাতালে র‌্যাবের জালে ৪১ দালাল : রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকায় সরকারি চার হাসপাতালের সামনে থেকে সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের ৪১ সদস্য র‌্যাবের জালে ধরা পড়েছেন। এসময় র‌্যাব-২ এর সহযোগিতায় গতকাল বুধবার দুপুর ১২টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এ অভিযান পরিচালনা করেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। হাসপাতাল ৪টি হলো শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান এবং ঢাকা শিশু হাসপাতাল।

র‌্যাব-২ এর উপ-অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ নাজমুল্লাহেল ওয়াদুদ বলেন, গতকাল আকস্মিকভাবে হাসপাতালগুলোর সামনে অভিযান পরিচালনা করি। শেরেবাংলা নগর এলাকায় সরকারি চার হাসপাতালের সামনে র‌্যাব-২ এর ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে চক্রের ৪১ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে ১৮ জন, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে ১৫ জন, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের সামনে থেকে চারজন এবং ঢাকা শিশু হাসপাতালের সামনে থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এসব হাসপাতালে আসা রোগীদের অনেকটা জিম্মি করেই দালাল চক্রের সদস্যরা অর্থ হাতিয়ে নেয়। তারা দালাল চক্রের সক্রিয় সদস্য। চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তারে র‌্যাব-২ এর অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

উল্লেখ্য, রাজধানীর বাড্ডার সাঁতারকুলে ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনার অভিযোগের পর লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এরই মধ্যে গত সপ্তাহে মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিক্যাল চেকআপ সেন্টারে আরেক শিশু আহনাফ তাহমিদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এরপর লাইসেন্সবিহীন হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।