০৯:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নগদ সহায়তা এবং রপ্তানি খাতে চ্যালেঞ্জ

বিকল্প নগদ সহায়তা বা রপ্তানি ভর্তুকি বলতে সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট কিছু পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারক/ উৎপাদনকারীদের রপ্তানি মূল্য প্রত্যাবাসনের বিপরীতে অন্যান্য সুবিধার বিকল্প হিসেবে একটি নির্দিষ্ট হারে নগদ সহায়তা প্রদান করাকে বোঝায়। যেসব রপ্তানিকারক/উৎপাদনকারী নগদ সহায়তা সুবিধা পান, তাদের বন্ডেড ওয়্যারহাউজ ও ডিউটি ড্র ব্যাক সুবিধা দেওয়া হয় না। ১৯৯৭ সালে প্রথম রপ্তানিমুখী পোশাক খাতে নগদ সহায়তা সুবিধা চালু হয়। শুরুতে ২৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়ার ফলে এরই মধ্যে দেশের রপ্তানিমুখী পোশাক খাতে বিশেষ করে নিটওয়্যারের একটি শক্তিশালী পশ্চাৎসংযোগ শিল্প গড়ে উঠেছে। বিদ্যমান অন্যান্য সব খাতের নগদ সহায়তা সরাসরি প্রত্যাবাসিত এফওবি মূল্যের ওপর দেওয়া হয়।

দেশীয় শিল্পের বিকাশ, রপ্তানি উদ্বুদ্ধকরণ এবং স্থানীয় মূল্য সংযোজন বৃদ্ধি উৎসাহিতকরণে সরকার পোশাক খাতে নগদ সহায়তা প্রদান করে আসছে। বাংলাদেশের মতো একটি বর্ধনশীল উন্নয়নশীল দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক মুদ্রাপ্রবাহ বৃদ্ধি তথা রিজার্ভ শক্তিশালী করা অত্যন্ত জরুরি। যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা থাকা মানে একটা দেশের অর্থনৈতিক ভিত শক্তিশালী মনে করা হয়। রপ্তানি বহুমুখীকরণ এবং এ খাতে বিভিন্ন উৎসাহমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে সরকার রপ্তানিকারদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করেছে। এ ধরনের সুবিধার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রপ্তানি বিপরীতে ভর্তুকি বা বিকল্প নগদ সহায়তা।

বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় বাংলাদেশ ২০১৫ সালের জুলাইয়ে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের উন্নীত হয়েছে। ১২ মার্চ ২০১৮ নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) চার দিনব্যাপী প্ল্যানার অধিবেশন। ১৪ মার্চ ২০১৮ অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ গ্রুপের সভা শেষে বাংলাদেশকে প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জনের ঘোষণা দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম বৈঠকের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের সুপারিশ গৃহীত হয়েছে। সিডিপি একই সঙ্গে বাংলাদেশকে ২০২১ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরব্যাপী প্রস্তুতিকাল প্রদানের সুপারিশ করেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ এরই মধ্যে সিডিপির সুপারিশ অনুমোদন করেছে। পাঁচ বছর প্রস্তুতিকাল শেষে বাংলাদেশের উত্তরণ ২০২৬ সালের ২৩ নভেম্বর কার্যকর হওয়ার কথা।

নগদ সহায়তা হ্রাস করার বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিওউটিও) এগ্রিমেন্ট অন সাবসিডিজ অ্যান্ড কাউন্টারভেলিং মেজার্স (এএসসিএম) চুক্তি অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হলে বাংলাদেশের কিছু বাণিজ্য ও অন্যান্য সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নগদ সহায়তা। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর একবারে নগদ সহায়তা প্রত্যাহার করা হলে রপ্তানি খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। সেজন্য চলতি বছর থেকে অল্প অল্প করে নগদ সহায়তা কমানোর বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

গত বছরের ২৪ আগস্ট জারি করা প্রজ্ঞাপনে রপ্তানি খাতের জাহাজিকৃত ৪৩টি পণ্যের ওপর চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। বলা হয় ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটতে যাচ্ছে। এরূপ উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে রপ্তানি প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা সম্পূর্ণভাবে একত্রে প্রত্যাহার করা হলে রপ্তানি খাত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। বিষয়টি বিবেচনায় ২০২৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে বিভিন্ন খাতে নগদ সহায়তার হার ক্রমান্বয়ে হ্রাসের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

নগদ সহায়তা হ্রাসের ফলে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন কোনো কিছু শুরুর জন্য ভালো সময় বলে কিছু নেই। এটা সরকারকে বাস্তবায়ন করতেই হবে। এছাড়া তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের ক্ষেত্রে বলা যায়, তারা বেশ প্রতিষ্ঠিত। তাদের খুব অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ডলারের দাম বাড়ার কারণে তাদের লাভটা হয়েছে। তবুও তাদের মধ্যে হতাশা। মাত্র ২, ৩ ও ৪ নগদ সুবিধা হ্রাসের ফলে ইন্ডাস্ট্রি মুখ থুবড়ে পড়বে না। আসলে আমাদের রপ্তানিকারকরা বছর বছর ধরে নগদ সহায়তার ওপর অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

নগদ সহায়তা হ্রাস এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের একটা প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে চিন্তা করা যেতে পারে। সরকার রপ্তানিকারকদের সুবিধার জন্য ক্রমান্বয়ে টাকার অবমূল্যায়ন করেছে এবং এটা আরো অব্যাহত থাকতে পারে। তার পরও প্রতিযোগিতার সক্ষমতার সঙ্গে জড়িত বাণিজ্য সহায়ক যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে তাদের কার্যকারিতা ও সক্ষমতা, বিনিয়োগ পরিবেশ ইত্যাদিতে সরকারকে সহযোগিতা উচিত। তবেই রপ্তানিকারকরা প্রতিযোগিতা ও সক্ষমতা বজায় রেখে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতাটা করতে পারবেন।

রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা বাড়াতে প্রণোদনা কোনো দীর্ঘমেয়াদি উপকরণ হতে পারে না। সহায়তার ওপর ভর করে অনির্দিষ্ট সময়কাল রপ্তানি বাণিজ্য চলতে পারে না। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই রপ্তানিকে এগিয়ে নিতে হবে। এখন রপ্তানিতে বহুমুখীকরণের ওপর জোর দিতে হবে। এক যুগ আগে দেশের মোট পণ্য রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের হিস্যা ছিল ৭৮ শতাংশ। গত বছর সেটি বেড়ে ৮২ শতাংশে উঠেছে। অন্যদিকে পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল এবং হিমায়িত খাদ্যের হিস্যা কমেছে। আবার পাট ও পাটজাত পণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি হিস্যা বাড়লেও তা খুবই সামান্য।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ লিড টাইম। এটি যতটা কমিয়ে আনা যাবে পোশাক খাত ততই টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি পণ্য আরো দ্রুত ডেলিভারি করতে হবে। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যক্রম আরো সহজ এবং স্বচ্ছ হতে হবে। এছাড়া ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা আছে, সেগুলো দূর করা গেলে পোশাক খাতে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি সম্ভব হবে। দুর্নীতি, আমলাতন্ত্র, সুশাসনের অভাবও লিড টাইম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত একজন ব্যাংকার হিসেবে লক্ষ করেছি যে, বর্তমানে বিদেশ থেকে পাঠানো আমদানি ডকুমেন্টের ভুলত্রুটি বা ডিসক্রিপেন্সি খুব একটা পাওয়া যায় না। কিছু নামকরা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো ডকুমেন্টে কোনো ত্রুটিই খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের প্রায় ৯০ শতাংশ ডকুমেন্টই ত্রুটিপূর্ণ বা ডিসক্রিপেন্ট, যা মূল্য প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করে। রপ্তানিকারকদেরকে ত্রুটিমুক্ত ডকুমেন্ট প্রস্তুতের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিভিন্ন পণ্যে মেধাস্বত্বের জন্য মূল্য পরিশোধ এবং আইনকানুনে শৃঙ্খলা আনতে হবে। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিভিন্ন সক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা এবং অংশীদারত্ব বাড়াতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে। বিশ্বের যেসব দেশ পণ্য রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে পেরেছে, তারা প্রত্যেকেই বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে করেছে। আমাদেরও সেই পথেই যেতে হবে। কারণ, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে আসে। ফলে তারা পণ্য রপ্তানিতে ভালো দাম পায়। মূলত এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রণোদনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটা সবাইকে মেনে নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি হিসেবে সরকার ধাপে ধাপে নগদ প্রণোদনা কমানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি ঠিকই আছে বলা যায়। বাংলাদেশ আজীবন হতদরিদ্র দেশের তালিকায় থাকবেÑ এটা প্রত্যাশা করা যায় না। দেশ ও জাতির উন্নয়ন ও মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে নগদ সহায়তা স্থায়ীভাবে রহিত করা হলে রপ্তানি খাতে খানিটা চ্যালেঞ্জ আসবে এটা সত্য। তবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য রপ্তানিকারকদেরকে সাহস ও সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

নগদ সহায়তা এবং রপ্তানি খাতে চ্যালেঞ্জ

আপডেট সময় : ০৬:০২:৪৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ ২০২৪

বিকল্প নগদ সহায়তা বা রপ্তানি ভর্তুকি বলতে সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট কিছু পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারক/ উৎপাদনকারীদের রপ্তানি মূল্য প্রত্যাবাসনের বিপরীতে অন্যান্য সুবিধার বিকল্প হিসেবে একটি নির্দিষ্ট হারে নগদ সহায়তা প্রদান করাকে বোঝায়। যেসব রপ্তানিকারক/উৎপাদনকারী নগদ সহায়তা সুবিধা পান, তাদের বন্ডেড ওয়্যারহাউজ ও ডিউটি ড্র ব্যাক সুবিধা দেওয়া হয় না। ১৯৯৭ সালে প্রথম রপ্তানিমুখী পোশাক খাতে নগদ সহায়তা সুবিধা চালু হয়। শুরুতে ২৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়ার ফলে এরই মধ্যে দেশের রপ্তানিমুখী পোশাক খাতে বিশেষ করে নিটওয়্যারের একটি শক্তিশালী পশ্চাৎসংযোগ শিল্প গড়ে উঠেছে। বিদ্যমান অন্যান্য সব খাতের নগদ সহায়তা সরাসরি প্রত্যাবাসিত এফওবি মূল্যের ওপর দেওয়া হয়।

দেশীয় শিল্পের বিকাশ, রপ্তানি উদ্বুদ্ধকরণ এবং স্থানীয় মূল্য সংযোজন বৃদ্ধি উৎসাহিতকরণে সরকার পোশাক খাতে নগদ সহায়তা প্রদান করে আসছে। বাংলাদেশের মতো একটি বর্ধনশীল উন্নয়নশীল দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক মুদ্রাপ্রবাহ বৃদ্ধি তথা রিজার্ভ শক্তিশালী করা অত্যন্ত জরুরি। যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা থাকা মানে একটা দেশের অর্থনৈতিক ভিত শক্তিশালী মনে করা হয়। রপ্তানি বহুমুখীকরণ এবং এ খাতে বিভিন্ন উৎসাহমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে সরকার রপ্তানিকারদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করেছে। এ ধরনের সুবিধার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রপ্তানি বিপরীতে ভর্তুকি বা বিকল্প নগদ সহায়তা।

বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় বাংলাদেশ ২০১৫ সালের জুলাইয়ে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের উন্নীত হয়েছে। ১২ মার্চ ২০১৮ নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) চার দিনব্যাপী প্ল্যানার অধিবেশন। ১৪ মার্চ ২০১৮ অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ গ্রুপের সভা শেষে বাংলাদেশকে প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জনের ঘোষণা দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম বৈঠকের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের সুপারিশ গৃহীত হয়েছে। সিডিপি একই সঙ্গে বাংলাদেশকে ২০২১ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরব্যাপী প্রস্তুতিকাল প্রদানের সুপারিশ করেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ এরই মধ্যে সিডিপির সুপারিশ অনুমোদন করেছে। পাঁচ বছর প্রস্তুতিকাল শেষে বাংলাদেশের উত্তরণ ২০২৬ সালের ২৩ নভেম্বর কার্যকর হওয়ার কথা।

নগদ সহায়তা হ্রাস করার বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিওউটিও) এগ্রিমেন্ট অন সাবসিডিজ অ্যান্ড কাউন্টারভেলিং মেজার্স (এএসসিএম) চুক্তি অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হলে বাংলাদেশের কিছু বাণিজ্য ও অন্যান্য সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নগদ সহায়তা। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর একবারে নগদ সহায়তা প্রত্যাহার করা হলে রপ্তানি খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। সেজন্য চলতি বছর থেকে অল্প অল্প করে নগদ সহায়তা কমানোর বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

গত বছরের ২৪ আগস্ট জারি করা প্রজ্ঞাপনে রপ্তানি খাতের জাহাজিকৃত ৪৩টি পণ্যের ওপর চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। বলা হয় ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটতে যাচ্ছে। এরূপ উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে রপ্তানি প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা সম্পূর্ণভাবে একত্রে প্রত্যাহার করা হলে রপ্তানি খাত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। বিষয়টি বিবেচনায় ২০২৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে বিভিন্ন খাতে নগদ সহায়তার হার ক্রমান্বয়ে হ্রাসের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

নগদ সহায়তা হ্রাসের ফলে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন কোনো কিছু শুরুর জন্য ভালো সময় বলে কিছু নেই। এটা সরকারকে বাস্তবায়ন করতেই হবে। এছাড়া তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের ক্ষেত্রে বলা যায়, তারা বেশ প্রতিষ্ঠিত। তাদের খুব অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ডলারের দাম বাড়ার কারণে তাদের লাভটা হয়েছে। তবুও তাদের মধ্যে হতাশা। মাত্র ২, ৩ ও ৪ নগদ সুবিধা হ্রাসের ফলে ইন্ডাস্ট্রি মুখ থুবড়ে পড়বে না। আসলে আমাদের রপ্তানিকারকরা বছর বছর ধরে নগদ সহায়তার ওপর অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

নগদ সহায়তা হ্রাস এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের একটা প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে চিন্তা করা যেতে পারে। সরকার রপ্তানিকারকদের সুবিধার জন্য ক্রমান্বয়ে টাকার অবমূল্যায়ন করেছে এবং এটা আরো অব্যাহত থাকতে পারে। তার পরও প্রতিযোগিতার সক্ষমতার সঙ্গে জড়িত বাণিজ্য সহায়ক যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে তাদের কার্যকারিতা ও সক্ষমতা, বিনিয়োগ পরিবেশ ইত্যাদিতে সরকারকে সহযোগিতা উচিত। তবেই রপ্তানিকারকরা প্রতিযোগিতা ও সক্ষমতা বজায় রেখে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতাটা করতে পারবেন।

রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা বাড়াতে প্রণোদনা কোনো দীর্ঘমেয়াদি উপকরণ হতে পারে না। সহায়তার ওপর ভর করে অনির্দিষ্ট সময়কাল রপ্তানি বাণিজ্য চলতে পারে না। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই রপ্তানিকে এগিয়ে নিতে হবে। এখন রপ্তানিতে বহুমুখীকরণের ওপর জোর দিতে হবে। এক যুগ আগে দেশের মোট পণ্য রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের হিস্যা ছিল ৭৮ শতাংশ। গত বছর সেটি বেড়ে ৮২ শতাংশে উঠেছে। অন্যদিকে পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল এবং হিমায়িত খাদ্যের হিস্যা কমেছে। আবার পাট ও পাটজাত পণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি হিস্যা বাড়লেও তা খুবই সামান্য।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ লিড টাইম। এটি যতটা কমিয়ে আনা যাবে পোশাক খাত ততই টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি পণ্য আরো দ্রুত ডেলিভারি করতে হবে। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যক্রম আরো সহজ এবং স্বচ্ছ হতে হবে। এছাড়া ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা আছে, সেগুলো দূর করা গেলে পোশাক খাতে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি সম্ভব হবে। দুর্নীতি, আমলাতন্ত্র, সুশাসনের অভাবও লিড টাইম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত একজন ব্যাংকার হিসেবে লক্ষ করেছি যে, বর্তমানে বিদেশ থেকে পাঠানো আমদানি ডকুমেন্টের ভুলত্রুটি বা ডিসক্রিপেন্সি খুব একটা পাওয়া যায় না। কিছু নামকরা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো ডকুমেন্টে কোনো ত্রুটিই খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের প্রায় ৯০ শতাংশ ডকুমেন্টই ত্রুটিপূর্ণ বা ডিসক্রিপেন্ট, যা মূল্য প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করে। রপ্তানিকারকদেরকে ত্রুটিমুক্ত ডকুমেন্ট প্রস্তুতের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিভিন্ন পণ্যে মেধাস্বত্বের জন্য মূল্য পরিশোধ এবং আইনকানুনে শৃঙ্খলা আনতে হবে। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিভিন্ন সক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা এবং অংশীদারত্ব বাড়াতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে। বিশ্বের যেসব দেশ পণ্য রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে পেরেছে, তারা প্রত্যেকেই বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে করেছে। আমাদেরও সেই পথেই যেতে হবে। কারণ, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে আসে। ফলে তারা পণ্য রপ্তানিতে ভালো দাম পায়। মূলত এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রণোদনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটা সবাইকে মেনে নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি হিসেবে সরকার ধাপে ধাপে নগদ প্রণোদনা কমানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি ঠিকই আছে বলা যায়। বাংলাদেশ আজীবন হতদরিদ্র দেশের তালিকায় থাকবেÑ এটা প্রত্যাশা করা যায় না। দেশ ও জাতির উন্নয়ন ও মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে নগদ সহায়তা স্থায়ীভাবে রহিত করা হলে রপ্তানি খাতে খানিটা চ্যালেঞ্জ আসবে এটা সত্য। তবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য রপ্তানিকারকদেরকে সাহস ও সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।