০৬:৫৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

টাকা তোলার ছক কষছে চাঁদাবাজরা

ঈদ চাঁদাবাজি

 

■ফুটপাত-গণপরিবহনে টার্গেট শতকোটি টাকা
■ সক্রিয় ৭০টি গ্রুপের ৫০০ লাইনম্যান
■সরকারি বিভিন্ন সেবা সংস্থাও মাঠে
■চাঁদাবাজিতে নেমেছে হিজড়ারাও

 

 

রাজধানীর ব্যস্ততম ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ফুটপাতগুলো ফের দখল হয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কঠোর হুঁশিয়ারির পরও ফুটপাত হকারমুক্ত হয়নি। আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ফুটপাত ও গণপরিবহন সেক্টরের চাঁদাবাজরা। এরই মধ্যে টাকা তোলার ছক কষছে সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজরা। ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় এবার শতকোটি টাকা চাঁদাবাজির টার্গেট নিয়ে রাজধানীজুড়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে অন্তত ৭০টি গ্রুপ। মাঠপর্যায়ে টাকা আদায়ে তৎপর রয়েছে সংঘবদ্ধ এসব চাঁদাবাজ গ্রুপের ৫ শতাধিক লাইনম্যান। এরা ক্ষমতাসীন দলের লেবাসে পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে একের পর এক ফুটপাত দখল করে কোটি কোটি টাকা আদায় করছে। ঈদ চাঁদাবাজিতে পিছিয়ে নেই তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী হিজরা ও মাঠপর্যায়ের পুলিশ-আনসার সদস্যসহ বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির নেতারাও। এরই মধ্যে এককালীন টাকা নিয়ে ফুটপাতে দোকান বসিয়ে ভাড়া দিয়েছে সংঘবদ্ধ এসব চাঁদাবাজ চক্র। এদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও আইনের ফাঁক গলিয়ে ফের ফুটপাত দখলসহ চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ছে। মাঝেমধ্যেই হকার উচ্ছেদ হলেও টাকার বিনিময়ে ফের একই স্থানে পসরা সাজাচ্ছেন হকাররা। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো রমজানের শুরুতেই রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম এলাকার ফুটপাত ও পরিবহন স্ট্যান্ড দখলে নিয়েছে ওই চক্রটি। প্রতিটি এলাকায় দৈনিক চাঁদার হার বেড়েছে কয়েকগুণ। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাত, সরকারি খাস জমি ও মালিকানা জমিতে মেলার নামে নতুন নতুন দোকান বসিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে দুই সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসন বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও অদ্যাবধি কোনো সুফল পায়নি নগরবাসী। এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে প্রায়ই অভিযান চালানো হয়। তবে পুলিশসহ যে কারো বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে চাঁদাবাজদের ধরতে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোয় গোয়েন্দা নজরদারিও চলছে।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টের ফুটপাত থেকে ৫ শতাধিক ব্যক্তি নিয়মিত চাঁদার টাকা তুলছে। এদের নিয়ন্ত্রণ করছে সংশ্লিষ্ট এলাকার ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় রাজনৈতিক নেতা, সন্ত্রাসী-ফিটিংপার্টিসহ অর্ধশত ব্যক্তি। প্রতিটি এলাকায়ই পুলিশের নামেও তোলা হচ্ছে বখরা। ফুটপাতে আগে থেকে ব্যবসা করে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলেছেন, রমজান শুরুর আগ থেকেই মৌসুমি হকারের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজরা তাদের ওপর চাঁদার পরিমাণ বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। কয়েকটি এলাকায় ব্যবসায়ীদের কাছে সন্ত্রাসীদের নামেও চাঁদা চাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মাঝেমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে চাঁদাবাজদের কেউ কেউ ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক গলিয়ে জামিনে ছাড়া পেয়ে ফের জড়িয়ে পড়ছে চাঁদাবাজিতে। ফলে যথাযথ আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ফুটপাত দখলমুক্ত করতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চাঁদাবাজরা এলাকা ভেদে ২০০ থেকে ৩০০ দোকানের একটি অংশকে নাম দিয়েছে ‘ফুট’। চক্রাকারে ফুটের হকারদের কাছ থেকে দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদার টাকা নিচ্ছে চাঁদাবাজ গ্রুপের নিয়োজিত লাইনম্যানরা। তাদের কাছ থেকে টাকা বুঝে নিচ্ছেন প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার মনোনীত সর্দার। লাইনম্যানের উত্তোলিত টাকার সিংহভাগই যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় কতিপয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও মাস্তান বাহিনীর পকেটে। আর সর্দারদের কাছে পৌঁছানো টাকার ৭৫ শতাংশ পাচ্ছেন অসাধু ওই পুলিশ-আনসার সদস্যরা। দোকানগুলোয় অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত বিদ্যুৎ বিভাগের এবং সিটি কর্পোরেশনের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটেও যাচ্ছে লাইনম্যান ও সর্দারের উত্তোলিত টাকার একটি অংশ। রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকার হকার ও গণপরিবহন শ্রমিকরা বলেছেন, লাইনম্যানদের দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদা পরিশোধ করে দোকান ও পরিবহন চালাতে হয়। চাঁদার রেট কম হলেই উচ্ছেদসহ বিভিন্ন হুমকি দেওয়া হয়। ভেঙে দেওয়া হয় দোকানপাট, বন্ধ করে দেওয়া হয় পরিবহন চলাচল। জানা গেছে, শুধু ফুটপাতের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে এমন গডফাদার গুলিস্তানে ৪, মতিঝিলে ৩, সদরঘাটে ৩, নিউ মার্কেটে ২৫, ফার্মগেটে ৩, মিরপুর-১ নম্বরে ২, মিরপুর-১০ নম্বরে ২, উত্তরায় ২, বাড্ডায় ২, কুড়িলে ২, কামরাঙ্গীরচরে ৯, লালবাগ বেড়িবাঁধে ৭, বংশাল-কোতোয়ালীতে ৬ জন রয়েছে। অন্যরা রয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। প্রতিদিন ফুটপাত ও গণপরিবহন স্ট্যান্ড থেকে চাঁদা তুলছে ৭০টি চাঁদাবাজ গ্রুপের নিয়োজিত ৫ শতাধিক লাইনম্যান।

 

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ধানমন্ডি হকার্স ও গাউছিয়া মার্কেটের একাধিক ব্যবসায়ী ও হকাররা জানান, ঢাকা কলেজের সাউথ ব্লকের ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে দুটি হল রয়েছে। সেগুলো হলোÑ সাউথ হল ও সাউদার্ন হল। নর্থ ব্লকের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পাঁচটি হল। এগুলো হলো-নর্থ হল, শহীদ ফরহাদ হোসেন মাস্টার্স হল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস হল, ওয়েস্ট হল এবং আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস। ফুটপাতের নিয়ন্ত্রণে এসব হলের কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতার নাম জানিয়েছেন হকার, লাইনম্যান ও স্থানীয়রা। ছাত্রলীগের ওই নেতারা হলেন-নর্থ ব্লকের জসীম, এসএম শফিক, মাছুম, জনি, তামিম ও বিল¬ালসহ কয়েকজন। সাউথ ব্লকের ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে রয়েছেন-মৃদুল, রাশেদ, নিপু, ইমরান ও কাওসারসহ কয়েকজন।

 

ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণে থাকা নেতাদের থেকে ফুটপাত নিজেদের কব্জায় নিতে সম্প্রতি সাউথ হলে ছাত্রলীগের বিক্ষুব্ধ অংশের একটি বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, চাঁদার ভাগ না দিলে মৃদুলকে কলেজ থেকে মেরে বের করে দেওয়া হবে। ১২ মার্চ রাতে ঢাকা কলেজসংলগ্ন সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (টিটিসি) ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এই ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা গুরুতর আহত হয়ে ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। টিটিসির সংঘর্ষের এই ঘটনায় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের এক নেতার ইন্ধন ছিল। ছাত্রলীগের অন্তত চারজন নেতা জানিয়েছেন, এই সংঘর্ষের নেপথ্যেও অন্যতম কারণ ছিল স্থানীয় চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ। ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। এ ধরনের কাজে ছাত্রলীগের কারও জড়িত থাকার কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই। ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে কেউ চাঁদাবাজি করলে তাদের বিরুদ্ধে কলেজ প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করছি।

 

এদিকে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের বাইরে এই এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রক হিসাবে আলোচিত নিউমার্কেট থানা আওয়ামী লীগের ১৮নং ওয়ার্ডের সাবেক নেতা ইব্রাহিম হোসেন ইবু ও কাজি আনিস। স্থানীয় হকাররা জানান, ফুটপাতের ব্যবসা থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তারা। চাঁদাবাজদের তালিকায় তাদের নামও রয়েছে। হকারদের ভাষ্য অনুযায়ী, নিউ মাকেট থানা আওয়ামী লীগ নেতা হানিফ মিয়া সোলেমান আক্তার মনু মিয়া এবং লিটন ফুটপাত নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হোতা। তাদের ইশারাতেই চলে ফুটপাতের সব কার্যক্রম। এদের প্রত্যেকেই একসময় সামান্য আয়ের মানুষ ছিলেন। ফুটপাতের কল্যাণে এখন তাদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ এবং আলিশান জীবন-যাপন। এছাড়া ফুটপাতের নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় নেতা সাত্তার মোল্লা, উজ্জ্বল, মামুন, বিল্লাল, বাচ্চু, রাহাত, ইসমাইল, টুন্ডা আমির ঝালাই জাহাঙ্গীর, মতি শিকদার, আকবর, আমিনুল, সেলিম ও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কথিত নেতা সম্রাট, ইমরান, শাফিন খান, মতিন ও শাহিনের নামও উঠে আসে হকারদের মুখে। এসব বিষয়ে জানতে চেয়ে গতকাল শনিবার রাতে মুঠোফোনে অভিযুক্তদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ফোন রিসিভ না করায় তাদের কারো কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশ জানিয়েছে, তাদের বিষয়ে থানায় সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হকাররা জানান, মিরপুর রোডের ধানমন্ডি ও নিউ মার্কেট অংশে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কিছু ক্যাডার ফুটপাতসহ মার্কেটের ফাঁকা জায়গায় দোকান বসিয়ে নিয়মিত চাঁদা তোলে। ছাত্রদের উৎপাত সারাবছর তো থাকেই, তবুও ঈদ এলে ছাত্রধারী এসব ক্যাডাররা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে লাভ নেই। বরং হয়রানি নির্যাতনের শিকার হতে হয়। গুলিস্তান হকার্স, গাউছিয়া, নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত, খিলগাঁও তালতলা, মিরপুর শাহ আলী, ১ নম্বর, গুলশান-১ ও ২, মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা সুপার, মুক্তবাংলা, উত্তরা ও পুরান ঢাকার ফুটপাত ব্যবসায়ীরাও একই রকম তথ্য জানান ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও হকাররা। এদিকে কামরাঙ্গীরচর রসুলপুর ব্রিজ মার্কেট ও পূর্ব রসুলপুর এলাকায় হাঁটাচলার পথে বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে ডালা ও ভ্যানগাড়িতে দোকান বসিয়ে ভাড়া দিয়েছে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা পরিচয়দানকারী জাবেদুল ইসলাম জাবেদ ওরফে সমিতি জাবেদ, মফিজ, খোকন, কামাল, অহিদুল, বাবু, হানিফ, সিদ্দিক, বাদশা, মঞ্জু, ফিরোজ, লালচাঁন সুমন, মাসুদ, মামুন, মুসা, ইমন ও শাকিল। এরই মধ্যে দোকান প্রতি ৫ লাখ টাকা করে আদায় করেছে মৌসুমি এসব চাঁদাবাজগ্রুপ। এদিকে লালবাগের নবাবগঞ্জ বেড়িবাঁধে গত মঙ্গলবার হলিডে মার্কেটের অন্তত ২ হাজার ফুট দোকান থেকে দোকানপ্রতি গড়ে ৫০০ টাকা করে প্রতি সপ্তাহে ১০ লাখ টাকা চাঁদা তোলেন শাসক দলের নেতা পরিচয়দানকারী হাফেজ সুমন, জাকির, শাহীন ওরফে অটোশাহীন, বারেক, সেলিম, বিপ্লব ও মোকলেস। এছাড়া চোরাই মোবাইল মার্কেট ও ভান্ডারি ফেরদৌসসহ কয়েকটি গ্যারেজ থেকে লাইনম্যানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ দৈনিক ৫০০ টাকা হারে মাসিক ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা চাঁদা গ্রহণ করেন। এছাড়া বংশাল ও কোতোয়ালীতে মেহেদীর নেতৃত্বে ফুটপাতের ৫ হাজার দোকান থেকে দৈনিক ১২০ টাকা হারে প্রতিদিন চাঁদা তুলছে লাইনম্যান মিরাজ, জসিম, আলম ও ইউনুস। চাঁদার ভাগ পাচ্ছেন থানা-ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা। জানা গেছে, নীলক্ষেত এলাকায় বিজিবি ১ নম্বর গেট-নিউমার্কেট রুটে অন্তত ২০টি লেগুনা চলাচল করে প্রতিদিন। এসব লেগুনা থেকে লেগুনাপ্রতি ৪শ টাকা হারে চাঁদা তোলেন তিনলাইন সুমনসহ কয়েকজন। চকবাজার-নিউমার্কেট রুটে চলাচলকারী প্রতিটি লেগুনা থেকে প্রতিদিন সিটি করপোরেশনের নামে ৭০ টাকা করে এবং ৪০০ টাকা করে চাঁদা তোলেন লাইনম্যান শাহীন ও বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর। এই চাঁদার টাকার ভাগ পান মৃধা মানিক, ট্যাগরা রফিক, কামাল, ক্যাপ রফিক ও টাকলা রুহুল। মিরপুর রোডে নিউমার্কেটের নীলক্ষেত মোড় থেকে সাইন্সল্যাবরেটরি মোড় ও পুরাতন এলফ্যিান্ট রোডে পুটপাতে হকার বসিয়ে প্রতি দোকান থেকে গড়ে ৩০০ টাকা করে চাঁদা তোলেন স্থানীয় চাঁদাবাজচক্র। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হকাররা জানিয়েছেন, বলাকা সিনেমা হলের সামনে সেলিম, ব্রীজের গোল চত্তরে রয়েছেন জালাই জাহাঙ্গীর, আক্তার, মরা সিরাজ, আকবর, ইদ্রিস মোল্লা নিউ মার্কেট ৪ নং গেইটের সামনে কাজী আনিছ, ব্রিজের নিচে দুলাল, ইব্রাহিম হোসেন ইবুর ভাই নুর ইসলাম, মতিন মোল্লা ও আকবর ফুটপাতে দোকান বসিয়েছেন। নিয়মিত চাঁদা দিয়েই এসব এলাকায় ব্যবসা করছেন তারা। এছাড়া প্লেন মসজিদের সামনে হইতে বাটা সিগনাল মোড় পর্যন্ত প্রায় শতাধিক দোকান বসিয়েছেন মেডিকেল স্টাফ কোয়াটারের ইসমাইল সে স্থানীয় থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. হানিফ মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক সোলেমান আক্তার মনু মিয়ার ক্ষমতার বলে দোকানগুলো বসিয়ে চাঁদাবাজি করে যাচ্ছেন। কিছু হলেই আওয়ামী লীগ নেতা ও স্থানীয় থানার ক্ষমতার বলে সাধারণ মানুষকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করেন। এদিকে আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ এলাকার ফুটপাতের ১৮৬টি দোকান ও অটোরিকশা স্ট্যান্ডে সাড়ে ২২ লাখ টাকার চাঁদাবাজির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক, মতিউর রহমান জামালসহ ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে বন্ধ করে দেওয়া হয় দোকানপাট। তবে লালবাগ থানার ওসি হেলাল উদ্দিন জানান, পথচারী ও যানবাহন চলাচল নির্বিঘ্ন করতে হকার তুলে দেওয়া হয়। এবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর হুঁশিয়ারির কারণে এরই মধ্যে ফুটপাত ও গণপরিবহন সেক্টর থেকে ছক কষে কৌশলে প্রতিদিনই লাখ লাখ টাকা চাঁদা তুলছেন সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজরা।

 

বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আবুল কাশেম জানান, রাজধানীতে ১ লাখ ১০ হাজারের মতো হকার রয়েছে। ফুটপাতের দোকানের পজেশন ও পরিধি বুঝে প্রতিদিন দোকান প্রতি ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। রমজান শুরুর পর কয়েকদিনের মধ্যেই ধাপে ধাপে এ চাঁদার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ২০ রমজানের পর থেকে চাঁদরাত পর্যন্ত চাঁদাবাজির এমন অরাজকতা চলবে। চাহিদার টাকা বুঝে পেয়ে চাঁদাবাজরা নানা কৌশলে প্রতিদিনই তাদের মনমতো মৌসুমি হকারও বসাচ্ছেন। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলেই বাধে বিপত্তি। এভাবে হকারদের কাছ থেকে সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ চক্রগুলো কেবল রমজান মাসজুড়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হাতিয়ে নেবে অন্তত কয়েক কোটি টাকা। চাঁদাবাজ দমন করে এ টাকা যদি সরকার নিত, তাহলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় হতো। তিনি আরো বলেন, পুলিশ কয়েক দফায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। জামিনে বেরিয়ে এসে তারা ফের চাঁদাবাজি শুরু করেছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন যদি প্রকৃত হকারদের কাছে ফুটপাত ইজারা দিতো তাহলে এমন অবস্থা হতো না। এতে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি হকাররাও শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবসা করতে পারবেন। হকার্স ফেডারেশনের নেতা আবুল কাশেম জানান, রাস্তা দখল করে ফুটপাত বসিয়ে চাঁদাবাজির বিষয়ে বহুবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। মামলাও করা হয়েছে। কাজ হয়নি। উল্টো অভিযোগের বিষয় ফাঁস হলেই লাইনম্যানরা সন্ত্রাসী দিয়ে তাদের হকার উচ্ছেদ বা মালামাল লুট করত। বাধা দিলে মারধরের শিকারও হতে হয়। ঢাকার ২ সিটি করপোরেশন চাইলে প্রকৃত হকারদের কাছে ফুটপাত ইজারা দিতে পারে। এদিকে সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত রমজান ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত এক সভায় পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন চাঁদাবাজদের উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ফুটপাত ও পণ্যপরিবহনসহ প্রত্যেক সেক্টরে কোনো ধরনের চাঁদাবাজি বরদাশত করা হবে না। কারো বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন আইজিপি। অপরদিকে সম্প্রতি সেতু মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, চাঁদাবাজি একেবারে বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। এজন্য পুলিশ প্রশাসন কাজ করছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

জামালপুর-টাঙ্গাইল আঞ্চলিক প্রেসক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত

টাকা তোলার ছক কষছে চাঁদাবাজরা

আপডেট সময় : ০৪:৪৩:৩২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ মার্চ ২০২৪

 

■ফুটপাত-গণপরিবহনে টার্গেট শতকোটি টাকা
■ সক্রিয় ৭০টি গ্রুপের ৫০০ লাইনম্যান
■সরকারি বিভিন্ন সেবা সংস্থাও মাঠে
■চাঁদাবাজিতে নেমেছে হিজড়ারাও

 

 

রাজধানীর ব্যস্ততম ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ফুটপাতগুলো ফের দখল হয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কঠোর হুঁশিয়ারির পরও ফুটপাত হকারমুক্ত হয়নি। আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ফুটপাত ও গণপরিবহন সেক্টরের চাঁদাবাজরা। এরই মধ্যে টাকা তোলার ছক কষছে সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজরা। ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় এবার শতকোটি টাকা চাঁদাবাজির টার্গেট নিয়ে রাজধানীজুড়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে অন্তত ৭০টি গ্রুপ। মাঠপর্যায়ে টাকা আদায়ে তৎপর রয়েছে সংঘবদ্ধ এসব চাঁদাবাজ গ্রুপের ৫ শতাধিক লাইনম্যান। এরা ক্ষমতাসীন দলের লেবাসে পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে একের পর এক ফুটপাত দখল করে কোটি কোটি টাকা আদায় করছে। ঈদ চাঁদাবাজিতে পিছিয়ে নেই তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী হিজরা ও মাঠপর্যায়ের পুলিশ-আনসার সদস্যসহ বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির নেতারাও। এরই মধ্যে এককালীন টাকা নিয়ে ফুটপাতে দোকান বসিয়ে ভাড়া দিয়েছে সংঘবদ্ধ এসব চাঁদাবাজ চক্র। এদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও আইনের ফাঁক গলিয়ে ফের ফুটপাত দখলসহ চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ছে। মাঝেমধ্যেই হকার উচ্ছেদ হলেও টাকার বিনিময়ে ফের একই স্থানে পসরা সাজাচ্ছেন হকাররা। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো রমজানের শুরুতেই রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম এলাকার ফুটপাত ও পরিবহন স্ট্যান্ড দখলে নিয়েছে ওই চক্রটি। প্রতিটি এলাকায় দৈনিক চাঁদার হার বেড়েছে কয়েকগুণ। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাত, সরকারি খাস জমি ও মালিকানা জমিতে মেলার নামে নতুন নতুন দোকান বসিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে দুই সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসন বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও অদ্যাবধি কোনো সুফল পায়নি নগরবাসী। এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে প্রায়ই অভিযান চালানো হয়। তবে পুলিশসহ যে কারো বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে চাঁদাবাজদের ধরতে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোয় গোয়েন্দা নজরদারিও চলছে।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টের ফুটপাত থেকে ৫ শতাধিক ব্যক্তি নিয়মিত চাঁদার টাকা তুলছে। এদের নিয়ন্ত্রণ করছে সংশ্লিষ্ট এলাকার ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় রাজনৈতিক নেতা, সন্ত্রাসী-ফিটিংপার্টিসহ অর্ধশত ব্যক্তি। প্রতিটি এলাকায়ই পুলিশের নামেও তোলা হচ্ছে বখরা। ফুটপাতে আগে থেকে ব্যবসা করে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলেছেন, রমজান শুরুর আগ থেকেই মৌসুমি হকারের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজরা তাদের ওপর চাঁদার পরিমাণ বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। কয়েকটি এলাকায় ব্যবসায়ীদের কাছে সন্ত্রাসীদের নামেও চাঁদা চাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মাঝেমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে চাঁদাবাজদের কেউ কেউ ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক গলিয়ে জামিনে ছাড়া পেয়ে ফের জড়িয়ে পড়ছে চাঁদাবাজিতে। ফলে যথাযথ আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ফুটপাত দখলমুক্ত করতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চাঁদাবাজরা এলাকা ভেদে ২০০ থেকে ৩০০ দোকানের একটি অংশকে নাম দিয়েছে ‘ফুট’। চক্রাকারে ফুটের হকারদের কাছ থেকে দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদার টাকা নিচ্ছে চাঁদাবাজ গ্রুপের নিয়োজিত লাইনম্যানরা। তাদের কাছ থেকে টাকা বুঝে নিচ্ছেন প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার মনোনীত সর্দার। লাইনম্যানের উত্তোলিত টাকার সিংহভাগই যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় কতিপয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও মাস্তান বাহিনীর পকেটে। আর সর্দারদের কাছে পৌঁছানো টাকার ৭৫ শতাংশ পাচ্ছেন অসাধু ওই পুলিশ-আনসার সদস্যরা। দোকানগুলোয় অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত বিদ্যুৎ বিভাগের এবং সিটি কর্পোরেশনের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটেও যাচ্ছে লাইনম্যান ও সর্দারের উত্তোলিত টাকার একটি অংশ। রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকার হকার ও গণপরিবহন শ্রমিকরা বলেছেন, লাইনম্যানদের দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদা পরিশোধ করে দোকান ও পরিবহন চালাতে হয়। চাঁদার রেট কম হলেই উচ্ছেদসহ বিভিন্ন হুমকি দেওয়া হয়। ভেঙে দেওয়া হয় দোকানপাট, বন্ধ করে দেওয়া হয় পরিবহন চলাচল। জানা গেছে, শুধু ফুটপাতের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে এমন গডফাদার গুলিস্তানে ৪, মতিঝিলে ৩, সদরঘাটে ৩, নিউ মার্কেটে ২৫, ফার্মগেটে ৩, মিরপুর-১ নম্বরে ২, মিরপুর-১০ নম্বরে ২, উত্তরায় ২, বাড্ডায় ২, কুড়িলে ২, কামরাঙ্গীরচরে ৯, লালবাগ বেড়িবাঁধে ৭, বংশাল-কোতোয়ালীতে ৬ জন রয়েছে। অন্যরা রয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। প্রতিদিন ফুটপাত ও গণপরিবহন স্ট্যান্ড থেকে চাঁদা তুলছে ৭০টি চাঁদাবাজ গ্রুপের নিয়োজিত ৫ শতাধিক লাইনম্যান।

 

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ধানমন্ডি হকার্স ও গাউছিয়া মার্কেটের একাধিক ব্যবসায়ী ও হকাররা জানান, ঢাকা কলেজের সাউথ ব্লকের ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে দুটি হল রয়েছে। সেগুলো হলোÑ সাউথ হল ও সাউদার্ন হল। নর্থ ব্লকের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পাঁচটি হল। এগুলো হলো-নর্থ হল, শহীদ ফরহাদ হোসেন মাস্টার্স হল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস হল, ওয়েস্ট হল এবং আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস। ফুটপাতের নিয়ন্ত্রণে এসব হলের কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতার নাম জানিয়েছেন হকার, লাইনম্যান ও স্থানীয়রা। ছাত্রলীগের ওই নেতারা হলেন-নর্থ ব্লকের জসীম, এসএম শফিক, মাছুম, জনি, তামিম ও বিল¬ালসহ কয়েকজন। সাউথ ব্লকের ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে রয়েছেন-মৃদুল, রাশেদ, নিপু, ইমরান ও কাওসারসহ কয়েকজন।

 

ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণে থাকা নেতাদের থেকে ফুটপাত নিজেদের কব্জায় নিতে সম্প্রতি সাউথ হলে ছাত্রলীগের বিক্ষুব্ধ অংশের একটি বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, চাঁদার ভাগ না দিলে মৃদুলকে কলেজ থেকে মেরে বের করে দেওয়া হবে। ১২ মার্চ রাতে ঢাকা কলেজসংলগ্ন সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (টিটিসি) ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এই ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা গুরুতর আহত হয়ে ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। টিটিসির সংঘর্ষের এই ঘটনায় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের এক নেতার ইন্ধন ছিল। ছাত্রলীগের অন্তত চারজন নেতা জানিয়েছেন, এই সংঘর্ষের নেপথ্যেও অন্যতম কারণ ছিল স্থানীয় চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ। ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। এ ধরনের কাজে ছাত্রলীগের কারও জড়িত থাকার কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই। ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে কেউ চাঁদাবাজি করলে তাদের বিরুদ্ধে কলেজ প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করছি।

 

এদিকে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের বাইরে এই এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রক হিসাবে আলোচিত নিউমার্কেট থানা আওয়ামী লীগের ১৮নং ওয়ার্ডের সাবেক নেতা ইব্রাহিম হোসেন ইবু ও কাজি আনিস। স্থানীয় হকাররা জানান, ফুটপাতের ব্যবসা থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তারা। চাঁদাবাজদের তালিকায় তাদের নামও রয়েছে। হকারদের ভাষ্য অনুযায়ী, নিউ মাকেট থানা আওয়ামী লীগ নেতা হানিফ মিয়া সোলেমান আক্তার মনু মিয়া এবং লিটন ফুটপাত নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হোতা। তাদের ইশারাতেই চলে ফুটপাতের সব কার্যক্রম। এদের প্রত্যেকেই একসময় সামান্য আয়ের মানুষ ছিলেন। ফুটপাতের কল্যাণে এখন তাদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ এবং আলিশান জীবন-যাপন। এছাড়া ফুটপাতের নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় নেতা সাত্তার মোল্লা, উজ্জ্বল, মামুন, বিল্লাল, বাচ্চু, রাহাত, ইসমাইল, টুন্ডা আমির ঝালাই জাহাঙ্গীর, মতি শিকদার, আকবর, আমিনুল, সেলিম ও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কথিত নেতা সম্রাট, ইমরান, শাফিন খান, মতিন ও শাহিনের নামও উঠে আসে হকারদের মুখে। এসব বিষয়ে জানতে চেয়ে গতকাল শনিবার রাতে মুঠোফোনে অভিযুক্তদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ফোন রিসিভ না করায় তাদের কারো কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশ জানিয়েছে, তাদের বিষয়ে থানায় সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হকাররা জানান, মিরপুর রোডের ধানমন্ডি ও নিউ মার্কেট অংশে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কিছু ক্যাডার ফুটপাতসহ মার্কেটের ফাঁকা জায়গায় দোকান বসিয়ে নিয়মিত চাঁদা তোলে। ছাত্রদের উৎপাত সারাবছর তো থাকেই, তবুও ঈদ এলে ছাত্রধারী এসব ক্যাডাররা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে লাভ নেই। বরং হয়রানি নির্যাতনের শিকার হতে হয়। গুলিস্তান হকার্স, গাউছিয়া, নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত, খিলগাঁও তালতলা, মিরপুর শাহ আলী, ১ নম্বর, গুলশান-১ ও ২, মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা সুপার, মুক্তবাংলা, উত্তরা ও পুরান ঢাকার ফুটপাত ব্যবসায়ীরাও একই রকম তথ্য জানান ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও হকাররা। এদিকে কামরাঙ্গীরচর রসুলপুর ব্রিজ মার্কেট ও পূর্ব রসুলপুর এলাকায় হাঁটাচলার পথে বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে ডালা ও ভ্যানগাড়িতে দোকান বসিয়ে ভাড়া দিয়েছে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা পরিচয়দানকারী জাবেদুল ইসলাম জাবেদ ওরফে সমিতি জাবেদ, মফিজ, খোকন, কামাল, অহিদুল, বাবু, হানিফ, সিদ্দিক, বাদশা, মঞ্জু, ফিরোজ, লালচাঁন সুমন, মাসুদ, মামুন, মুসা, ইমন ও শাকিল। এরই মধ্যে দোকান প্রতি ৫ লাখ টাকা করে আদায় করেছে মৌসুমি এসব চাঁদাবাজগ্রুপ। এদিকে লালবাগের নবাবগঞ্জ বেড়িবাঁধে গত মঙ্গলবার হলিডে মার্কেটের অন্তত ২ হাজার ফুট দোকান থেকে দোকানপ্রতি গড়ে ৫০০ টাকা করে প্রতি সপ্তাহে ১০ লাখ টাকা চাঁদা তোলেন শাসক দলের নেতা পরিচয়দানকারী হাফেজ সুমন, জাকির, শাহীন ওরফে অটোশাহীন, বারেক, সেলিম, বিপ্লব ও মোকলেস। এছাড়া চোরাই মোবাইল মার্কেট ও ভান্ডারি ফেরদৌসসহ কয়েকটি গ্যারেজ থেকে লাইনম্যানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ দৈনিক ৫০০ টাকা হারে মাসিক ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা চাঁদা গ্রহণ করেন। এছাড়া বংশাল ও কোতোয়ালীতে মেহেদীর নেতৃত্বে ফুটপাতের ৫ হাজার দোকান থেকে দৈনিক ১২০ টাকা হারে প্রতিদিন চাঁদা তুলছে লাইনম্যান মিরাজ, জসিম, আলম ও ইউনুস। চাঁদার ভাগ পাচ্ছেন থানা-ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা। জানা গেছে, নীলক্ষেত এলাকায় বিজিবি ১ নম্বর গেট-নিউমার্কেট রুটে অন্তত ২০টি লেগুনা চলাচল করে প্রতিদিন। এসব লেগুনা থেকে লেগুনাপ্রতি ৪শ টাকা হারে চাঁদা তোলেন তিনলাইন সুমনসহ কয়েকজন। চকবাজার-নিউমার্কেট রুটে চলাচলকারী প্রতিটি লেগুনা থেকে প্রতিদিন সিটি করপোরেশনের নামে ৭০ টাকা করে এবং ৪০০ টাকা করে চাঁদা তোলেন লাইনম্যান শাহীন ও বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর। এই চাঁদার টাকার ভাগ পান মৃধা মানিক, ট্যাগরা রফিক, কামাল, ক্যাপ রফিক ও টাকলা রুহুল। মিরপুর রোডে নিউমার্কেটের নীলক্ষেত মোড় থেকে সাইন্সল্যাবরেটরি মোড় ও পুরাতন এলফ্যিান্ট রোডে পুটপাতে হকার বসিয়ে প্রতি দোকান থেকে গড়ে ৩০০ টাকা করে চাঁদা তোলেন স্থানীয় চাঁদাবাজচক্র। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হকাররা জানিয়েছেন, বলাকা সিনেমা হলের সামনে সেলিম, ব্রীজের গোল চত্তরে রয়েছেন জালাই জাহাঙ্গীর, আক্তার, মরা সিরাজ, আকবর, ইদ্রিস মোল্লা নিউ মার্কেট ৪ নং গেইটের সামনে কাজী আনিছ, ব্রিজের নিচে দুলাল, ইব্রাহিম হোসেন ইবুর ভাই নুর ইসলাম, মতিন মোল্লা ও আকবর ফুটপাতে দোকান বসিয়েছেন। নিয়মিত চাঁদা দিয়েই এসব এলাকায় ব্যবসা করছেন তারা। এছাড়া প্লেন মসজিদের সামনে হইতে বাটা সিগনাল মোড় পর্যন্ত প্রায় শতাধিক দোকান বসিয়েছেন মেডিকেল স্টাফ কোয়াটারের ইসমাইল সে স্থানীয় থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. হানিফ মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক সোলেমান আক্তার মনু মিয়ার ক্ষমতার বলে দোকানগুলো বসিয়ে চাঁদাবাজি করে যাচ্ছেন। কিছু হলেই আওয়ামী লীগ নেতা ও স্থানীয় থানার ক্ষমতার বলে সাধারণ মানুষকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করেন। এদিকে আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ এলাকার ফুটপাতের ১৮৬টি দোকান ও অটোরিকশা স্ট্যান্ডে সাড়ে ২২ লাখ টাকার চাঁদাবাজির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক, মতিউর রহমান জামালসহ ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে বন্ধ করে দেওয়া হয় দোকানপাট। তবে লালবাগ থানার ওসি হেলাল উদ্দিন জানান, পথচারী ও যানবাহন চলাচল নির্বিঘ্ন করতে হকার তুলে দেওয়া হয়। এবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর হুঁশিয়ারির কারণে এরই মধ্যে ফুটপাত ও গণপরিবহন সেক্টর থেকে ছক কষে কৌশলে প্রতিদিনই লাখ লাখ টাকা চাঁদা তুলছেন সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজরা।

 

বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আবুল কাশেম জানান, রাজধানীতে ১ লাখ ১০ হাজারের মতো হকার রয়েছে। ফুটপাতের দোকানের পজেশন ও পরিধি বুঝে প্রতিদিন দোকান প্রতি ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। রমজান শুরুর পর কয়েকদিনের মধ্যেই ধাপে ধাপে এ চাঁদার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ২০ রমজানের পর থেকে চাঁদরাত পর্যন্ত চাঁদাবাজির এমন অরাজকতা চলবে। চাহিদার টাকা বুঝে পেয়ে চাঁদাবাজরা নানা কৌশলে প্রতিদিনই তাদের মনমতো মৌসুমি হকারও বসাচ্ছেন। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলেই বাধে বিপত্তি। এভাবে হকারদের কাছ থেকে সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ চক্রগুলো কেবল রমজান মাসজুড়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হাতিয়ে নেবে অন্তত কয়েক কোটি টাকা। চাঁদাবাজ দমন করে এ টাকা যদি সরকার নিত, তাহলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় হতো। তিনি আরো বলেন, পুলিশ কয়েক দফায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। জামিনে বেরিয়ে এসে তারা ফের চাঁদাবাজি শুরু করেছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন যদি প্রকৃত হকারদের কাছে ফুটপাত ইজারা দিতো তাহলে এমন অবস্থা হতো না। এতে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি হকাররাও শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবসা করতে পারবেন। হকার্স ফেডারেশনের নেতা আবুল কাশেম জানান, রাস্তা দখল করে ফুটপাত বসিয়ে চাঁদাবাজির বিষয়ে বহুবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। মামলাও করা হয়েছে। কাজ হয়নি। উল্টো অভিযোগের বিষয় ফাঁস হলেই লাইনম্যানরা সন্ত্রাসী দিয়ে তাদের হকার উচ্ছেদ বা মালামাল লুট করত। বাধা দিলে মারধরের শিকারও হতে হয়। ঢাকার ২ সিটি করপোরেশন চাইলে প্রকৃত হকারদের কাছে ফুটপাত ইজারা দিতে পারে। এদিকে সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত রমজান ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত এক সভায় পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন চাঁদাবাজদের উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ফুটপাত ও পণ্যপরিবহনসহ প্রত্যেক সেক্টরে কোনো ধরনের চাঁদাবাজি বরদাশত করা হবে না। কারো বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন আইজিপি। অপরদিকে সম্প্রতি সেতু মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, চাঁদাবাজি একেবারে বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। এজন্য পুলিশ প্রশাসন কাজ করছে।