➤ একদিনে ৫ জায়গায় আগুন
➤এক্স নিঃস্ব শত শত পরিবার
➤ বিল্ডিং কোড, ফায়ার সেফটি ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের তাগিদ
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিদিনই ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানী ঢাকার দুটি স্থানসহ সারা দেশে ৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুনের লেলিহান শিখায় কারো পুড়েছে স্বপ্ন, কারো পুড়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-শিল্প কারখানা। আগুনের ভয়াবহতায় নিঃস্ব হয়েছে শত শত পরিবার। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে আসবাবপত্র ও মুল্যবান সামগ্রী। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কোটি টাকার ওপরে। এরপরও পিছু ছাড়ছে না আগুনের ভয়াবহতা। আবাসিক ভবন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে নেই পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তামূলক কোনো ব্যবস্থা। এর ফলে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। ব্যবসায়ী ও আবাসিক বাসিন্দাদের উদাসীনতায় ক্রমেই অগ্নিগর্ভে রূপ নিচ্ছে সারা দেশ। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের এক পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে সারা দেশে মোট ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গড়ে প্রতিদিন ৭৭টি আগুন লেগেছে। এসব ঘটনায় সারা দেশে মোট ২৮১ জন আহত এবং ১০২ জন নিহত হয়েছেন। এতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৭৯২ কোটি ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ১৪ টাকা মূল্যের সম্পদ।
অগ্নিনিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, অভিজাত এলাকার শিক্ষিত মানুষ যেখানে উদাসীন, সেখানে বস্তিবাসী তো আরো উদাসীন। আইন না মানার কারণেই দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ, ফায়ার সেফটি ও প্রতিমাসে একবার করে অগ্নিনির্বাপক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতকাল রোববার বিকাল ৪টা ৫ মিনিটের দিকে বনানীর করাইল বস্তি সংলগ্ন গোডাউন বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়লে দাউ দাউ করে জ¦লতে থাকে বস্তির একেকটি বসতঘর। এসময় আতঙ্কিত বস্তির বাসিন্দারা এক কাপড়ে রাস্তায় নেমে হাউমাউ করে চিৎকার করতে থাকেন। তাদের চোখের সামনেই পুড়ে যায় স্বপ্নের সাজানো সংসারের মূল্যবান আসবাবপত্রসহ দুই শতাধিক ঘর। নিঃস্ব হয়ে পড়েন এসব পরিবার। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ইফতারি করেন অনেকেই। খবর পেয়ে ফায়ার সার্র্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বিভিন্ন স্টেশন থেকে পর্যায়ক্রমে ১০টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে টানা দেড়ঘণ্টার চেষ্টায় বিকাল ৫টা ৩৩ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেন, আগুন লাগার খবর পেয়ে বিকাল ৪টা ২৯ মিনিটের দিকে ফায়ার সার্ভিসের বারিধারা, তেজগাঁও, কুর্মিটোলা, সিদ্দিকবাজার, মিরপুর ও উত্তরা ফায়ার স্টেশনের মোট ১০টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে অংশগ্রহণ করে। সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটের দিকে আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ করা হয়। তবে এতে কোনো হতাহত না হলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা। এর কিছুক্ষণ পরই বাংলা একাডেমিতে আগুন লাগার খবর পাওয়া যায়। তবে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য জানানো হয়নি।
এর আগে গত শনিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভুলতা গাউছিয়া কাঁচাবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে ভোর ৫টা ৪৫ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে শতাধিক দোকান পুড়ে গেছে। তাৎক্ষণিক আগুন লাগার কারণ ও কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক ফখরুদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে কাঞ্চন, আড়াইহাজার, ডেমরা ও পূর্বাচলের মোট ৪টি স্টেশনের ১০টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রায় পৌনে ৩ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
এদিকে গতকাল রোববার দুপুরের দিকে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় টিকে গ্রুপের এসএফএলএল নামের একটি বোর্ড কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের মোট ১২টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালায়। সাড়ে ৩টার চেষ্টায়ও আগুন নেভানো সম্ভব হয়নি। তবে ফায়ার সার্ভিসের ফায়ার ফাইটাররা প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টার চেষ্টায় রাতে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার ফারুক। এ ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও কোনো হতাহতের খবর জানাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।
গজারিয়া ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার রিফাত মল্লিক বলেন, কারখানাটিতে হার্ডবোর্ড জাতীয় বিভিন্ন বোর্ড তৈরি হয়। এতে আগুনের তীব্রতা বেড়ে যায়। যার ফলে আগুন নেভাতে বেশ বেগ পেতে হয়।
এর আগে গতকাল রোববার সকাল ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রাম এলাকায় ২টি পাটের গুদাম ও ১টি তেলের মিলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকালে প্রথমে তেলের মিল থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। মিলের বৈদ্যুতিক মিটারে বিকট শব্দ সৃষ্টি হলে ঘরটিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে পাশের দুটি পাটের গুদামে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন। এক পর্যায়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। পাবনা ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক জাহিদ হোসেন জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কিছুটা বেগ পতে হয়েছে। আগুনে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা এখনও বলা যাচ্ছে না।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩ সালে সারা দেশে মোট ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গড়ে প্রতিদিন ৭৭টি আগুন লেগেছে। এসব ঘটনায় সারা দেশে মোট ২৮১ জন আহত এবং ১০২ জন নিহত হয়েছেন। এতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৭৯২ কোটি ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ১৪ টাকা মূল্যের সম্পদ। ২০২৩ সালে তারা সারা দেশে ৫ হাজার ৩৭৪টি ভবন পরিদর্শন করে। এর মধ্যে ২ হাজার ১১৮টি ভবনে ঝুঁঁকি খুঁজে পায়। ৪২৪টি ভবনকে অতি ঝুঁঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তারা।
এদিকে অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এবং মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আগুন লাগার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে উদাসীনতা। অসচেতনতা ও অসাবধানতার কারণেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক ভবন ও গোডাউনে অগ্নিকাণ্ড বেড়েই চলছে। তিনি বলেন, অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে যেসব বিধিবিধান রয়েছে, তা না মানার প্রবণতা আমাদের মাঝে বেশি থাকায় এমন অনাকাক্সিক্ষত অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের বারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার বলেন, অভিজাত এলাকার শিক্ষিত মানুষই অগ্নিনিরাপত্তায় করণীয় আইনগুলো যথাযথভাবে পালন করছেন না। তাদের মধ্যে এক ধরনের উদাসীনতা রয়েছে। এই উদাসীনতা ও অসাবধানতাই ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে। দেশের প্রতিটি আবাসিক ভবন ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মেনে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ও সিঁড়িতে জনগণের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত করতে হবে। শ্রেণিভেদে ভবন নির্মাণের পর ফায়ার সার্ভিস থেকে নিরাপত্তামূলক সেফটি সার্টিফিকেট গ্রহণ করে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রাংশ বা সরঞ্জাম সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে ভবনে বসবাসরত জনবলের ১৮ শতাংশ মানুষকে প্রতি মাসে অন্তত একবার করে হলেও অগ্নিনির্বাপক সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। বস্তিতে আগুন লাগার পেছনে সবচেয়ে বড় উদাসীনাতাকেই দায়ী করেছেন মো. শাহজাহান শিকদার। তিনি বলেন, অভিজাত এলাকার শিক্ষিত মানুষ যেখানে উদাসীন, অশিক্ষিত বস্তিবাসীরা আরও উদাসীন। তারা মূলত যত্রতত্র আগুন ধরিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সারেন। আবার সিগারেটের শেষাংশ যেখানে সেখানে ফেলে রাখা, অনিরাপদ স্থানে কয়েল জ¦ালানো ত্রুটিযুক্ত বৈদ্যুতিক ক্যাবল ও গ্যাস লাইনের ব্যবহারের কারণে বস্তিতে বেশি আগুন লাগে। আগুনের ভয়াবহতা থেকে পরিত্রাণ পেতে দেশের সব শ্রেণিপেশার মানুষকে সচেতন হতে হবে। বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও ভবনের ভেতর মানুষ চলাচলের সিঁড়িসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ এবং পর্যাপ্ত খোলা জায়গা রাখতে হবে। তবেই অগ্নিদুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব বা কমে আসবে বলে জানান মো. শাহজাহান শিকদার।






















