►যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করছে সন্ত্রাসীরা
►আইএসআইয়ের বিরুদ্ধে বিচারপতিদের হুমকির অভিযোগ
সম্প্রতি পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা বেড়েছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটির শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর ওপরও হামলার পরিমাণ বেড়েছে। বিভিন্ন সময় এসব হামলার জন্য আফগানিস্তানের দিকেই আঙুল তুলেছে পাকিস্তান। আর এবার সরাসরি আফগানিস্তানকে ‘সন্ত্রাসের উৎস’ বলে অভিহিত করেছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। এমনকি সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটনে কোনো অগ্রগতি না করার জন্য আফগানিস্তানকে দোষারোপ করেছেন এবং পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদের হুমকি কমাতে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ আরো কঠোর করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে দুঃখ প্রকাশ করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, সন্ত্রাসী ঘটনা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্ত পরিস্থিতির মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন। পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদের উৎস আফগানিস্তানে এবং আমাদের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, কাবুল এই দিকে কোনো অগ্রগতি করছে না। তালেবান প্রশাসন সন্ত্রাসবাদের আস্তানা সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্বেও সন্ত্রাসীরা তাদের ভূখণ্ড থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবাধে তৎপরতা চালাচ্ছে। কাবুল থেকে (সন্ত্রাসবাদের হুমকি মোকাবিলায়) সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্য এমন এক সময়ে সামনে এলো যখন গত কয়েকদিন ধরে গোয়াদর বন্দর কমপ্লেক্স এবং তুরবাতে নৌ-ঘাঁটিতে হামলাসহ শাংলায় চীনা শ্রমিকদের বহনকারী গাড়িতে আত্মঘাতী হামলা হয়েছে। দ্য ডন বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের ডাকা বিশেষ নিরাপত্তা সভায় যোগদানের পর মন্ত্রী এসব মন্তব্য করেন।
এদিকে পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলায় বিদেশি অস্ত্র ব্যবহার করছে সন্ত্রাসীরা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অস্ত্র। গতকাল পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম জিও নিউজের এক প্রতিবেদনে এমন দাবি করা হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান ছাড়ার সময় মার্কিন বাহিনী যেসব অস্ত্র ফেলে গিয়েছিল, সেগুলো ব্যবহার করছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি), বালোচিস্তান লিবারেশন আর্মির মতো সংগঠনগুলো। পাকিস্তান আগেও অভিযোগ করেছিল, আফগানিস্তান থেকে তাড়াহুড়ো করে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে পড়ে। যদিও এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে পেন্টাগন। তবে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বাজেয়াপ্ত অস্ত্র-সরঞ্জামের বিবরণই ইঙ্গিত করছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পাকিস্তানের ভেতরে চালানো হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অস্ত্রই ব্যবহার করেছে সন্ত্রাসীরা।
নিরাপত্তা সূত্রের বরাতে জিও নিউজ জানিয়েছে, সম্প্রতি তুর্বতে হামলায় জড়িত সন্ত্রাসীরা একটি এম৩২ মাল্টি-শট গ্রেনেড লঞ্চার এবং এম১৬এ৪ অ্যাসল্ট রাইফেলের মতো মার্কিন অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। টিটিপি সদস্যরা এখনো পাকিস্তানে হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করছে। এই তথ্য মোটেও আশ্চর্যজনক নয়। কারণ পেন্টাগন নিজেই নিশ্চিত করেছিল, তারা আফগান বাহিনীকে যে ৪ লাখ ২৭ হাজার ৩০০টি অস্ত্র দিয়েছিল, তার মধ্যে প্রায় তিন লাখ অস্ত্রই আফগানিস্তানে রেখে যাওয়া হয়েছে। দুই দশকের মিশন শেষে ২০২১ সালের আগস্টে অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই আফগানিস্তান ছেড়েছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বাহিনী।
গত ২৭ জানুয়ারি উত্তর ওয়াজিরিস্তানে নায়েক মিনাল্লাহ নামে এক সন্ত্রাসীর কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল। এর আগে, ২২ জানুয়ারি ঝাবের সাম্বাজায় সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত জঙ্গিদের কাছ থেকে একই ধরনের অস্ত্র উদ্ধার করেছিল পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী। গত ১৯ জানুয়ারি পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে জঙ্গিদের কাছ থেকে জব্দ করা অস্ত্রগুলো ছিল বিদেশে তৈরি। তার আগে, গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর মীর আলীতে সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে গোলাবারুদসহ একে-৪৭ এবং এম৪ কার্বাইন অ্যাসল্ট রাইফেল উদ্ধার করেছিল নিরাপত্তা বাহিনী। একই মাসে (১২ ডিসেম্বর) ডেরা ইসমাইল খানের দারাবন এলাকায় হামলার সময় নাইট ভিশন গগলস এবং যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অ্যাসল্ট রাইফেল ব্যবহার করেছিল সন্ত্রাসীরা। গত ১৩ ডিসেম্বর আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে প্রবেশকারী একটি গাড়ি থেকে অত্যাধুনিক মার্কিন অস্ত্র উদ্ধার করেন কাস্টমস এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তারা। এর দুদিন পরেই উন্নত মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার করে পাকিস্তানের একটি ট্যাংকে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর এবং ৪ নভেম্বর যথাক্রমে চিত্রাল ও মিয়ানওয়ালি বিমানঘাঁটিতে দুটি পাকিস্তানি চেকপোস্টে আক্রমণের জন্য মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার করেছিল সন্ত্রাসীরা। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে ঝাব গ্যারিসন আক্রমণের সময়ও মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার করেছিল টিটিপি সদস্যরা।
অন্যদিকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পরিচালিত গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স বা আইএসআইয়ের বিরুদ্ধে বিচারপতি ও তাদের আত্মীয়দের অপহরণ-নির্যাতনের হুমকি এবং শয়নকক্ষের ভেতর গোপন ভিডিও নজরদারির ভয় দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। রাজধানী ইসলামাবাদ হাইকোর্টের (আইএইচসি) বিচারপতিরা চলতি সপ্তাহে প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো বিরল এক চিঠিতে এই অভিযোগ করেছেন। চিঠিতে আইএসআইকে ‘নির্দিষ্ট ফলাফলের জন্য’ বিচারিক কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করার জন্য দোষারোপ করা হয়েছে এবং এই সংকট নিরসনে প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে। ইসলামাবাদ হাইকোর্টের আটজন বিচারপতির ছয় জন চিঠিতিতে স্বাক্ষর করেছেন।
চিঠি পাওয়ার পর এ ইস্যুতে আলোচনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারপতির জরুরি বৈঠক ডেকেছেন প্রধান বিচারপতি কাজী ফয়েজ ইসা। এই চিঠিতে বেশ কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে আইএসআই কর্মকর্তারা জোর-জবরদস্তি ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ‘কারাবন্দী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মামলাসহ বিভিন্ন মামলার ফলাফল প্রভাবিত করার’ চেষ্টা করেছে। ইমরান খানের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে রাষ্ট্র-সমর্থিত একটি মামলার কথা উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, আইএসআইর অপারেটিভরা বিচারকদের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করেছিল। বিচারকরা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার আশঙ্কা থেকে তাদের বাড়ির জন্য অতিরিক্ত সুরক্ষা চেয়েছিলেন। চিঠিটি পাকিস্তানের বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অভিযোগের ফলে আইনজীবীদের সংগঠন, ইমরান খানের বিরোধী দল পিটিআই এবং স্বাধীন সমালোচকরা একটি স্বাধীন তদন্ত এবং জড়িতদের বিচারের আহ্বান জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে বিচার বিভাগের কাজে আইএসআই কর্মীদের হস্তক্ষেপের অভিযোগ প্রকাশ্যে আনতে তারা বিচারকদের প্রশংসাও করেছেন।


























