০৮:২২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মিষ্টি আলুই চরে কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসি

এক সময় চরের বালুময় পরিত্যক্ত জমিতে যেখানে অন্য ফসল ফলানো প্রায় অসম্ভব ছিল। সেই সব জমিতে শাকালু অর্থাৎ মিষ্টি আলুর চাষ করে ভাগ্য বদল করেন কৃষকরা। মাত্র এক দশকের মধ্যেই নিজেদের প্রচেষ্টায় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বাঙালী নদীর রাখালবুরুজ, মহিমাগঞ্জ ও সাঘাটা উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের আংশিক এলাকায় এক সময়ের দুঃখের চর নামে বিস্তীর্ণ এলাকার জমিগুলো এখন সুখের চর। দুঃখের চরে কৃষকের মুখে ফুটেছে সুখের হাসি। মিষ্টি আলু বা শাকালু তিন মাসে ফলন যোগ্য একটি ফসলই বদলে দিয়েছে তাদের ভাগ্য। একই মৌসুমে একই ক্ষেতে আর প্রায় একই খরচে দুইবার মিষ্টি আলু চাষ করে সাড়া ফেলেছেন চরের চাষিরা।
কৃষি জমির বহুমুখী ব্যবহার করে উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের চরবালুয়া, বালুয়া তালপট্টি, বোচাদহ, রাখালবুরুজ ইউনিয়নের পারসোনাইডাঙা ও পার্শ্ববর্তী সাঘাটা উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের রামনগর ও কচুয়ার চরে চলতি মৌসুমে নতুন পদ্ধতিতে মিষ্টি আলু চাষ হয়েছে ১৫০ বিঘার বেশি জমিতে। কোন প্রকার সরকারি সহায়তা বা পরামর্শ ছাড়াই নিজেদের উদ্ভাবিত চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করে মিষ্টি আলু চাষে দ্বিগুণ লাভের স্বপ্ন দেখছেন তারা। ফলে এক সময়ের অবহেলিত চরটিতে এখন বছরে চারটি ফসল চাষ শুরু হয়েছে। গোবিন্দগঞ্জের দুই ইউনিয়ন ও সাঘাটা উপজেলার একটি ইউনিয়নের ত্রি-মোহনায় বাঙালী নদীর পাঁচশত বিঘা জমি নিয়ে চর বালুয়া। চরের জমি যেন সোনা ফলানোর এক উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
নদী ভাঙ্গনের অভিশাপ এখন আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। বন্যা আর ভাঙ্গনে দুঃখের চর এখন সুখের চর হয়েছে মানুষের কাছে। উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের চরবালুয়া এখন সুখের চর হিসেবে পরিচিত। মিষ্টি আলু চাষই বদলে দিয়েছে তাদের দিন। জাপানে রপ্তানির পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রয়ের বাজার সৃষ্টি হয়েছে এখানে উৎপাদিত মিষ্টি আলুর। চলতি মৌসুমে এই চরে প্রথম দফা উৎপাদিত আলু বিক্রয় হয়েছে দুকোটি টাকারও বেশি। গত বছর এলাকায় আলেছ উদ্দিন নামে এক চাষির উদ্যোগে জমি থেকে আলু তোলার সাথে সাথেই ফেলে দেয়া আলুর লতা রোপণ করে নতুন পদ্ধতির আলুর চাষ শুরু হয়। এক বিঘা জমিতে নতুন পদ্ধতির চাষে তিনি দ্বিগুণ ফসল ঘরে তোলেন।
এই পদ্ধতি অনুসরণ করে চলতি মৌসুমে চরে প্রায় দেড়শত বিঘা জমিতে দ্বিতীয়বার আলু রোপণ করেন চাষিরা। চাষিরা বলেন, কার্তিক মাসের শুরুতেই মিষ্টি আলুর চারা রোপণ করে ৯০ দিন পর অর্থাৎ পৌষ-মাঘ মাসের মধ্যে আলু আহরণ ও বিক্রয় করে। এরপর ওই জমিতে আলু সংগ্রহের সাথে সাথেই আলগা মাটি সমান করে আলুর লতা রোপণ করা হয়। কোন আয়াস ছাড়াই এই আলু বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে সংগ্রহ করা হবে। এর ফলে প্রায় বিনা খরচে প্রথম দফার কাছাকাছি পরিমাণ বাড়তি আলু পাওয়ার আশা করছে তারা। দ্বিতীয় দফার এই আলু ঘরে তোলার পর ওই জমিতে তারা রোপণ করবেন বর্ষালি নামে একটি হাইব্রিড জাতের ধান অথবা ভুট্টা। আশ্বিন-কার্তিক মাসে ধান কাটার পর আবার চাষ করবেন আলু, পেঁয়াজ, মরিচ, ভুট্টাসহ বিভিন্ন রবি শস্য। চলতি মৌসুমে ওই চরে খায়রুল আলম রাজা, আলেছ উদ্দিন, হবিবর রহমান, মোনারুল ইসলাম, মজিবর রহমান, ফেরদৌস, আলম মিয়া ও ছাইদুর রহমানসহ প্রায় ৫০ জন চাষি একই জমিতে দ্বিতীয় দফায় মিষ্টি আলু চাষ করেছেন। বর্তমানে মিষ্টি আলুর সবুজ পাতায় ঢেকে গেছে চরের বিস্তীর্ণ এলাকা।
আর সারা বছর ধরে কৃষিকাজ থাকায় কৃষি শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদার কারণে শ্রমিকরাও পেয়েছেন সুখের নাগাল। প্রথম দফায় ১৪ বিঘা আর দ্বিতীয় দফায় ১০ বিঘা জমিতে মিষ্টি আলুর চাষ করেন চর বালুয়া গ্রামের খায়রুল আলম রাজা। তিনি বলেন, আগাম চাষ করা জমিতে উৎপাদিত আলু তুলেই নতুন করে দ্বিতীয় দফায় আলু লাগাতে হয়। আগামী বছর আমার অধিকাংশ জমিতেই আগাম আলুর চাষ করবো। প্রথম দফায় প্রতি শতাংশ জমির উৎপাদিত মিষ্টি আলু বিক্রয় হয়েছে গড়ে দুই হাজার টাকা। দ্বিতীয় দফায় গড়ে দেড় হাজার টাকার আলু বিক্রয় হলেও তা দাঁড়াবে সাড়ে তিন হাজার বা তারও বেশি। এতে বিঘা প্রতি মিষ্টি আলু বিক্রয় দাঁড়াচ্ছে কমপক্ষে সোয়া লক্ষ টাকা। বালুয়া গ্রামের মিষ্টি আলুর ব্যবসায়ী আলম মিয়া বলেন, চরে উৎপাদিত মিষ্টি আলু চাষিদের কাছ থেকে ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরহ করা হয়। এতে আমার মতো আরও অনেকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। চরের উৎপাদিত মিষ্টি আলু দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। কৃষি বিভাগের সহায়তা ও পরামর্শ পেলে বেশি ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, বাঙালী নদীর চরের চাষিরা কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন। জমি পতিত অবস্থায় পড়ে থাকে না। তাদের কৃষি বিষয়ক সার্বিক সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
জনপ্রিয় সংবাদ

স্মৃতিসৌধে তারেক রহমান

মিষ্টি আলুই চরে কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসি

আপডেট সময় : ০৫:৩৬:৫৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩০ মার্চ ২০২৪
এক সময় চরের বালুময় পরিত্যক্ত জমিতে যেখানে অন্য ফসল ফলানো প্রায় অসম্ভব ছিল। সেই সব জমিতে শাকালু অর্থাৎ মিষ্টি আলুর চাষ করে ভাগ্য বদল করেন কৃষকরা। মাত্র এক দশকের মধ্যেই নিজেদের প্রচেষ্টায় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বাঙালী নদীর রাখালবুরুজ, মহিমাগঞ্জ ও সাঘাটা উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের আংশিক এলাকায় এক সময়ের দুঃখের চর নামে বিস্তীর্ণ এলাকার জমিগুলো এখন সুখের চর। দুঃখের চরে কৃষকের মুখে ফুটেছে সুখের হাসি। মিষ্টি আলু বা শাকালু তিন মাসে ফলন যোগ্য একটি ফসলই বদলে দিয়েছে তাদের ভাগ্য। একই মৌসুমে একই ক্ষেতে আর প্রায় একই খরচে দুইবার মিষ্টি আলু চাষ করে সাড়া ফেলেছেন চরের চাষিরা।
কৃষি জমির বহুমুখী ব্যবহার করে উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের চরবালুয়া, বালুয়া তালপট্টি, বোচাদহ, রাখালবুরুজ ইউনিয়নের পারসোনাইডাঙা ও পার্শ্ববর্তী সাঘাটা উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের রামনগর ও কচুয়ার চরে চলতি মৌসুমে নতুন পদ্ধতিতে মিষ্টি আলু চাষ হয়েছে ১৫০ বিঘার বেশি জমিতে। কোন প্রকার সরকারি সহায়তা বা পরামর্শ ছাড়াই নিজেদের উদ্ভাবিত চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করে মিষ্টি আলু চাষে দ্বিগুণ লাভের স্বপ্ন দেখছেন তারা। ফলে এক সময়ের অবহেলিত চরটিতে এখন বছরে চারটি ফসল চাষ শুরু হয়েছে। গোবিন্দগঞ্জের দুই ইউনিয়ন ও সাঘাটা উপজেলার একটি ইউনিয়নের ত্রি-মোহনায় বাঙালী নদীর পাঁচশত বিঘা জমি নিয়ে চর বালুয়া। চরের জমি যেন সোনা ফলানোর এক উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
নদী ভাঙ্গনের অভিশাপ এখন আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। বন্যা আর ভাঙ্গনে দুঃখের চর এখন সুখের চর হয়েছে মানুষের কাছে। উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের চরবালুয়া এখন সুখের চর হিসেবে পরিচিত। মিষ্টি আলু চাষই বদলে দিয়েছে তাদের দিন। জাপানে রপ্তানির পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রয়ের বাজার সৃষ্টি হয়েছে এখানে উৎপাদিত মিষ্টি আলুর। চলতি মৌসুমে এই চরে প্রথম দফা উৎপাদিত আলু বিক্রয় হয়েছে দুকোটি টাকারও বেশি। গত বছর এলাকায় আলেছ উদ্দিন নামে এক চাষির উদ্যোগে জমি থেকে আলু তোলার সাথে সাথেই ফেলে দেয়া আলুর লতা রোপণ করে নতুন পদ্ধতির আলুর চাষ শুরু হয়। এক বিঘা জমিতে নতুন পদ্ধতির চাষে তিনি দ্বিগুণ ফসল ঘরে তোলেন।
এই পদ্ধতি অনুসরণ করে চলতি মৌসুমে চরে প্রায় দেড়শত বিঘা জমিতে দ্বিতীয়বার আলু রোপণ করেন চাষিরা। চাষিরা বলেন, কার্তিক মাসের শুরুতেই মিষ্টি আলুর চারা রোপণ করে ৯০ দিন পর অর্থাৎ পৌষ-মাঘ মাসের মধ্যে আলু আহরণ ও বিক্রয় করে। এরপর ওই জমিতে আলু সংগ্রহের সাথে সাথেই আলগা মাটি সমান করে আলুর লতা রোপণ করা হয়। কোন আয়াস ছাড়াই এই আলু বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে সংগ্রহ করা হবে। এর ফলে প্রায় বিনা খরচে প্রথম দফার কাছাকাছি পরিমাণ বাড়তি আলু পাওয়ার আশা করছে তারা। দ্বিতীয় দফার এই আলু ঘরে তোলার পর ওই জমিতে তারা রোপণ করবেন বর্ষালি নামে একটি হাইব্রিড জাতের ধান অথবা ভুট্টা। আশ্বিন-কার্তিক মাসে ধান কাটার পর আবার চাষ করবেন আলু, পেঁয়াজ, মরিচ, ভুট্টাসহ বিভিন্ন রবি শস্য। চলতি মৌসুমে ওই চরে খায়রুল আলম রাজা, আলেছ উদ্দিন, হবিবর রহমান, মোনারুল ইসলাম, মজিবর রহমান, ফেরদৌস, আলম মিয়া ও ছাইদুর রহমানসহ প্রায় ৫০ জন চাষি একই জমিতে দ্বিতীয় দফায় মিষ্টি আলু চাষ করেছেন। বর্তমানে মিষ্টি আলুর সবুজ পাতায় ঢেকে গেছে চরের বিস্তীর্ণ এলাকা।
আর সারা বছর ধরে কৃষিকাজ থাকায় কৃষি শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদার কারণে শ্রমিকরাও পেয়েছেন সুখের নাগাল। প্রথম দফায় ১৪ বিঘা আর দ্বিতীয় দফায় ১০ বিঘা জমিতে মিষ্টি আলুর চাষ করেন চর বালুয়া গ্রামের খায়রুল আলম রাজা। তিনি বলেন, আগাম চাষ করা জমিতে উৎপাদিত আলু তুলেই নতুন করে দ্বিতীয় দফায় আলু লাগাতে হয়। আগামী বছর আমার অধিকাংশ জমিতেই আগাম আলুর চাষ করবো। প্রথম দফায় প্রতি শতাংশ জমির উৎপাদিত মিষ্টি আলু বিক্রয় হয়েছে গড়ে দুই হাজার টাকা। দ্বিতীয় দফায় গড়ে দেড় হাজার টাকার আলু বিক্রয় হলেও তা দাঁড়াবে সাড়ে তিন হাজার বা তারও বেশি। এতে বিঘা প্রতি মিষ্টি আলু বিক্রয় দাঁড়াচ্ছে কমপক্ষে সোয়া লক্ষ টাকা। বালুয়া গ্রামের মিষ্টি আলুর ব্যবসায়ী আলম মিয়া বলেন, চরে উৎপাদিত মিষ্টি আলু চাষিদের কাছ থেকে ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরহ করা হয়। এতে আমার মতো আরও অনেকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। চরের উৎপাদিত মিষ্টি আলু দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। কৃষি বিভাগের সহায়তা ও পরামর্শ পেলে বেশি ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, বাঙালী নদীর চরের চাষিরা কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন। জমি পতিত অবস্থায় পড়ে থাকে না। তাদের কৃষি বিষয়ক সার্বিক সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।