০৫:৩৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দেশে দেশে ঈদ সংস্কৃতি

আদিল মাহমুদ

ঈদ অর্থ আনন্দ, ঈদ অর্থ খুশি, ঈদ অর্থ উৎসব। এই আনন্দ, খুশি, উৎসব উদযাপনের ব্যাপারটা যেন একেবারেই নিজের পছন্দমতো হতে হয়। কেউ এক কাপ চা পেয়ে খুশি, তো কেউ খুশি গাড়ি-বাড়ি পেয়ে, কেউ খুশিতে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে যায়, তো কেউ আবেগের আতিশায্যে একদম চুপ করে বসে থাকে। যে যেভাবেই আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করুক না কেন, ঈদে খুশির ছটা লেগে থাকে সবার চোখে-মুখে।

ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুটিকে ঈদ বলা হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরত করার পর থেকে ঈদের প্রচলন শুরু হয়। নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরত করার পর দেখলেন, মদিনাবাসী আগে থেকেই দুটি উৎসব পালন করেন, যা ছিল মূলত ইহুদিদের উৎসব। কিন্তু মুসলামনদের কোনো উৎসব না থাকায় তারাও না বুঝে সেই উৎসব পালন করতেন। উৎসব দুটির একটি ছিল ‘নওরোজ’ ও অপরটি ‘মেহেরজান’।


নবি কারিমের (সা.) আগমনের পর সাহাবায়ে কেরামরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তখন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নবিজি (সা.) তাদের জানিয়ে দিলেন যে, আল্লাহ তোমাদের জন্য নওরোজ ও মেহেরজানের পরিবর্তে আরো উৎকৃষ্টতর দুটি দিন দান করেছেন। একটি হলো ঈদুল ফিতর এবং অপরটি ঈদুল আজহা।

ঈদ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ ও আধ্যাত্মিক সুষমামণ্ডিত উৎসব। পৃথিবীর সব মুসলিম কিংবা অমুসলিম দেশেও বেশ আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে পালন করা হয় ঈদের এ খুশির দিনটি। তবে যেকোনো উৎসবের সঙ্গেই মিশে থাকে প্রতিটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান। ঈদও তার ব্যতিক্রম নয়।

বাংলাদেশে যেমন মিষ্টি, সেমাই, পোলাও, কোরমা ছাড়া ঈদ জমে না, ঠিক তেমনিভাবে প্রত্যেকটা দেশে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির খাবার ছাড়া ঈদ জমে না। চলুন একটু জেনে নেই পৃথিবীর সব মুসলিম, অমুসলিম দেশগুলোতে কীভাবে ঈদের আনন্দ উদযাপন করা হয়।

সৌদি আরব : আল্লাহর ঘর, মুসলমানদের কেবলা, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মভূমি, শতভাগ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ সৌদি আরবে মানুষ মানুষের মধ্যকার সৌহার্দ, সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও খুব আন্তরিক উপায়ে ঈদ পালন করা হয়। বাড়ির সামনে কম্বল বিছিয়ে বসে সবাই তাদের রান্না করে। খাবার তাদের প্রতিবেশী কিংবা পথচারীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খায়। শহরজুড়ে শিশুদের বিনোদনের জন্য আতশবাজির খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। খুব একটা খরচাপাতি না করেও যে একটি উৎসব সবার মন ছুঁয়ে যেতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মেলে সৌদি আরবে।

মিসর : মিসর মানব সভ্যতার ইতিহাসের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী দেশ ও একটি আধুনিক রাষ্ট্র। মিসরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। মিসরে ঈদ উদযাপন করা হয় অত্যন্ত আনন্দ ও উৎসবমুখর পরিবেশে। মিসরে ঈদ পালন করা হয় টানা চার দিনব্যাপী। আর এই পুরো সময়টাজুড়ে উৎসবের প্রাণ হয়ে থাকে মজাদার সব মাছের আয়োজন।

পিরামিডের শহর মিসরের অন্যতম একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো ফাতা যা ভাত, গোশত, পেঁয়াজ, ভিনেগার সবকিছুর মিশ্রণে রান্না করা হয়। ফাতার পাশাপাশি কাহক নামের আরেকটি দারুণ জনপ্রিয় কুকি বা বিস্কুট ছাড়াও মিসরীয়দের ঈদ একেবারেই জমে না।

তুরস্ক : তুরস্ক বিশ্ব মুসলমানদের ইতিহাসে অত্যন্ত পরিচিত, সমৃদ্ধ এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। ঈদকে তুরস্কে ‘সেকের বায়রামি’ বলে। এই দিনটিকে তারা উৎসর্গ করে বহুবিধ ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্নের নামে। বাচ্চারা প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে যায় আর ভালোবাসা ও আশীর্বাদের নিদর্শনস্বরূপ তাদের পাতে তুলে দেয়া হয় টার্কিশ ডিলাইট এবং বাকলাভার মতো মজাদার সব খাবার।

 

সংযুক্ত আরব আমিরাত : সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঈদ মানে হাজারো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চমৎকার সব নাটক বা শো এবং অভাবনীয় অফারের ছড়াছড়ি। রণ-পা, নৃত্যশিল্পী, ভাঁড়, জাদুকর, বেলুনওয়ালা দিয়ে ভরে যায় এখানকার রাস্তাগুলো। লোকে লোকারণ্য থিম পার্ক আর সার্কাস দেখে বোঝা যায় জাঁকজমকপূর্ণ ঈদ আয়োজন কাকে বলে! সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিটি রাস্তা তার সৌন্দর্যের পসরা খুলে বসে পরিবারে প্রতিটি সদস্যের জন্য।

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে, বিশেষত ব্রুনাই, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালন করা হয় ঈদের দিনটি। মূলত যেকোনো অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ হলো সুস্বাদু মজাদার সব খাবার। কোন দেশের খাবারের মেন্যু কি তা জেনেই অনেক সময় সেখানকার উৎসব পালনের ঘটা টের পাওয়া যায়। আর এদিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো বেশ খানিকটা এগিয়ে আছে। এখানকার খাবারের মেন্যুতে গোশতের উপস্থিতি বেশ লক্ষ্যণীয়। কয়েক ধরনের গোশতের তরকারি, ডামপ্লিং, কেটুপাত বা ডোডোল জাতীয় মিষ্টান্ন, বাঁশে রান্না করা ভাত লেমাং- এই সবকিছুর মধ্যেই মিশে আছে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর ঈদ।

ইরাক : ইরাক বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা মেসোপটেমিয়ার জন্য সারা বিশ্বের বুকে গৌরবে মহীয়ান। রমজান এবং ঈদের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি উৎসবে ইরাকিরা বেশি গুরুত্ব দেয় খেজুরের ওপর। ক্লাইচা নামের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার ইরাকে খুব প্রচলিত যা না থাকলে ইরাকিদের যেকোনো অনুষ্ঠান অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।

ক্লাইচা মূলত এক ধরনের কুকি যা বাদাম, খেজুর এবং গুলকন্দ দিয়ে বানানো হয়। যেহেতু এতে খেজুর রয়েছে, ঈদুল ফিতরে ইরাকিদের কাছে এর মহিমা কতটা বেশি হতে পারে তা বলাই বাহুল্য।


আফগানিস্তান : আফগানিস্তানে অন্যান্য দেশগুলো থেকে একটু ভিন্নভাবে ঈদ উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। আফগানিস্তানে ঈদ উৎসব পালনের জন্য ডিম যুদ্ধের আয়োজন করা হয়। পুরুষদের জন্য খোলা কোনো ময়দানে ঈদের দিন ডিম যুদ্ধের আয়োজন করা হয়। সেখানে তারা পরস্পরের দিকে সেদ্ধ করা ডিম ছুড়ে মারে।

আজারবাইজান : মুসলিম অধ্যুষিত দেশ আজারবাইজানে মাহে রমজান এবং রমজান পরবর্তী ঈদুল ফিতর খুবই সম্মান এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়। পরিবারগুলো পরস্পর মিষ্টি এবং অন্যান্য উপহারসামগ্রী বিনিময় করে। এই দিনে সবাই কোলাকুলি করে ঈদের খুশি ভাগ করে নেয়। ঈদের নামাজের পর পরিবারের সদস্যদের কবর জিয়ারত করে তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে তারা। আজারবাইজানের দুই দিনব্যাপী আয়োজিত ঈদ উৎসবের প্রায় পুরোটাকেই ঘিরে থাকে সেখানকার মসজিদগুলো।

চীন : ১৩৮ কোটি জনসংখ্যাবিশিষ্ট এই দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্র। চীনের সাম্যবাদী দল দেশটি শাসন করে। ঈদ উপলক্ষে চীনের মুসলিম এবং অমুসলিম উভয়ের জন্যই ২-৩ দিনের সরকারি ছুটির ব্যবস্থা করা হয়। সকাল বেলা ঈদের নামাজ শেষে চাইনিজ মুসলিমরা পূর্বপুরুষদের স্মৃতি রোমন্থন করে দরিদ্রদের মধ্যে খাবার বিলি করে। তাছাড়া সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় নিহতদের জন্য বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থাও করা হয় এই দিনটিতে।

যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা : অমুসলিম রাষ্ট্র হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার পরিবেশ মুসলমানদের অনুকূলে নয়। কিন্তু এসব দেশে ঈদের নামাজ আদায় করা হয় ইসলামি কেন্দ্র, খোলা মাঠ বা কনভেনশন হল অথবা মসজিদে। বিভিন্ন দেশের লাখ লাখ মুসলিম তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী পোশাক পরিধান করে ঈদগাহে একত্রিত হয়। বাচ্চাদের মধ্যে উপহার বিতরণ করা হয় এবং শুধু এই দিনটিকে মাথায় রেখে বেশ কিছু দারুণ স্পাইসি খাবার রান্না করা হয়। মুসলিমরা স্থানীয় দরিদ্র লোকজনদের মাঝে খাবার বা অর্থ বিলি করে ঈদের খুশিতে তাদেরও শামিল করে নেয়।

ভারত : দূর-দূরান্ত ঘুরে এবার তাকানো যাক ঘরের পাশে, মানে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে। আমাদের মতোই ঈদের আগের রাতকে তারাও ‘চাঁদ রাত’ হিসেবে পালন করে। মেয়েরা দুই হাত ভরে মেহেদি লাগিয়ে বরণ করে নেয় ঈদের চাঁদকে। ঈদের নামাজের পর সালামি নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায় বাচ্চাদের মধ্যে। ভারতীয়দের কাছে ঈদ মানে যেন সেভিয়া খাওয়ার বাহানা, এই মিষ্টিটি ছাড়াও নানা পদের কাবাব, নেহারি, হালিমসহ হরেক রকমের মুখরোচক খাবারে সরগরম হয়ে থাকে ভারতের প্রতিটি ঘর।

আরেকটি কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। নতুন সিনেমা মুক্তি না পেলে ভারতীয়দের কাছে ঈদই যেন পানসে মনে হয়। তাই তো প্রতি বছর কয়েকশ কোটি টাকার বলিউড সিনেমা নির্মিত হয় শুধু ঈদকে সামনে রেখে।

মোটকথা : ঈদ মুসলমানদের মধ্যে ধনী-দরিদ্র, বর্ণ-গোত্র, ভাষা, ভৌগোলিক অবস্থানগত পার্থক্য ও উঁচু-নিচুর ভেদাভেদের ভুলিয়ে দিয়ে ঈদের নামাজের জামাতে সমস্ত মুসলমানদেরকে এক কাতারে শামিল করে।

মুসলিম মেমো অবলম্বনে

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

সভ্য ও মার্জিত সমাজ গঠনে সুশিক্ষিত জাতি গড়ে তুলতে হবে- মোতাহার হোসেন পাটওয়ারী

দেশে দেশে ঈদ সংস্কৃতি

আপডেট সময় : ০৮:৩৪:৫৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৫ এপ্রিল ২০২৪

আদিল মাহমুদ

ঈদ অর্থ আনন্দ, ঈদ অর্থ খুশি, ঈদ অর্থ উৎসব। এই আনন্দ, খুশি, উৎসব উদযাপনের ব্যাপারটা যেন একেবারেই নিজের পছন্দমতো হতে হয়। কেউ এক কাপ চা পেয়ে খুশি, তো কেউ খুশি গাড়ি-বাড়ি পেয়ে, কেউ খুশিতে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে যায়, তো কেউ আবেগের আতিশায্যে একদম চুপ করে বসে থাকে। যে যেভাবেই আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করুক না কেন, ঈদে খুশির ছটা লেগে থাকে সবার চোখে-মুখে।

ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুটিকে ঈদ বলা হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরত করার পর থেকে ঈদের প্রচলন শুরু হয়। নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরত করার পর দেখলেন, মদিনাবাসী আগে থেকেই দুটি উৎসব পালন করেন, যা ছিল মূলত ইহুদিদের উৎসব। কিন্তু মুসলামনদের কোনো উৎসব না থাকায় তারাও না বুঝে সেই উৎসব পালন করতেন। উৎসব দুটির একটি ছিল ‘নওরোজ’ ও অপরটি ‘মেহেরজান’।


নবি কারিমের (সা.) আগমনের পর সাহাবায়ে কেরামরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তখন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নবিজি (সা.) তাদের জানিয়ে দিলেন যে, আল্লাহ তোমাদের জন্য নওরোজ ও মেহেরজানের পরিবর্তে আরো উৎকৃষ্টতর দুটি দিন দান করেছেন। একটি হলো ঈদুল ফিতর এবং অপরটি ঈদুল আজহা।

ঈদ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ ও আধ্যাত্মিক সুষমামণ্ডিত উৎসব। পৃথিবীর সব মুসলিম কিংবা অমুসলিম দেশেও বেশ আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে পালন করা হয় ঈদের এ খুশির দিনটি। তবে যেকোনো উৎসবের সঙ্গেই মিশে থাকে প্রতিটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান। ঈদও তার ব্যতিক্রম নয়।

বাংলাদেশে যেমন মিষ্টি, সেমাই, পোলাও, কোরমা ছাড়া ঈদ জমে না, ঠিক তেমনিভাবে প্রত্যেকটা দেশে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির খাবার ছাড়া ঈদ জমে না। চলুন একটু জেনে নেই পৃথিবীর সব মুসলিম, অমুসলিম দেশগুলোতে কীভাবে ঈদের আনন্দ উদযাপন করা হয়।

সৌদি আরব : আল্লাহর ঘর, মুসলমানদের কেবলা, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মভূমি, শতভাগ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ সৌদি আরবে মানুষ মানুষের মধ্যকার সৌহার্দ, সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও খুব আন্তরিক উপায়ে ঈদ পালন করা হয়। বাড়ির সামনে কম্বল বিছিয়ে বসে সবাই তাদের রান্না করে। খাবার তাদের প্রতিবেশী কিংবা পথচারীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খায়। শহরজুড়ে শিশুদের বিনোদনের জন্য আতশবাজির খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। খুব একটা খরচাপাতি না করেও যে একটি উৎসব সবার মন ছুঁয়ে যেতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মেলে সৌদি আরবে।

মিসর : মিসর মানব সভ্যতার ইতিহাসের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী দেশ ও একটি আধুনিক রাষ্ট্র। মিসরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। মিসরে ঈদ উদযাপন করা হয় অত্যন্ত আনন্দ ও উৎসবমুখর পরিবেশে। মিসরে ঈদ পালন করা হয় টানা চার দিনব্যাপী। আর এই পুরো সময়টাজুড়ে উৎসবের প্রাণ হয়ে থাকে মজাদার সব মাছের আয়োজন।

পিরামিডের শহর মিসরের অন্যতম একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো ফাতা যা ভাত, গোশত, পেঁয়াজ, ভিনেগার সবকিছুর মিশ্রণে রান্না করা হয়। ফাতার পাশাপাশি কাহক নামের আরেকটি দারুণ জনপ্রিয় কুকি বা বিস্কুট ছাড়াও মিসরীয়দের ঈদ একেবারেই জমে না।

তুরস্ক : তুরস্ক বিশ্ব মুসলমানদের ইতিহাসে অত্যন্ত পরিচিত, সমৃদ্ধ এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। ঈদকে তুরস্কে ‘সেকের বায়রামি’ বলে। এই দিনটিকে তারা উৎসর্গ করে বহুবিধ ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্নের নামে। বাচ্চারা প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে যায় আর ভালোবাসা ও আশীর্বাদের নিদর্শনস্বরূপ তাদের পাতে তুলে দেয়া হয় টার্কিশ ডিলাইট এবং বাকলাভার মতো মজাদার সব খাবার।

 

সংযুক্ত আরব আমিরাত : সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঈদ মানে হাজারো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চমৎকার সব নাটক বা শো এবং অভাবনীয় অফারের ছড়াছড়ি। রণ-পা, নৃত্যশিল্পী, ভাঁড়, জাদুকর, বেলুনওয়ালা দিয়ে ভরে যায় এখানকার রাস্তাগুলো। লোকে লোকারণ্য থিম পার্ক আর সার্কাস দেখে বোঝা যায় জাঁকজমকপূর্ণ ঈদ আয়োজন কাকে বলে! সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিটি রাস্তা তার সৌন্দর্যের পসরা খুলে বসে পরিবারে প্রতিটি সদস্যের জন্য।

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে, বিশেষত ব্রুনাই, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালন করা হয় ঈদের দিনটি। মূলত যেকোনো অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ হলো সুস্বাদু মজাদার সব খাবার। কোন দেশের খাবারের মেন্যু কি তা জেনেই অনেক সময় সেখানকার উৎসব পালনের ঘটা টের পাওয়া যায়। আর এদিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো বেশ খানিকটা এগিয়ে আছে। এখানকার খাবারের মেন্যুতে গোশতের উপস্থিতি বেশ লক্ষ্যণীয়। কয়েক ধরনের গোশতের তরকারি, ডামপ্লিং, কেটুপাত বা ডোডোল জাতীয় মিষ্টান্ন, বাঁশে রান্না করা ভাত লেমাং- এই সবকিছুর মধ্যেই মিশে আছে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর ঈদ।

ইরাক : ইরাক বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা মেসোপটেমিয়ার জন্য সারা বিশ্বের বুকে গৌরবে মহীয়ান। রমজান এবং ঈদের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি উৎসবে ইরাকিরা বেশি গুরুত্ব দেয় খেজুরের ওপর। ক্লাইচা নামের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার ইরাকে খুব প্রচলিত যা না থাকলে ইরাকিদের যেকোনো অনুষ্ঠান অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।

ক্লাইচা মূলত এক ধরনের কুকি যা বাদাম, খেজুর এবং গুলকন্দ দিয়ে বানানো হয়। যেহেতু এতে খেজুর রয়েছে, ঈদুল ফিতরে ইরাকিদের কাছে এর মহিমা কতটা বেশি হতে পারে তা বলাই বাহুল্য।


আফগানিস্তান : আফগানিস্তানে অন্যান্য দেশগুলো থেকে একটু ভিন্নভাবে ঈদ উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। আফগানিস্তানে ঈদ উৎসব পালনের জন্য ডিম যুদ্ধের আয়োজন করা হয়। পুরুষদের জন্য খোলা কোনো ময়দানে ঈদের দিন ডিম যুদ্ধের আয়োজন করা হয়। সেখানে তারা পরস্পরের দিকে সেদ্ধ করা ডিম ছুড়ে মারে।

আজারবাইজান : মুসলিম অধ্যুষিত দেশ আজারবাইজানে মাহে রমজান এবং রমজান পরবর্তী ঈদুল ফিতর খুবই সম্মান এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়। পরিবারগুলো পরস্পর মিষ্টি এবং অন্যান্য উপহারসামগ্রী বিনিময় করে। এই দিনে সবাই কোলাকুলি করে ঈদের খুশি ভাগ করে নেয়। ঈদের নামাজের পর পরিবারের সদস্যদের কবর জিয়ারত করে তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে তারা। আজারবাইজানের দুই দিনব্যাপী আয়োজিত ঈদ উৎসবের প্রায় পুরোটাকেই ঘিরে থাকে সেখানকার মসজিদগুলো।

চীন : ১৩৮ কোটি জনসংখ্যাবিশিষ্ট এই দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্র। চীনের সাম্যবাদী দল দেশটি শাসন করে। ঈদ উপলক্ষে চীনের মুসলিম এবং অমুসলিম উভয়ের জন্যই ২-৩ দিনের সরকারি ছুটির ব্যবস্থা করা হয়। সকাল বেলা ঈদের নামাজ শেষে চাইনিজ মুসলিমরা পূর্বপুরুষদের স্মৃতি রোমন্থন করে দরিদ্রদের মধ্যে খাবার বিলি করে। তাছাড়া সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় নিহতদের জন্য বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থাও করা হয় এই দিনটিতে।

যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা : অমুসলিম রাষ্ট্র হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার পরিবেশ মুসলমানদের অনুকূলে নয়। কিন্তু এসব দেশে ঈদের নামাজ আদায় করা হয় ইসলামি কেন্দ্র, খোলা মাঠ বা কনভেনশন হল অথবা মসজিদে। বিভিন্ন দেশের লাখ লাখ মুসলিম তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী পোশাক পরিধান করে ঈদগাহে একত্রিত হয়। বাচ্চাদের মধ্যে উপহার বিতরণ করা হয় এবং শুধু এই দিনটিকে মাথায় রেখে বেশ কিছু দারুণ স্পাইসি খাবার রান্না করা হয়। মুসলিমরা স্থানীয় দরিদ্র লোকজনদের মাঝে খাবার বা অর্থ বিলি করে ঈদের খুশিতে তাদেরও শামিল করে নেয়।

ভারত : দূর-দূরান্ত ঘুরে এবার তাকানো যাক ঘরের পাশে, মানে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে। আমাদের মতোই ঈদের আগের রাতকে তারাও ‘চাঁদ রাত’ হিসেবে পালন করে। মেয়েরা দুই হাত ভরে মেহেদি লাগিয়ে বরণ করে নেয় ঈদের চাঁদকে। ঈদের নামাজের পর সালামি নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায় বাচ্চাদের মধ্যে। ভারতীয়দের কাছে ঈদ মানে যেন সেভিয়া খাওয়ার বাহানা, এই মিষ্টিটি ছাড়াও নানা পদের কাবাব, নেহারি, হালিমসহ হরেক রকমের মুখরোচক খাবারে সরগরম হয়ে থাকে ভারতের প্রতিটি ঘর।

আরেকটি কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। নতুন সিনেমা মুক্তি না পেলে ভারতীয়দের কাছে ঈদই যেন পানসে মনে হয়। তাই তো প্রতি বছর কয়েকশ কোটি টাকার বলিউড সিনেমা নির্মিত হয় শুধু ঈদকে সামনে রেখে।

মোটকথা : ঈদ মুসলমানদের মধ্যে ধনী-দরিদ্র, বর্ণ-গোত্র, ভাষা, ভৌগোলিক অবস্থানগত পার্থক্য ও উঁচু-নিচুর ভেদাভেদের ভুলিয়ে দিয়ে ঈদের নামাজের জামাতে সমস্ত মুসলমানদেরকে এক কাতারে শামিল করে।

মুসলিম মেমো অবলম্বনে

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক