০৩:০১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সড়কে মৃত্যুর মিছিল

চালকদের অদক্ষতা-উদাসীনতায় বাড়ছে দুর্ঘটনা

➣ ফরিদপুর-ময়মনসিংহে একদিনে ঝরল ১৬ প্রাণ
➣ ঈদের ছুটিতে প্রাণহানি ৮২ জনের
➣মার্চে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৫০ জনের প্রাণহানি
➣ রোড ডিভাইডার নির্মাণ ও ট্রাফিক আইন বাস্তবায়নের তাগিদ

 

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ট্রাফিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো দিন দিন যেন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। সড়ক-মহাসড়কে এখন চলাচল করা মানেই নিজের জীবন বাজি রেখে চলাচল করা। সড়ক-মহাসড়কে ২৪ লাখ অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকের দাপটে দুর্ঘটনায় লাগাম টানা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই সড়কে ঝরছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। ঈদের ছুটিতে গত এক সপ্তাহে সারা দেশে ৮২ জনের প্রাণহানি ঘটলেও টনক নড়েনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। গতকাল মঙ্গলবারও ফরিদপুরে বাস-পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের ৫ জনসহ ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। একই দিনে ময়মনসিংহের তারাকান্দায় দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নারী যাত্রীসহ দু’জন নিহত হয়েছে। এভাবেই প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ ও নিয়ম ভঙ্গ করে ওভারলোডিং-ওভারটেকিং ও বাড়তি মুনাফার জন্য অতিরিক্ত ট্রিপের প্রবণতা, চালকদের উদাসীনতা ও সড়ক-মহাসড়কগুলোতে পর্যাপ্ত রোড ডিভাইডার না থাকার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। এতে ট্রাফিক আইন প্রয়োগের ঘাটতিও অনেকাংশে দায়ী। এজন্য সব সংস্থাকে একসঙ্গে সড়ক-মহাসড়ক, নৌ ও রেলপথে বিশেষ নজরদারি বাড়ানো এবং সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ে জোর দিতে হবে। তবেই এসব কার্যক্রমের সুফল পাবে যাত্রী সাধারণ ও দুর্ঘটনাও অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। বিআরটিএ’র তথ্য বলছে, গত মার্চ মাসে সারা দেশে ৬২৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন মানুষ মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ৬৮৪ জন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতকাল মঙ্গলবার সকালে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুরের কানাইপুরে অ্যাবলুম ক্যাফেটেরিয়ার সামনে ঢাকা থেকে মাগুরাগামী ইউনিক পরিবহন ও আলফাডঙ্গা থেকে ফরিদপুর শহরের দিকে আসা পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘনাস্থলেই মারা যান ১১ জন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো দুজন মারা যান। এরপর দুপুরের দিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ঢাকায় আনার পথে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেন মো. ইব্রাহীম (৩২) নামের আরো একজন। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে মোট ১৪ জনে। নিহতরা সবাই পিকআপ ভ্যানের যাত্রী, চালক ও হেলপার। তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ের ত্রাণ নিতে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যাচ্ছিলেন। আলফাডাঙ্গা হয়ে বোয়ালমারী থেকে আসছিলেন। পিকআপে চালক হেলপারসহ ১৫ জন যাত্রী ছিলেন। নিহতরা হলেন বোয়ালমারী শেখর ইউনিয়নের ছত্রকান্দা গ্রাম রাকিব হোসেন মিলন (৪২), তার স্ত্রী সামিমা ইসলাম সুমি (২৫), তাদের বড় ছেলে আলভী রোহান (৭), ছোট ছেলে আলফাডাঙ্গা মডেল স্কুলের শিক্ষার্থী আবু সিনান (৪) এবং প্রতিবেশী মৃত আব্দুল ওহাবের স্ত্রী মর্জিনা বেগম (৭০), পিকআপ চালক আলফাডাঙ্গা পৌরসভার কুসুমদি গ্রামের নজরুল মোলা (৩৫), আলফাডাঙ্গা সদর ইউনিয়নের বেজিডাঙ্গা গ্রামের জানাহারা বেগম (৫০), ভাতিজি প্রবাসীর স্ত্রী সোনিয়া বেগম ৩০), সোনিয়ার ১১ মাস বয়সী শিশু সন্তান নুরানী, সদর ইউনিয়নের চরবাকাইল গ্রামের তবি খান (৫৫), হিদাডাঙ্গা গ্রামের হিদাডাঙ্গা গ্রামের শুকুরন বেগম (৯০), তার মেয়ে মনিরা বেগম সূর্য (৫৫), প্রতিবেশী কহিনুর বেগম (৬০) এবং মো. ইব্রাহীম। এ দুর্ঘটনায় মিলনের মা মনোয়ারা বেগম ওরফে হুরি বেগম (৬৫) মুমূর্ষু অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিসাধীন রয়েছেন।

ফরিদপুরের জেলা পুলিশ সুপার মোরশেদ আলম বলেন, সড়কে আমাদের চলাচলে আরো সচেতন হতে হবে। তা না হলে থামবে না মৃত্যুর মিছিল। শুধু যাত্রীদেরই নয় মালিক ও শ্রমিকদের বড় ভূমিকা রাখতে হবে। ফরিদপুর কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হাসানুজ্জামান বলেন, মরদেহগুলোর সুরতহালের পরে পরিচয় শনাক্ত করার পর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এ বিষয়ে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, খবর পেয়েই আমরা ঘটনাস্থলে ছুটে এসেছি। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে ৫ সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া নিহতদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ৫ লাখ এবং আহতদের পরিবারের জন্য ৩ লাখ টাকা ঘোষণা করা হয়েছে।

অপরদিকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কোদালধর বাজারের রামচন্দ্রপুর এলাকায় বেপরোয়া গতির কারণে দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এক বাস হেলপার ও এক নারী যাত্রী নিহত হয়েছেন। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন অন্তত আরো ২৫ যাত্রী। এ ঘটনায় ১২ জনকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৬ জনকে ভর্তি করা হয়েছে বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। নিহতরা হলেন- দুর্ঘটনাকবলিত রাজ সুপার বাসের হেলপার শেরপুর জেলার সদর উপজেলার রাজভল্লবপুর গ্রামের আক্তার আলীর ছেলে মো. শহিদ মিয়া (২৬) এবং নকলা উপজেলার মৃত আব্দুর রশিদের মেয়ে সুইটি আক্তার (২০)। গতকাল দুপুরে দৈনিক সবুজ বাংলাকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন তারাকান্দা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ওয়াজেদ আলী।

তিনি বলেন, শেরপুর থেকে ঢাকাগামী ইভা পরিবহনের একটি বাস বেপরোয়া গতিতে ময়মনসিংহ-শেরপুর সড়কের ঘটনাস্থল এলাকায় পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা বেপরোয়া গতির রাজ সুপার বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে রাজ সুপার বাসের হেলপার শহিদ মিয়া ও ইভা পরিবহনের যাত্রী সুইটি আক্তার ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ ঘটনায় আহত হন অন্তত ২৫ জন। তাদের মধ্যে প্রায় ১৪ জনকে তারাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো মমেক হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসা দেওয়া হয়। ওসি ওয়াজেদ আলী আরো বলেন, নিহতদের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে ময়নাতদন্তের জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সেই সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ঘটনার পর কিছুক্ষণ যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকলেও পুলিশের হস্তক্ষেপে সড়কে বর্তমানে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে বলেও জানান ওসি।

এর আগে ঈদের ছুটিতে গত এক সপ্তাহে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে পৃথক সড়ক, রেল ও নৌ-পথে ৮২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এদের মধ্যে সদরঘাটে লঞ্চের রশি ছিঁড়ে একই পরিবারের ৩ জনসহ ৫ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।

এদিকে এবারের ঈদযাত্রা ও ফেরার পথ নির্বিঘ্ন করতে ও দুর্ঘটনারোধে সড়ক নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে ৭টি সুপারিশ জানিয়েছে আহ্ছানিয়া মিশনের রোড সেফটি প্রকল্পের সমন্বয়কারী শারমিন রহমান। সুপারিশগুলো হলো সড়ক ও পরিবহণের ধরন অনুযায়ী গতি নির্ধারণ এবং ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত গাইডলাইন দ্রুত প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী উভয়েরই মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে; যানবাহনে চালকসহ সব যাত্রীর সিটবেল্ট ব্যবহারসংক্রান্ত গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে। মোটরযানে (বিশেষ করে কার/জিপ/মাইক্রোবাস) শিশুর জন্য উপযুক্ত শিশু সুরক্ষিত আসনব্যবস্থা প্রচলনসংক্রান্ত বিধিবিধান জারি করতে হবে; মদ্যপ অবস্থায় বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে মোটরযান পরিচালনা না করা সংক্রান্ত বিধিবিধান বাস্তবায়ন করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও প্রদানে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনাগুলো বিবেচনায় এনে কেন্দ্রীয়ভাবে তথ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহব্যবস্থা চালু করতে হবে। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচের আদলে সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সড়ক নিরাপত্তা আইন বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয়সাধনের জন্য একটি জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, এবারের ঈদে ঢাকা ছাড়েন ১ কোটি ৫০ লাখ যাত্রী। এর মধ্যে ঢাকা থেকে ১ কোটি, গাজীপুর থেকে ৪০ লাখ, নারায়ণগঞ্জ থেকে ১২ লাখ এবং আশপাশ থেকে আরও ৮ লাখ যাত্রী ঈদ উদযাপন করতে নিজেদের গন্তব্যে যান। তিনি আরো জানান, এবারের ঈদে বাস-মিনিবাসে ৩০ লাখ, লঞ্চে ৬০ লাখ, ট্রেনে ৪ লাখ, উড়োজাহাজে ১ লাখ, মোটরসাইকেলে ১২ লাখ, কার-জিপ-মাইক্রোবাসে ৩৫ লাখ এবং বাস-ট্রেনের ছাদ, খোলা ট্রাক ও পণ্যবাহী গাড়িতে ১৮ লাখ যাত্রী ভ্রমণ করবেন। ফিরতি পথেও একই ব্যবস্থা বিরাজ করবে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ২০২৩ সালে দেশের সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫০৫ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৯০২ জন। ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৯৫০ জন চালক মারা যান।

সড়কে গত বছর ২ হাজার ৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ১৫২ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৩৯ জন আহত হয়েছেন, যা মোট দুর্ঘটনার ৩২ শতাংশের বেশি। গত বছর দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন ঢাকা বিভাগে। এখানে ১ হাজার ৭৩৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৭১২ জন নিহত ও ২ হাজার ৩৮১ জন আহত হয়েছেন।

এবারের ঈদযাত্রা ও ফিরতি পথে সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, সরকারি আদেশ অমান্য করে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে অবাধে চলাচল করছে ইজিবাইক, সিএনজিসহ অন্য থ্রি-হুইলার। এসবের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। অতীতের চেয়ে এই চলাচল বেড়ে যাওয়ার কারণে অহরহ দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এটা বন্ধ করা না গেলে সড়কে অরাজকতা কমবে না। বরাবরের মতো এবারের ঈদযাত্রায় ও ফিরতি পথে সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনায় হতাহতের আশঙ্কা আগেই করা হয়েছে। দেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার বেড়েছে কয়েকগুণ। বেপরোয়া গতিতে চালানোয় দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ এটি। তিনি বলেন, সড়ক ও নৌপথে লক্কড়-ঝক্কড় বাহন মেরামত করে নামানো হলে দুর্ঘটনার শঙ্কা বেড়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। এতে হতাহতের শঙ্কাও বাড়বে। দুর্ঘটনা এড়াতে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিআরটিএ, হাইওয়ে পুলিশ, ডিএমপি, নৌ-পুলিশ, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পরিবহন সংশ্লিষ্ট মালিক-শ্রমিকদের একযোগে কাজ করতে হবে। দেশের সব সড়ক-মহাসড়ক, রেল ও নৌ-পথে সার্বিক পরিস্থিতি গুরুত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নজরদারি ও তদারকি বাড়াতে হবে। চালকসহ সরকার সংশ্লিষ্টদের গাফিলতির কারণেই দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করেন মো. মোজাম্মেল হক।

বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, সড়ক নির্মাণের পর ‘সেফটি অডিট’ করা জরুরি। আমাদের দেশে এটা করা হয় না। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ১১১টি সুপারিশ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এই সুপারিশেই সড়ক মহাসড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সব ধরনের গাইডলাইন দেওয়া আছে। এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে যাবে এবং সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। মহাসড়কে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমেও সড়কে সব ধরনের দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তিনি আরো বলেন, দুর্ঘটনার কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে- কে কার আগে বেশি যাত্রী-পণ্য তুলবে, গন্তব্যে পৌঁছাবে, আবার ফিরে আসবে, এমন মন-মানসিকতায় চালকদের অসম প্রতিযোগিতা, রেষারেষি আর রোড ডিভাইডার না থাকার কারণে দুর্ঘটনা বড়ছে। মূলত নিজেদের মধ্যে সচেতনতা না থাকলে এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহের সমন্বিত উদ্যোগ বাস্তবায়নে উদাসীন হলে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বাড়বেই।

পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৯০ দশমিক ৬৯ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী অদক্ষ চালক। সারা দেশে ২৪ লাখ লাইসেন্সবিহীন চালক সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বলে জানায় নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)।

এদিকে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের মার্চ মাসে সারা দেশে ৬২৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত ও ৬৮৪ জন আহত হয়েছেন।

জনপ্রিয় সংবাদ

স্মৃতিসৌধে তারেক রহমান

সড়কে মৃত্যুর মিছিল

আপডেট সময় : ০৪:৪১:১০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪

➣ ফরিদপুর-ময়মনসিংহে একদিনে ঝরল ১৬ প্রাণ
➣ ঈদের ছুটিতে প্রাণহানি ৮২ জনের
➣মার্চে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৫০ জনের প্রাণহানি
➣ রোড ডিভাইডার নির্মাণ ও ট্রাফিক আইন বাস্তবায়নের তাগিদ

 

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ট্রাফিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো দিন দিন যেন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। সড়ক-মহাসড়কে এখন চলাচল করা মানেই নিজের জীবন বাজি রেখে চলাচল করা। সড়ক-মহাসড়কে ২৪ লাখ অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকের দাপটে দুর্ঘটনায় লাগাম টানা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই সড়কে ঝরছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। ঈদের ছুটিতে গত এক সপ্তাহে সারা দেশে ৮২ জনের প্রাণহানি ঘটলেও টনক নড়েনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। গতকাল মঙ্গলবারও ফরিদপুরে বাস-পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের ৫ জনসহ ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। একই দিনে ময়মনসিংহের তারাকান্দায় দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নারী যাত্রীসহ দু’জন নিহত হয়েছে। এভাবেই প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ ও নিয়ম ভঙ্গ করে ওভারলোডিং-ওভারটেকিং ও বাড়তি মুনাফার জন্য অতিরিক্ত ট্রিপের প্রবণতা, চালকদের উদাসীনতা ও সড়ক-মহাসড়কগুলোতে পর্যাপ্ত রোড ডিভাইডার না থাকার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। এতে ট্রাফিক আইন প্রয়োগের ঘাটতিও অনেকাংশে দায়ী। এজন্য সব সংস্থাকে একসঙ্গে সড়ক-মহাসড়ক, নৌ ও রেলপথে বিশেষ নজরদারি বাড়ানো এবং সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ে জোর দিতে হবে। তবেই এসব কার্যক্রমের সুফল পাবে যাত্রী সাধারণ ও দুর্ঘটনাও অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। বিআরটিএ’র তথ্য বলছে, গত মার্চ মাসে সারা দেশে ৬২৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন মানুষ মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ৬৮৪ জন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতকাল মঙ্গলবার সকালে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুরের কানাইপুরে অ্যাবলুম ক্যাফেটেরিয়ার সামনে ঢাকা থেকে মাগুরাগামী ইউনিক পরিবহন ও আলফাডঙ্গা থেকে ফরিদপুর শহরের দিকে আসা পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘনাস্থলেই মারা যান ১১ জন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো দুজন মারা যান। এরপর দুপুরের দিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ঢাকায় আনার পথে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেন মো. ইব্রাহীম (৩২) নামের আরো একজন। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে মোট ১৪ জনে। নিহতরা সবাই পিকআপ ভ্যানের যাত্রী, চালক ও হেলপার। তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ের ত্রাণ নিতে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যাচ্ছিলেন। আলফাডাঙ্গা হয়ে বোয়ালমারী থেকে আসছিলেন। পিকআপে চালক হেলপারসহ ১৫ জন যাত্রী ছিলেন। নিহতরা হলেন বোয়ালমারী শেখর ইউনিয়নের ছত্রকান্দা গ্রাম রাকিব হোসেন মিলন (৪২), তার স্ত্রী সামিমা ইসলাম সুমি (২৫), তাদের বড় ছেলে আলভী রোহান (৭), ছোট ছেলে আলফাডাঙ্গা মডেল স্কুলের শিক্ষার্থী আবু সিনান (৪) এবং প্রতিবেশী মৃত আব্দুল ওহাবের স্ত্রী মর্জিনা বেগম (৭০), পিকআপ চালক আলফাডাঙ্গা পৌরসভার কুসুমদি গ্রামের নজরুল মোলা (৩৫), আলফাডাঙ্গা সদর ইউনিয়নের বেজিডাঙ্গা গ্রামের জানাহারা বেগম (৫০), ভাতিজি প্রবাসীর স্ত্রী সোনিয়া বেগম ৩০), সোনিয়ার ১১ মাস বয়সী শিশু সন্তান নুরানী, সদর ইউনিয়নের চরবাকাইল গ্রামের তবি খান (৫৫), হিদাডাঙ্গা গ্রামের হিদাডাঙ্গা গ্রামের শুকুরন বেগম (৯০), তার মেয়ে মনিরা বেগম সূর্য (৫৫), প্রতিবেশী কহিনুর বেগম (৬০) এবং মো. ইব্রাহীম। এ দুর্ঘটনায় মিলনের মা মনোয়ারা বেগম ওরফে হুরি বেগম (৬৫) মুমূর্ষু অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিসাধীন রয়েছেন।

ফরিদপুরের জেলা পুলিশ সুপার মোরশেদ আলম বলেন, সড়কে আমাদের চলাচলে আরো সচেতন হতে হবে। তা না হলে থামবে না মৃত্যুর মিছিল। শুধু যাত্রীদেরই নয় মালিক ও শ্রমিকদের বড় ভূমিকা রাখতে হবে। ফরিদপুর কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হাসানুজ্জামান বলেন, মরদেহগুলোর সুরতহালের পরে পরিচয় শনাক্ত করার পর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এ বিষয়ে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, খবর পেয়েই আমরা ঘটনাস্থলে ছুটে এসেছি। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে ৫ সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া নিহতদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ৫ লাখ এবং আহতদের পরিবারের জন্য ৩ লাখ টাকা ঘোষণা করা হয়েছে।

অপরদিকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কোদালধর বাজারের রামচন্দ্রপুর এলাকায় বেপরোয়া গতির কারণে দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এক বাস হেলপার ও এক নারী যাত্রী নিহত হয়েছেন। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন অন্তত আরো ২৫ যাত্রী। এ ঘটনায় ১২ জনকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৬ জনকে ভর্তি করা হয়েছে বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। নিহতরা হলেন- দুর্ঘটনাকবলিত রাজ সুপার বাসের হেলপার শেরপুর জেলার সদর উপজেলার রাজভল্লবপুর গ্রামের আক্তার আলীর ছেলে মো. শহিদ মিয়া (২৬) এবং নকলা উপজেলার মৃত আব্দুর রশিদের মেয়ে সুইটি আক্তার (২০)। গতকাল দুপুরে দৈনিক সবুজ বাংলাকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন তারাকান্দা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ওয়াজেদ আলী।

তিনি বলেন, শেরপুর থেকে ঢাকাগামী ইভা পরিবহনের একটি বাস বেপরোয়া গতিতে ময়মনসিংহ-শেরপুর সড়কের ঘটনাস্থল এলাকায় পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা বেপরোয়া গতির রাজ সুপার বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে রাজ সুপার বাসের হেলপার শহিদ মিয়া ও ইভা পরিবহনের যাত্রী সুইটি আক্তার ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ ঘটনায় আহত হন অন্তত ২৫ জন। তাদের মধ্যে প্রায় ১৪ জনকে তারাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো মমেক হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসা দেওয়া হয়। ওসি ওয়াজেদ আলী আরো বলেন, নিহতদের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে ময়নাতদন্তের জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সেই সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ঘটনার পর কিছুক্ষণ যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকলেও পুলিশের হস্তক্ষেপে সড়কে বর্তমানে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে বলেও জানান ওসি।

এর আগে ঈদের ছুটিতে গত এক সপ্তাহে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে পৃথক সড়ক, রেল ও নৌ-পথে ৮২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এদের মধ্যে সদরঘাটে লঞ্চের রশি ছিঁড়ে একই পরিবারের ৩ জনসহ ৫ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।

এদিকে এবারের ঈদযাত্রা ও ফেরার পথ নির্বিঘ্ন করতে ও দুর্ঘটনারোধে সড়ক নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে ৭টি সুপারিশ জানিয়েছে আহ্ছানিয়া মিশনের রোড সেফটি প্রকল্পের সমন্বয়কারী শারমিন রহমান। সুপারিশগুলো হলো সড়ক ও পরিবহণের ধরন অনুযায়ী গতি নির্ধারণ এবং ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত গাইডলাইন দ্রুত প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী উভয়েরই মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে; যানবাহনে চালকসহ সব যাত্রীর সিটবেল্ট ব্যবহারসংক্রান্ত গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে। মোটরযানে (বিশেষ করে কার/জিপ/মাইক্রোবাস) শিশুর জন্য উপযুক্ত শিশু সুরক্ষিত আসনব্যবস্থা প্রচলনসংক্রান্ত বিধিবিধান জারি করতে হবে; মদ্যপ অবস্থায় বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে মোটরযান পরিচালনা না করা সংক্রান্ত বিধিবিধান বাস্তবায়ন করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও প্রদানে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনাগুলো বিবেচনায় এনে কেন্দ্রীয়ভাবে তথ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহব্যবস্থা চালু করতে হবে। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচের আদলে সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সড়ক নিরাপত্তা আইন বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয়সাধনের জন্য একটি জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, এবারের ঈদে ঢাকা ছাড়েন ১ কোটি ৫০ লাখ যাত্রী। এর মধ্যে ঢাকা থেকে ১ কোটি, গাজীপুর থেকে ৪০ লাখ, নারায়ণগঞ্জ থেকে ১২ লাখ এবং আশপাশ থেকে আরও ৮ লাখ যাত্রী ঈদ উদযাপন করতে নিজেদের গন্তব্যে যান। তিনি আরো জানান, এবারের ঈদে বাস-মিনিবাসে ৩০ লাখ, লঞ্চে ৬০ লাখ, ট্রেনে ৪ লাখ, উড়োজাহাজে ১ লাখ, মোটরসাইকেলে ১২ লাখ, কার-জিপ-মাইক্রোবাসে ৩৫ লাখ এবং বাস-ট্রেনের ছাদ, খোলা ট্রাক ও পণ্যবাহী গাড়িতে ১৮ লাখ যাত্রী ভ্রমণ করবেন। ফিরতি পথেও একই ব্যবস্থা বিরাজ করবে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ২০২৩ সালে দেশের সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫০৫ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৯০২ জন। ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৯৫০ জন চালক মারা যান।

সড়কে গত বছর ২ হাজার ৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ১৫২ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৩৯ জন আহত হয়েছেন, যা মোট দুর্ঘটনার ৩২ শতাংশের বেশি। গত বছর দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন ঢাকা বিভাগে। এখানে ১ হাজার ৭৩৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৭১২ জন নিহত ও ২ হাজার ৩৮১ জন আহত হয়েছেন।

এবারের ঈদযাত্রা ও ফিরতি পথে সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, সরকারি আদেশ অমান্য করে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে অবাধে চলাচল করছে ইজিবাইক, সিএনজিসহ অন্য থ্রি-হুইলার। এসবের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। অতীতের চেয়ে এই চলাচল বেড়ে যাওয়ার কারণে অহরহ দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এটা বন্ধ করা না গেলে সড়কে অরাজকতা কমবে না। বরাবরের মতো এবারের ঈদযাত্রায় ও ফিরতি পথে সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনায় হতাহতের আশঙ্কা আগেই করা হয়েছে। দেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার বেড়েছে কয়েকগুণ। বেপরোয়া গতিতে চালানোয় দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ এটি। তিনি বলেন, সড়ক ও নৌপথে লক্কড়-ঝক্কড় বাহন মেরামত করে নামানো হলে দুর্ঘটনার শঙ্কা বেড়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। এতে হতাহতের শঙ্কাও বাড়বে। দুর্ঘটনা এড়াতে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিআরটিএ, হাইওয়ে পুলিশ, ডিএমপি, নৌ-পুলিশ, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পরিবহন সংশ্লিষ্ট মালিক-শ্রমিকদের একযোগে কাজ করতে হবে। দেশের সব সড়ক-মহাসড়ক, রেল ও নৌ-পথে সার্বিক পরিস্থিতি গুরুত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নজরদারি ও তদারকি বাড়াতে হবে। চালকসহ সরকার সংশ্লিষ্টদের গাফিলতির কারণেই দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করেন মো. মোজাম্মেল হক।

বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, সড়ক নির্মাণের পর ‘সেফটি অডিট’ করা জরুরি। আমাদের দেশে এটা করা হয় না। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ১১১টি সুপারিশ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এই সুপারিশেই সড়ক মহাসড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সব ধরনের গাইডলাইন দেওয়া আছে। এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে যাবে এবং সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। মহাসড়কে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমেও সড়কে সব ধরনের দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তিনি আরো বলেন, দুর্ঘটনার কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে- কে কার আগে বেশি যাত্রী-পণ্য তুলবে, গন্তব্যে পৌঁছাবে, আবার ফিরে আসবে, এমন মন-মানসিকতায় চালকদের অসম প্রতিযোগিতা, রেষারেষি আর রোড ডিভাইডার না থাকার কারণে দুর্ঘটনা বড়ছে। মূলত নিজেদের মধ্যে সচেতনতা না থাকলে এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহের সমন্বিত উদ্যোগ বাস্তবায়নে উদাসীন হলে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বাড়বেই।

পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৯০ দশমিক ৬৯ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী অদক্ষ চালক। সারা দেশে ২৪ লাখ লাইসেন্সবিহীন চালক সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বলে জানায় নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)।

এদিকে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের মার্চ মাসে সারা দেশে ৬২৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত ও ৬৮৪ জন আহত হয়েছেন।