◉ দলীয় নির্দেশনায় প্রার্থিতা প্রত্যাহারে অনিশ্চয়তা
◉ বিএনপির অনেকেই অংশগ্রহণ করবে-দাবি কাদেরের
◉ মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বিস্তার না করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা
◉ প্রথম ধাপের প্রার্থী বাছাই আজ, হতে পারে তৃতীয় ধাপের তফসিল
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট বর্জনের ধারাবাহিকতায় আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। তবে দলটি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রথম ধাপের ১৫০টি উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার প্রায় ৭ ঘণ্টা পর। গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে একইধরণের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। তবে দল দুটির বেশ সংখ্যক নেতা এরই মধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন বলে জানা গেছে। তাদেরকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশনা দেয়া হবে বলে দলীয় নেতারা জানিয়েছেন। যদিও দলীয় নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্টরা প্রার্থীরা তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করবেন কিনা-তা নিয়ে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। অবশ্য নির্দেশনা না মেনে ভোটে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেয়ারও হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে।
এদিকে প্রকাশে বিরোধীতা করলেও বাস্তবে বিএনপির অনেকেই উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এছাড়া এই নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বিস্তার না করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
গতকাল মঙ্গলবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, বিএনপি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে এবং প্রশাসন ও পুলিশের একপেশে ভূমিকার জন্য এর আগেও জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্জন করেছে। এখনো সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়নি। বিদ্যমান পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ায় আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। বিএনপি ৮ মে থেকে শুরু হওয়া সকল ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, বর্তমান সরকারের আমলে দেশে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনই অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থীদেরই নির্বাচন কমিশন বিজয়ী ঘোষণা করে। প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী দলের প্রার্থীদের নানাভাবে হামলা, মামলা ও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। মনোনয়নপত্র তোলা ও জমা দেওয়া এবং নির্বাচনী প্রচারে হামলা এবং শারীরিক আক্রমণসহ পথে পথে বাধা দেওয়া হয়। অনেককেই মনোনয়নপত্র জমা দিতেও দেওয়া হয়নি।
এদিকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে জামায়াতে ইসলামীও সিদ্ধান্ত বদল করেছে। দলটির আগের অবস্থান ছিল, কেন্দ্রীয়ভাবে ভোটে অংশ নেওয়ার ঘোষণা না দিয়ে যেসব উপজেলায় জয়ের সম্ভাবনা আছে, সেখানে দলের নেতারা স্থানীয়ভাবে প্রার্থী হবেন। তবে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে গত রোববার জামায়াতের কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়, দলের কেউ প্রার্থী হতে পারবেন না। যারা আগেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে হবে। জামায়াতের একাধিক সিনিয়র নেতা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে জামায়াত। এ কারণে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়নি, উপজেলা নির্বাচনেও অংশ নেবে না।
সিদ্ধান্ত বদলের আগে দলটির শতাধিক নেতা উপজেলা চেয়ারম্যান এবং তিন শতাধিক নেতা ভাইস চেয়ারম্যান এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হতে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। অনেকে গণসংযোগও শুরু করেন। ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্টারও সাঁটান কয়েকজন জামায়াত নেতা। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও ঝিনাইদহের অন্তত ৪০ উপজেলার জামায়াত নেতারা ভোটের মাঠে ছিলেন। একই চিত্র ছিল উত্তরবঙ্গের অর্ধশতাধিক উপজেলায়। এসব এলাকায় দলটির ‘ভোট ব্যাংক’ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে দলের নির্দেশনার পর জামায়াত নেতারা নির্বাচন থেকে নীরবে সরে গেছেন। সোমবার ছিল প্রথম পর্বের ১৫০ উপজেলায় মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। কেন্দ্রীয় জামায়াতের সূত্র জানিয়েছে, যারা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তারা প্রত্যাহার করে নেবেন।
উপজেলা নির্বাচন দলীয়ভাবে হলেও এবার দলীয় প্রতীক দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। তবে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন নিয়ে দলের অবস্থান সম্পর্কে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অস্পষ্টতায় ছিলেন বিএনপির তৃণমূলের নেতারা। এরই মধ্যে প্রথম ধাপের ১৫০টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কমবেশি বিএনপির ৪৫ জন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। দলের অবস্থানের বাইরে গিয়ে যারা ভোটের মাঠে নেমেছেন, তাদের ব্যাপারে বিএনপি কতটা কঠোর হতে পারবে, এখন সেই আলোচনা সামনে এসেছে।
যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলেছেন, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনে তৃণমূলের নেতাদের যারা প্রার্থী হচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবশ্য মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হবে ২২ এপ্রিল।
বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, দলের যারা এরই মধ্যে প্রার্থী হয়েছেন, তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য নির্দেশনা পাঠানো হবে। তবে দলটির এই বার্তা ভোটে আগ্রহী তৃণমূলের নেতাদের ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে, সে বিষয়েও প্রশ্ন উঠছে। এদিকে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ১২ দলীয় জোটও উপজেলা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে।
বিরোধিতা করলেও বিএনপির অনেকেই অংশগ্রহণ করবে-কাদের: আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি প্রকাশ্যে বিরোধিতা করলেও আমাদের জানামতে তাদের অনেকেই অংশগ্রহণ করবেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে আওয়ামী লীগের সভাপতির ধানমন্ডি রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
কাদের বলেন, ৮ মে প্রথম দফার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বিস্তার না করতে। নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে হয়, কেউ কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না। প্রশাসন কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না। নির্বিঘ্নে ভোট দানের ব্যবস্থা করেছেন নির্বাচন কমিশন। বিএনপি প্রকাশ্যে উপজেলা নির্বাচনের বিরোধিতা করলেও আমাদের জানামতে তাদের অনেকেই অংশগ্রহণ করবেন।
তৃতীয় পর্যায়ের তফসিল হতে পারে আজ: আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থীদের কাছে মনোনয়নপত্রের প্রিন্ট কপি না চাওয়ার জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসির নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার উপ-সচিব মো. আতিয়ার রহমান এরই মধ্যে নির্দেশনাটি সব রিটার্নিং কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছেন। আইন প্রণয়ন করে অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের বিধান আনলেও মাঠ কর্মকর্তারা তা না মানায় এমন নির্দেশনা দিল সংস্থাটি।
এদিকে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২১ এপ্রিল। তৃতীয় ধাপের তফসিলের ঘোষণা আসতে পারে আজ বুধবার।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা, ২০১৩ এর বিধি ১৫ অনুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের বিধান করা হয়েছে। অনলাইন মনোনয়নপত্র দাখিলের পর কোনো কোনো জেলা বা উপজেলা হতে মনোনয়নপত্রের প্রিন্ট কপি প্রার্থীর নিকট হতে চাওয়া হচ্ছে, যা বিধি বহির্ভূত। উক্তরূপ বিধি বহির্ভূত প্রিন্ট কপি প্রদানে বাধ্য না করার জন্য নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন।
তবে বিধি অনুযায়ী বাছাইয়ের সময় হলফনামার মূল কপি অথবা কোনো তথ্য বা কাগজপত্র অপূর্ণ থাকলে তা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে অবহিত করা যেতে পারে। বিধি ১৭ অনুযায়ী বাছাইয়ের সময় প্রার্থী বা প্রস্তাবকারী, সমর্থনকারী অথবা প্রার্থী কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির উপস্থিতির সুযোগ থাকলেও বাধ্যতামূলক নয়।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, প্রথম ধাপের মনোনয়নপত্র বাছাই আজ ১৭ এপ্রিল। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল ১৮ থেকে ২০ এপ্রিল। আপিল নিষ্পত্তি ২১ এপ্রিল, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ২২ এপ্রিল। প্রতীক বরাদ্দ ২৩ এপ্রিল, আর ১৫০ উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে ৮ মে।
প্রথম ধাপের নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিল আবেদন নিষ্পত্তি করবেন আপিল কর্তৃপক্ষ হিসেবে জেলা প্রশাসক।
দ্বিতীয় ধাপের তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিল ২১ এপ্রিল শেষ সময়, মনোনয়নপত্র বাছাই ২৩ এপ্রিল, আপিল গ্রহণ ২৪-২৬ এপ্রিল, আপিল নিষ্পত্তি ২৭ থেকে ২৯ এপ্রিল। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ৩০ এপ্রিল, প্রতীক বরাদ্দ ২ মে। আর ১৬১ উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে ২ মে।
এই ধাপের নির্বাচনে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ভোটারের সংখ্যা ৫ লাখের বেশি যেখানে সেখানে একাধিক সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োজিত থাকবেন। চার ধাপের উপজেলা নির্বাচনের পরবর্তী দুই ধাপের নির্বাচন ২৯ মে ও ৫ জুন অনুষ্ঠিত হতে পারে।




















