◉ফের ২০ বিলিয়নের নিচে নামল রিজার্ভ
◉এক সপ্তাহে কমেছে ৪৭৬ কোটি টাকা
◉ রমজান ও ঈদে রেমিট্যান্স হ্রাস পায়
◉ অর্থপাচার বাড়ায় হুন্ডিও বেড়েছে
দেশে হুন্ডির প্রচলন অতি প্রচীন হলেও এর প্রসার দিন দিন বেড়েই চলছে। যা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যাচ্ছে। এর লাগাম টেনে ধরার যেন কেউ নেই। অর্থপাচার বেড়েছে বলেই হুন্ডির চাহিদাও এখন বেশি। ফলে ক্রমাগত কমছে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ফর্মুলা অনুযায়ী বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দিন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ১৯ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। গত সপ্তাহ শেষে রিজার্ভ ২০ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার ছিল। অর্থাৎ গত এক সপ্তাহে রিজার্ভ থেকে ৪৭৬ কোটি ডালার হ্রাস পেয়েছে।
হুন্ডি প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমাসহ বিভিন্ন কারণে রিজার্ভ কমেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা অবৈধ ব্যবসায়ী, ঘুষ-দুর্নীতি, কর ফাঁকি, চোরাচালান বা অন্য কোনো অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করেছেন, তারা অর্থ পাচারের জন্য বেছে নেন হুন্ডিকেই। এটিই তাদের জন্য নিরাপদ ও সুবিধাজনক।
এদিকে শত চেষ্টা করেও দেশের অর্থনীতি থেকে যেন হুন্ডি মোকাবেলা করা যাচ্ছে না। এতে সংশ্লিষ্টরা তৎপর হয়েও কোনো কিছু করতে পারছে না। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, আইএমএফ ফর্মুলা অনুযায়ী, গত বুধবার পর্যন্ত রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৪০ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ইতিহাসে রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর ছাড়িয়েছিল ২০২১ সালের আগস্টে। বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়াসহ বিভিন্ন উপায়ে ওই সময় রিজার্ভ বাড়ানো হয়। এরপর থেকে ডলার সঙ্কট কাটাতে গিয়ে ২৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে কমতে কমতে গত নভেম্বর শেষে রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছিল। এরপর আবার বেড়ে ডিসেম্বরে ২১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন হয়। এরপর কমতে কমতে গত মার্চ শেষে ১৯ দশমিক ৯১ বিলিন ডলারে নেমেছিল। এরপর গত সপ্তাহ শেষে তা বেড়ে ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল। সাধারণত প্রতি বছর রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে রেমিট্যান্স বাড়ে। তবে এবার তার উল্টো চিত্র দেখা গেছে। গত মার্চে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৯৯ কোটি ৬৮ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা আগের বছরের একই মাস বা আগের মাস ফেব্রুয়ারির তুলনায় কম।
মূলত ১২৩-১২৫ টাকায় উঠে যাওয়া ডলারের দর হঠাৎ করে ১১২ থেকে ১১৫ টাকায় নামায় অনেকে আবার হুন্ডিতে টাকা পাঠাচ্ছেন। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে মোট এক হাজার ৭০৪ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল এক হাজার ৬০৪ কোটি ডলার। এ হিসেবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১০৪ কোটি ডলার বা ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেখানে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ।
ব্যাংকাররা জানান, কয়েকদিন আগেও ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে প্রতি ডলারে ১২৩ থেকে ১২৪ টাকা পাচ্ছিলেন প্রবাসীরা। গত ১০ মার্চ পর্যন্ত ডলারের দাম স্থিতিশীল ছিল। তবে সোয়াপের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ডলার তুলে নেওয়ার পর থেকে ব্যাংকগুলো ডলার কেনা কমিয়ে দিয়েছে। এরপর কমতে কমতে গত মাসের মাঝামাঝিতে তা ১১২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১৩ টাকায় নেমেছিল।
এদিকে হুন্ডিতে ডলারের দর পাওয়া যাচ্ছে ১২০ থেকে ১২১ টাকা। তবে ব্যাংকগুলো দর আবার বাড়িয়ে এখন ১১৫ টাকায় রেমিট্যান্স কিনছে। খোলাবাজারে ডলারের দর এখন বেশি বলেই যে কেবল প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স হুন্ডির মাধ্যমে আসছে তা নয়। বরং অর্থপাচার বাড়ছে বলেই হুন্ডিও বেড়েছে। তবে যারা ধনী ব্যবসায়ী গোষ্ঠি হিসেবে পরিচিত, তারা অর্থপাচার করে মূলত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে। আর যারা ঘুষ-দুর্নীতি, কর ফাঁকি, চোরাচালান বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জন করেছেন, তারা অর্থপাচারের জন্য বেছে নেন হুন্ডিকেই।
হুন্ডির মাধ্যমে মূলত নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে কিংবা অননুমোদিত চ্যানেলে বিভিন্ন কৌশল ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অর্থ আনয়ন বা প্রেরণ করা হয়ে থাকে। হুন্ডি হলো একটি আর্থিক ব্যবস্থা, যা মধ্যযুগীয় ভারত উপমহাদেশে বাণিজ্য ও ঋণ লেনদেনে ব্যবহারের জন্য উদ্ভূত হয়েছিল। তবে এই হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের ফলে সরকার হারাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা, হারাচ্ছে রাজস্বও।
এদিকে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়াতে ডলারের বিনিময় হার হুন্ডির পর্যায়ে নিয়ে গেলেও লাভ হবে না- এমন মন্তব্য করেছেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। তিনি বলেছেন, ডলারের বিনিময় হার ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হলে দেখা যাবে হুন্ডিওয়ালারা ১৪০ টাকা দেবে। তার মতে, যারা বিদেশে অর্থপাচার করে, তাদের কাছে বিনিময় হার কোনো বিষয় নয়, যে কোনো মূল্যে তারা তা করে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মুদ্রার অবমূল্যায়ন বা আর্থিক প্রণোদনা হুন্ডি প্রতিরোধে যথেষ্ট নয়। এমন পদক্ষেপ স্বল্পমেয়াদে প্রবাসীদের কাছে আকর্ষণীয় হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা কতটা সুফল দেবে, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। এছাড়া সাধারণ মানুষ তাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে পর্যাপ্ত ডলার না পেলে হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।


























