০৯:২৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ভারতের রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক

লোকসভা নির্বাচন

➢ কংগ্রেসকে জড়িয়ে মুসলমানদের আক্রমণ মোদির
➢ মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী : রাহুল গান্ধী
➢ ভোটের জন্য মোদি মুসলমানদের গালি দিচ্ছেন : মাওলানা ওয়েইসি
➢ তৃতীয় দফার ভোটে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র বেশি পশ্চিমবঙ্গে

ভারতের লোকসভার প্রথম দফায় ভোটের হার আশানুরূপ না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরাসরি ধর্মীয় মেরুকরণের পথে হাঁটলেন বলে বিরোধীরা অভিযোগ করছেন। সাম্প্রতিক তেলেঙ্গানায় দেওয়া এক ভাষণে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, কোনো শ্রেণির হাতে দেশের কত সম্পদ, জাতগণনার পাশাপাশি ক্ষমতায় এলে কংগ্রেস তা জরিপ করে দেখবে। প্রধানমন্ত্রী মোদি শুধু ঘনিষ্ঠ কিছু পুঁজিপতির স্বার্থ দেখেন। তার আমলে দেশের ১ শতাংশ মানুষ ৪০ শতাংশ সম্পদের মালিক হয়েছেন। রাহুলের সেই ভাষণের রেশ ধরেই গত রোববার রাজস্থানের বাঁশবাড়া কেন্দ্রের এক নির্বাচনী জনসভায় মোদি বলেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে দেশের সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বিলি করে দেবে। পারিবারিক সোনা-রুপার সঙ্গে বিবাহিত নারীদের গলায় পরা পবিত্র মঙ্গলসূত্র পর্যন্ত তারা কেড়ে নিয়ে বাঁটোয়ারা করে দেবে। মুসলমানদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টন করার কথা কংগ্রেসের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মনমোহন সিংও বলেছিলেন, দেশের সম্পত্তির ওপর মুসলমানদের অধিকার সবার আগে।

এবারের ভোটে কংগ্রেস ও মুসলমানদের সমার্থক করে এভাবে প্রথম সরাসরি আক্রমণাত্মক হলেন নরেন্দ্র মোদি। এবং তা করতে গিয়ে তিনি যে দাবি করেছেন, তা সম্পূর্ণ ভুল বলে অভিযোগ করেছে কংগ্রেস। প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ ভারতের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কংগ্রেসসহ বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতারা ওই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেছেন, প্রথম দফার ভোট বিরুদ্ধে গেছে বলে প্রধানমন্ত্রীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওই ভাষণের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগও জানানো হয়েছে।

জনসভায় আসা মানুষের কাছে মোদি জানতে চান, তারা তাদের কষ্টার্জিত সম্পত্তি মুসলমানদের মধ্যে, যাদের অনেক বাচ্চাকাচ্চা হয় তাদের মধ্যে, অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বাঁটোয়ারা হতে দেবেন কি না। এ প্রশ্নের মধ্য দিয়ে মোদি বুঝিয়ে দিলেন, এ দেশের মুসলমানরা অনুপ্রবেশকারী। একমাত্র তারাই গাদাগাদা সন্তানের জন্ম দেন। মোদি বলেন, এবার কংগ্রেস তার ইশতেহারে বলেছে, ক্ষমতায় এলে আপনাদের রোজগারে অর্জিত সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বিলিবণ্টন করে দেবে। মা-বোনেদের কাছে থাকা সোনা-রুপার হিসাব কষা হবে। তারপর তা বিলি করা হবে তাঁদের মধ্যে, যারা অনুপ্রবেশকারী, যাঁদের অনেক বাচ্চাকাচ্চা হয়। মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্রও তাদের হাত থেকে রেহাই পাবে না। মোদি এই ভাবনাকে শহুরে নকশালদের মনোবৃত্তির সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি জানতে চান, জনগণ তা হতে দেবে কি না?

মোদির ওই ভাষণ সম্প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিরোধী মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, বেশ বোঝা যাচ্ছে, মোদি হতাশ হয়ে পড়েছেন। কারণ, প্রথম দফায় ‘ইন্ডিয়া’ জোট এগিয়ে গেছে। মোদি তাই ঘৃণা ভাষণের আশ্রয় নিয়েছেন। ক্ষমতার জন্য অসত্য কথা বলছেন। বিরোধীরা যা বলেনি, তা বলে মানুষকে বিপথে চালিত করছেন। আরএসএস ও বিজেপির প্রশিক্ষণই এমন।

রাহুল গান্ধী বলেন, এটা হতাশার লক্ষণ। প্রথম দফার ভোট বিরুদ্ধে গেছে বুঝতে পেরে প্রধানমন্ত্রী মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন। মিথ্যা ভাষণে তিনি এতটাই নিচে নেমেছেন যে, এখন মানুষের নজর ঘোরাতে চাইছেন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মনমোহন সিং বারবার মুসলিম সমাজের ক্ষমতায়নের কথা বলে এসেছেন। মোদি তা বিকৃত করছেন। কংগ্রেসের এবারের ইশতেহার বৈপ্লবিক। এবার মানুষ তার পরিবার, কর্মসংস্থান, ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভোট দেবে। অন্য ভাবনায় বিচ্যুত হবে না।

কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের প্রেসিডেন্ট নেতা ও হায়দারাবাদের সাংসদ মাওলানা আসাদ উদ্দিন ওয়েইসিও। এক্স হ্যান্ডেলে তিনি লেখেন, মোদি মুসলমানদের অনুপ্রবেশকারী বললেন। বহু সন্তানের জন্মদাতা বললেন। ২০০২ সালে থেকে এটাই তিনি করে আসছেন। মুসলমানদের গালি দিচ্ছেন। এটাই তার একমাত্র গ্যারান্টি। এসব করেন ভোট পাওয়ার জন্য। মোদির আমলেই দেশের ১ শতাংশ মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে ৪০ শতাংশ সম্পদ। সাধারণ হিন্দুদের তিনি মুসলমানদের ভয় দেখাচ্ছেন অথচ তাদের সম্পদ কেড়ে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের ধনী করছেন।

মোদির সমালোচনা থেকে পিছিয়ে পড়েননি সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব। তিনি বলেছেন, মোদি যে মিথ্যা বলেন, তা শুধু দেশবাসীই নয়, গোটা পৃথিবী জানে। যেভাবে তিনি কংগ্রেসের ‘ন্যায়পত্র’ ও মনমোহন সিংয়ের নামে মিথ্যা অপবাদ দিলেন, তা নোংরা রাজনীতির উদাহরণ।

মোদির ভাষণের সমর্থনে প্রথমে বিজেপি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় মনমোহন সিংয়ের সেই ভাষণের ২২ সেকেন্ডের এক ক্লিপিং। সেটা যে কত বড় প্রবঞ্চনা, তার প্রমাণে কংগ্রেস ওই ভাষণের প্রাসঙ্গিক অংশটুকু প্রচার করে। ২০০৬ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ওই ভাষণে তার সরকারের সম্মিলিত অগ্রাধিকার ব্যাখ্যা করেছিলেন। সেগুলো ছিল কৃষি, সেচ ও পানিসম্পদ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গ্রামীণ অবকাঠামো ও সাধারণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে লগ্নি। পাশাপাশি তিনি তফসিলি জাতি, উপজাতি, অনগ্রসর, সংখ্যালঘু, নারী ও শিশুদের উন্নয়নের জন্য কর্মসূচির কথা বলেছিলেন। মনমোহন সিং বলেছিলেন, তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের গৃহীত প্রকল্পগুলো পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়োজন। উন্নয়নের ফল লাভের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সমাজ, বিশেষ করে মুসলমান সংখ্যালঘুদের ক্ষমতায়নের নতুন উপায় বের করতে হবে। সম্পদের ওপর তাদের অধিকার সর্বাগ্রে। মনমোহন সিংয়ের দেওয়া ভাষণের মধ্য থেকে ১ মিনিট ১২ সেকেন্ডের এই অংশ প্রচার করে কংগ্রেস বুঝিয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কথা বিজেপি ও মোদি কীভাবে বিকৃত করেছেন। মনমোহন বলেছিলেন ক্ষমতায়নের কথা, মোদি বলেছেন মানুষের সম্পদ কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বাঁটোয়ারা করে দেওয়ার কথা। সেই সঙ্গে মুসলমানদের তিনি ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলতেও ছাড়েননি।

নির্বাচন কমিশনে প্রধানমন্ত্রী মোদির বিরুদ্ধে গাদাগাদা অভিযোগ পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু ঘটনা হলো, আজ পর্যন্ত মোদি বা অমিত শাহর বিরুদ্ধে কমিশন একবারও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় দফার ভোটের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলতে চলতেই তৃতীয় দফার পরিস্থিতি বুঝে পরিকল্পনা করছে নির্বাচন কমিশন। এতে বোঝা যাচ্ছে, প্রথম দুই দফার চেয়ে তৃতীয় দফাতে রাজ্যে আরো বেশি সংখ্যায় অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র থাকতে পারে। এবার রাজ্যের সব ভোটকেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করে ভোটে যাচ্ছে কমিশন। আর তাই, প্রতিটি বুথকেই বলা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু, তার পরেও আলাদা করে অতি ঝুঁকিপূর্ণ বুথ চিহ্নিত করা হচ্ছে। দ্বিতীয় দফায় রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রে সব থেকে বেশি ২৪ শতাংশ অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র চিহ্নিত হয়েছে। কমিশন অনুযায়ী, তৃতীয় দফার (৭ মে) চারটি লোকসভা কেন্দ্রেই তার চেয়ে অনেক বেশি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ভোটকেন্দ্র থাকার কথা।

রাজ্যে মুখ্য নির্বাচনি কর্মকর্তার দপ্তরসূত্রে জানা যাচ্ছে, মালদহ উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে ১ হাজার ৮২৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৬৫১টি (৩৬%) হলো অতি ঝুঁকিপূর্ণ। মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্রে ১ হাজার ৭৪৬টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৭০২টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ (৪০%)। ওই পর্যায়ে ভোটমুখী মুর্শিদাবাদের দু’টি কেন্দ্রও মালদহের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। জঙ্গিপুরে ১ হাজার ৮৫১টির মধ্যে ৭৬২টি (৪১%) এবং মুর্শিদাবাদে ১ হাজার ৯৩৮টির মধ্যে ৭১৫টি ভোটকেন্দ্র (৩৭%) অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে দেখা যাচ্ছে। তবে এখনই তৃতীয় পর্যায়ের জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা চূড়ান্ত বলা যাচ্ছে না। এই সংখ্যাগুলো পরিস্থিতি জরিপ করে পর্যবেক্ষকদের নির্দেশে আরো বাড়তে পারে। সাধারণত পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে ভোটের তিন-চারদিন আগে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কমিশনের বিধিমাফিক কোনো একটি ভোটকেন্দ্র বা বুথ ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে চিহ্নিত করার জন্য সেখানে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্পর্শকাতরতা দেখা হয়। সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এক বছর আগের পঞ্চায়েত ভোটের মানদণ্ড প্রাধান্য পাচ্ছে। পঞ্চায়েত ভোটের গোলমাল বা হিংসার ইতিহাস মাথায় রাখা হচ্ছে। কোনো একটি এলাকায় জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করার হার এবং গোলমাল পাকানোর মতো লোকের সংখ্যাও দেখা হয়। আর কমিশনের নিয়ম মতো কোনো একটি বুথে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়লে, কোনো একজন প্রার্থী ৭০ শতাংশের বেশি ভোট পেলে এবং কোনো একটি বুথে ১০ শতাংশের কম ভোট পড়লেও তা অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ধরা হয়। এই সব দিকগুলো বিচার করে এই সপ্তাহেই তৃতীয় পর্যায়ের ভোটের জন্যও আধা সামরিক বাহিনী মোতায়নের পরিকল্পনা যত দূর সম্ভব এগিয়ে রাখতে চায় কমিশন।

জনপ্রিয় সংবাদ

মূল্যস্ফীতি এখনো ঊর্ধ্বমুখী

ভারতের রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক

আপডেট সময় : ০৭:১৩:৪৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

➢ কংগ্রেসকে জড়িয়ে মুসলমানদের আক্রমণ মোদির
➢ মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী : রাহুল গান্ধী
➢ ভোটের জন্য মোদি মুসলমানদের গালি দিচ্ছেন : মাওলানা ওয়েইসি
➢ তৃতীয় দফার ভোটে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র বেশি পশ্চিমবঙ্গে

ভারতের লোকসভার প্রথম দফায় ভোটের হার আশানুরূপ না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরাসরি ধর্মীয় মেরুকরণের পথে হাঁটলেন বলে বিরোধীরা অভিযোগ করছেন। সাম্প্রতিক তেলেঙ্গানায় দেওয়া এক ভাষণে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, কোনো শ্রেণির হাতে দেশের কত সম্পদ, জাতগণনার পাশাপাশি ক্ষমতায় এলে কংগ্রেস তা জরিপ করে দেখবে। প্রধানমন্ত্রী মোদি শুধু ঘনিষ্ঠ কিছু পুঁজিপতির স্বার্থ দেখেন। তার আমলে দেশের ১ শতাংশ মানুষ ৪০ শতাংশ সম্পদের মালিক হয়েছেন। রাহুলের সেই ভাষণের রেশ ধরেই গত রোববার রাজস্থানের বাঁশবাড়া কেন্দ্রের এক নির্বাচনী জনসভায় মোদি বলেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে দেশের সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বিলি করে দেবে। পারিবারিক সোনা-রুপার সঙ্গে বিবাহিত নারীদের গলায় পরা পবিত্র মঙ্গলসূত্র পর্যন্ত তারা কেড়ে নিয়ে বাঁটোয়ারা করে দেবে। মুসলমানদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টন করার কথা কংগ্রেসের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মনমোহন সিংও বলেছিলেন, দেশের সম্পত্তির ওপর মুসলমানদের অধিকার সবার আগে।

এবারের ভোটে কংগ্রেস ও মুসলমানদের সমার্থক করে এভাবে প্রথম সরাসরি আক্রমণাত্মক হলেন নরেন্দ্র মোদি। এবং তা করতে গিয়ে তিনি যে দাবি করেছেন, তা সম্পূর্ণ ভুল বলে অভিযোগ করেছে কংগ্রেস। প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ ভারতের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কংগ্রেসসহ বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতারা ওই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেছেন, প্রথম দফার ভোট বিরুদ্ধে গেছে বলে প্রধানমন্ত্রীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওই ভাষণের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগও জানানো হয়েছে।

জনসভায় আসা মানুষের কাছে মোদি জানতে চান, তারা তাদের কষ্টার্জিত সম্পত্তি মুসলমানদের মধ্যে, যাদের অনেক বাচ্চাকাচ্চা হয় তাদের মধ্যে, অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বাঁটোয়ারা হতে দেবেন কি না। এ প্রশ্নের মধ্য দিয়ে মোদি বুঝিয়ে দিলেন, এ দেশের মুসলমানরা অনুপ্রবেশকারী। একমাত্র তারাই গাদাগাদা সন্তানের জন্ম দেন। মোদি বলেন, এবার কংগ্রেস তার ইশতেহারে বলেছে, ক্ষমতায় এলে আপনাদের রোজগারে অর্জিত সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বিলিবণ্টন করে দেবে। মা-বোনেদের কাছে থাকা সোনা-রুপার হিসাব কষা হবে। তারপর তা বিলি করা হবে তাঁদের মধ্যে, যারা অনুপ্রবেশকারী, যাঁদের অনেক বাচ্চাকাচ্চা হয়। মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্রও তাদের হাত থেকে রেহাই পাবে না। মোদি এই ভাবনাকে শহুরে নকশালদের মনোবৃত্তির সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি জানতে চান, জনগণ তা হতে দেবে কি না?

মোদির ওই ভাষণ সম্প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিরোধী মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, বেশ বোঝা যাচ্ছে, মোদি হতাশ হয়ে পড়েছেন। কারণ, প্রথম দফায় ‘ইন্ডিয়া’ জোট এগিয়ে গেছে। মোদি তাই ঘৃণা ভাষণের আশ্রয় নিয়েছেন। ক্ষমতার জন্য অসত্য কথা বলছেন। বিরোধীরা যা বলেনি, তা বলে মানুষকে বিপথে চালিত করছেন। আরএসএস ও বিজেপির প্রশিক্ষণই এমন।

রাহুল গান্ধী বলেন, এটা হতাশার লক্ষণ। প্রথম দফার ভোট বিরুদ্ধে গেছে বুঝতে পেরে প্রধানমন্ত্রী মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন। মিথ্যা ভাষণে তিনি এতটাই নিচে নেমেছেন যে, এখন মানুষের নজর ঘোরাতে চাইছেন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মনমোহন সিং বারবার মুসলিম সমাজের ক্ষমতায়নের কথা বলে এসেছেন। মোদি তা বিকৃত করছেন। কংগ্রেসের এবারের ইশতেহার বৈপ্লবিক। এবার মানুষ তার পরিবার, কর্মসংস্থান, ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভোট দেবে। অন্য ভাবনায় বিচ্যুত হবে না।

কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের প্রেসিডেন্ট নেতা ও হায়দারাবাদের সাংসদ মাওলানা আসাদ উদ্দিন ওয়েইসিও। এক্স হ্যান্ডেলে তিনি লেখেন, মোদি মুসলমানদের অনুপ্রবেশকারী বললেন। বহু সন্তানের জন্মদাতা বললেন। ২০০২ সালে থেকে এটাই তিনি করে আসছেন। মুসলমানদের গালি দিচ্ছেন। এটাই তার একমাত্র গ্যারান্টি। এসব করেন ভোট পাওয়ার জন্য। মোদির আমলেই দেশের ১ শতাংশ মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে ৪০ শতাংশ সম্পদ। সাধারণ হিন্দুদের তিনি মুসলমানদের ভয় দেখাচ্ছেন অথচ তাদের সম্পদ কেড়ে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের ধনী করছেন।

মোদির সমালোচনা থেকে পিছিয়ে পড়েননি সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব। তিনি বলেছেন, মোদি যে মিথ্যা বলেন, তা শুধু দেশবাসীই নয়, গোটা পৃথিবী জানে। যেভাবে তিনি কংগ্রেসের ‘ন্যায়পত্র’ ও মনমোহন সিংয়ের নামে মিথ্যা অপবাদ দিলেন, তা নোংরা রাজনীতির উদাহরণ।

মোদির ভাষণের সমর্থনে প্রথমে বিজেপি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় মনমোহন সিংয়ের সেই ভাষণের ২২ সেকেন্ডের এক ক্লিপিং। সেটা যে কত বড় প্রবঞ্চনা, তার প্রমাণে কংগ্রেস ওই ভাষণের প্রাসঙ্গিক অংশটুকু প্রচার করে। ২০০৬ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ওই ভাষণে তার সরকারের সম্মিলিত অগ্রাধিকার ব্যাখ্যা করেছিলেন। সেগুলো ছিল কৃষি, সেচ ও পানিসম্পদ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গ্রামীণ অবকাঠামো ও সাধারণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে লগ্নি। পাশাপাশি তিনি তফসিলি জাতি, উপজাতি, অনগ্রসর, সংখ্যালঘু, নারী ও শিশুদের উন্নয়নের জন্য কর্মসূচির কথা বলেছিলেন। মনমোহন সিং বলেছিলেন, তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের গৃহীত প্রকল্পগুলো পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়োজন। উন্নয়নের ফল লাভের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সমাজ, বিশেষ করে মুসলমান সংখ্যালঘুদের ক্ষমতায়নের নতুন উপায় বের করতে হবে। সম্পদের ওপর তাদের অধিকার সর্বাগ্রে। মনমোহন সিংয়ের দেওয়া ভাষণের মধ্য থেকে ১ মিনিট ১২ সেকেন্ডের এই অংশ প্রচার করে কংগ্রেস বুঝিয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কথা বিজেপি ও মোদি কীভাবে বিকৃত করেছেন। মনমোহন বলেছিলেন ক্ষমতায়নের কথা, মোদি বলেছেন মানুষের সম্পদ কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বাঁটোয়ারা করে দেওয়ার কথা। সেই সঙ্গে মুসলমানদের তিনি ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলতেও ছাড়েননি।

নির্বাচন কমিশনে প্রধানমন্ত্রী মোদির বিরুদ্ধে গাদাগাদা অভিযোগ পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু ঘটনা হলো, আজ পর্যন্ত মোদি বা অমিত শাহর বিরুদ্ধে কমিশন একবারও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় দফার ভোটের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলতে চলতেই তৃতীয় দফার পরিস্থিতি বুঝে পরিকল্পনা করছে নির্বাচন কমিশন। এতে বোঝা যাচ্ছে, প্রথম দুই দফার চেয়ে তৃতীয় দফাতে রাজ্যে আরো বেশি সংখ্যায় অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র থাকতে পারে। এবার রাজ্যের সব ভোটকেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করে ভোটে যাচ্ছে কমিশন। আর তাই, প্রতিটি বুথকেই বলা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু, তার পরেও আলাদা করে অতি ঝুঁকিপূর্ণ বুথ চিহ্নিত করা হচ্ছে। দ্বিতীয় দফায় রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রে সব থেকে বেশি ২৪ শতাংশ অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র চিহ্নিত হয়েছে। কমিশন অনুযায়ী, তৃতীয় দফার (৭ মে) চারটি লোকসভা কেন্দ্রেই তার চেয়ে অনেক বেশি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ভোটকেন্দ্র থাকার কথা।

রাজ্যে মুখ্য নির্বাচনি কর্মকর্তার দপ্তরসূত্রে জানা যাচ্ছে, মালদহ উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে ১ হাজার ৮২৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৬৫১টি (৩৬%) হলো অতি ঝুঁকিপূর্ণ। মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্রে ১ হাজার ৭৪৬টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৭০২টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ (৪০%)। ওই পর্যায়ে ভোটমুখী মুর্শিদাবাদের দু’টি কেন্দ্রও মালদহের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। জঙ্গিপুরে ১ হাজার ৮৫১টির মধ্যে ৭৬২টি (৪১%) এবং মুর্শিদাবাদে ১ হাজার ৯৩৮টির মধ্যে ৭১৫টি ভোটকেন্দ্র (৩৭%) অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে দেখা যাচ্ছে। তবে এখনই তৃতীয় পর্যায়ের জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা চূড়ান্ত বলা যাচ্ছে না। এই সংখ্যাগুলো পরিস্থিতি জরিপ করে পর্যবেক্ষকদের নির্দেশে আরো বাড়তে পারে। সাধারণত পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে ভোটের তিন-চারদিন আগে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কমিশনের বিধিমাফিক কোনো একটি ভোটকেন্দ্র বা বুথ ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে চিহ্নিত করার জন্য সেখানে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্পর্শকাতরতা দেখা হয়। সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এক বছর আগের পঞ্চায়েত ভোটের মানদণ্ড প্রাধান্য পাচ্ছে। পঞ্চায়েত ভোটের গোলমাল বা হিংসার ইতিহাস মাথায় রাখা হচ্ছে। কোনো একটি এলাকায় জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করার হার এবং গোলমাল পাকানোর মতো লোকের সংখ্যাও দেখা হয়। আর কমিশনের নিয়ম মতো কোনো একটি বুথে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়লে, কোনো একজন প্রার্থী ৭০ শতাংশের বেশি ভোট পেলে এবং কোনো একটি বুথে ১০ শতাংশের কম ভোট পড়লেও তা অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ধরা হয়। এই সব দিকগুলো বিচার করে এই সপ্তাহেই তৃতীয় পর্যায়ের ভোটের জন্যও আধা সামরিক বাহিনী মোতায়নের পরিকল্পনা যত দূর সম্ভব এগিয়ে রাখতে চায় কমিশন।