০২:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ট্রাফিক অব্যবস্থাপনায় বছরে ক্ষতি ৫৫ হাজার কোটি টাকার বেশি

কমছেই না ঢাকার যানজট-১

❖ বিশ্বের ধীরগতির শহর এখন ঢাকা
❖ প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৮০ লাখ কর্মঘণ্টা

 

⦿ ট্রাফিক সিগন্যালগুলো দেখার দায়িত্ব ঢাকার দুই সিটি কর্তৃপক্ষের : অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান
⦿ যানজট নিরসনে নীতির পরিবর্তন আনতে হবে : বুয়েটের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান

 

 

যত্রতত্র গাড়ির পার্কিং, নাজুক ট্রাফিক ব্যবস্থা, অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন, রাস্তা দখলসহ নানা কারণে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে রাজধানী ঢাকার যানজট। একই সঙ্গে প্রতিদিন বাড়ছে মানুষ ও যানবাহনের সংখ্যা। এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহরে পরিণত হয়েছে ব্যস্ততম মেগাসিটি ঢাকা। এতে কর্মস্থলে বা জরুরি কাজে যানবাহনে চলাচল করতে গিয়ে রাজধানীতে প্রতিদিন ৮০ লাখের বেশি কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। সব মিলে প্রতিদিনের ক্ষতি ১৫২ কোটি টাকার বেশি। আর বছরে তা ৫৫ হাজার কোটির বেশি। বুয়েটের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, একই সড়কে যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক সব ধরনের যানবাহন চলাচল করায় যানজট তীব্র আকার ধারণ করছে। যানজট নিরসনে নীতির পরিবর্তন আনতে হবে। সব সংস্থাকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান বলেন, রাস্তার ইন্টারসেকশনগুলোর ম্যানেজমেন্টগুলো আমরা দেখছি। তবে যেসব সড়কে যানবাহনের চাপ বেশি সেগুলো বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ঢাকার যানজট এড়াতে প্রতিনিয়ত কাজ করছে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্যচিত্র পাওয়া গেছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, তাপপ্রবাহের মধ্যেই পল্টন মোড় থেকে জিরো পয়েন্ট হয়ে সদরঘাট পর্যন্ত তীব্র যানজটে আটকে রয়েছে হাঁটাচলার পথটিও। স্থবির হয়ে পড়েছে রাস্তার চারদিক, নড়ছে না যানবাহনের চাকা, যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশের প্রাণান্তকর চেষ্টা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকা গণপরিবহনের যাত্রীরাও অতিষ্ঠ। অনেকেই গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যের দিকে রওনা করেছেন। কথা হয় ষাটোর্ধ্ব বাসযাত্রী ওমর আলীর সঙ্গে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে দৈনিক সুবজ বাংলাকে বলেন, আইনি পরামর্শ নিতে গাবতলী থেকে একটি বাসে ওঠেন বেলা ১১টার দিকে। দুপুর ১টায় কোর্ট চত্বরের অদুরে রায়সাহেব বাজারের চেম্বারে থাকতে বলেছেন আইনজীবী। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল আর বাসস্ট্যান্ড ছাড়াও যেখানে সেখানে থামিয়ে যাত্রী তুলে বাসটি গুলিস্তান পৌঁছাতেই দুপুর ২টা বেজে গেছে। গুলিস্তানে এসে দেখি, আধাঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও গাড়ির চাকা আর ঘুরেনা। ভ্যাপসা গরমেও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি।

 

চেম্বারে আইনজীবীকে না পাওয়ার শঙ্কায় বাস থেকে নেমে হেঁটে রওনা দিয়েছি। ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত কাজে প্রায় প্রতিদিনই ঢাকার একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে যান বাইকার মো. আমির হোসেন। তিনি দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, রাজধানীর অধিকাংশ সড়কই যানজটে নতজানু। যানজটের কারণে ৫ মিনিটের পথ পোরোতে সময় গড়িয়ে যায় এক থেকে দেড়ঘণ্টা। মালিবাগের আবুল হোটেল থেকে মেরুল বাড্ডা হয়ে কুড়িল বিশ্বরোড, মুগদা-খিলগাঁও-মানিকনগর, কাকরাইল-পল্টন-সদরঘাট, উত্তরার রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্স থেকে খিলক্ষেত-বনানী-মহাখালী, ফার্মগেট থেকে শাহবাগ-মৎস্যভবন মোড় হয়ে প্রেস ক্লাব-পল্টন মোড়, তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড় থেকে বনানী, গুলশান-১ ও ২, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে পান্থপথ মোড় হয়ে কারওয়ান বাজার মোড়, গ্রিনরোড, আজিমপুর থেকে নিউমার্কেট হয়ে ধানমন্ডি-২৭ নম্বর মিরপুর রোড, মিরপুর-পল্লবী, গাবতলী থেকে আসাদগেট পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই যানজট লেগে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অপরদিকে দৈনিক বাংলার মোড় থেকে ফকিরাপুল ও রাজারবাগ হয়ে খিলগাঁও রেলগেট পর্যন্ত গণপরিবহন না থাকায় পুরো সড়কটিই রিকশা আর লেগুনার দখলে থাকে। যানজটের অন্যতন কারণ হিসেবে ভুক্তভোগী আমির হোসেন বলেন, গণপরিবহনগুলো কে কার আগে যাত্রী তুলবে, এমন প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে দুই লেনের সড়কের দেড়অংশজুড়েই আড়াআড়ি করে বাস থামানোয় মুহূর্তের মধ্যে পুরো সড়কজুড়েই তীব্র যানজট লেগে যায়। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ট্রাফিক পুলিশ দিন-রাত রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে-পুড়ে যানজট এড়াতে দায়িত্ব পালন করলেও চালকরা অনেকেই ট্রাফিক আইন মেনে চলেন না। এতে মামলা দেওয়া ছাড়া ট্রাফিক পুলিশের আর কিছুই করার থাকে না।

সড়ক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, নগরায়ণের কারণে ভারী বর্ষণে সড়কে জলাবদ্ধতা আর তীব্র গরমে রাজধানীর সড়কগুলোতে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। যানজট নিরসনে নানামুখী উদ্যোগ নিলেও সমন্বয়হীনতার কারণে সবই যেন ব্যর্থতায় রূপধারণ করছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকাই যেন ঢাকাবাসীর নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহরের রেকর্ড গড়েছে রাজধানী ঢাকা।

যানজট নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও বুয়েটের গবেষণা বলছে, ২০২২ সালেই রাজধানীর সড়কে যানবাহনের গড় গতি নেমে এসেছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে। অপ্রতুল ও সরু রাস্তাঘাটের কারণে যানজট বাড়ছে। সাথে দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থা, যত্রতত্র পার্কিং, রাস্তা ও ফুটপাথ দখল, বিশৃঙ্খলভাবে যান চলাচলের কারণে পরিস্থিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।

বুয়েটের দুর্ঘটনা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুযায়ী, যানজটের কারণে রাজধানীতে প্রতিদিন ৮০ লাখের বেশি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। সবমিলে প্রতিদিনের ক্ষতি ১৫২ কোটি টাকার বেশি। যানজটের কারণে বছরে জিডিপির ক্ষতি ২.৯ শতাংশ। একদিকে বিনিয়োগ বাড়ছে, অন্যদিকে যানজটের কারণে গতি কমছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, আমাদের দেশের সড়কগুলোর সক্ষমতার চেয়ে যানবাহনের সংখ্যা ৩-৪ গুণ বেশি। একই সড়ক দিয়ে চলছে দ্রত ও ধীরগতির সব ধরনের যান। এর ফলে যতই উদ্যোগ নেওয়া হোক না কেন, সহসাই যানজট নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভভ হবে না। গণপরিবহন মানেই নির্দিষ্ট একটি সময়সূচিতে গন্তব্যে পৌঁছাবে। কিন্তু কোনো যাত্রীবাহী বাস যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে? এখন মেট্রো রেলকে আমরা গণপরিবহন বলতে পারি। মেট্রো রেলটি নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে। তবে যানজটের নগরীতে আশার আলো দেখাচ্ছে মেট্রো রেল। তিনি বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ জানে, তাদের সড়কের সক্ষমতা কতটুকু? বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গাড়ি আমদানির অনুমোদন দিচ্ছে, বিআরটিএ বিক্রিত গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দিচ্ছে। কোনো সংস্থার সঙ্গে কারও কোনো সমন্বয় নেই।

ট্রাফিক পুলিশ অনেক চেষ্টা করছে। তাদের তো একটা চোখ রয়েছে। একজন মানুষের পক্ষে কতক্ষণ সম্ভভ সেন্সর প্রয়োগ করা। অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, গণপরিবহনকে আমরা যদি ঢেলে সাজাতে না পারি, তবে মেট্রো দিয়ে ঢাকা শহরে যানজট নিরসন করা যাবে না। যানজটের মূলেই ৫০ বছরের পুরোনো গাড়ি চলাচল, অবৈধ ইজিবাইক, অটোরিকশা, অদক্ষ চালক দ্বারা গাড়ি চালানো। যানজট নিরসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সব সংস্থাকে একসঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। আমাদের নীতির পরিবর্তন আনতে হবে। সড়কে কোম্পানিভিত্তিক বাস চালাতে হবে। আনফিট গাড়িগুলো দ্রুত ধ্বংস করতে হবে। গাড়ির সংখ্যা কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই সড়কের সক্ষমতা তৈরি হবে, যানজটের অবসানসহ গতি ফিরবে গাড়িতে।

অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মনিবুর রহমান দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, যানজট নিরসনের জন্য আমরা বিভিন্ন রাস্তার ইন্টারসেকশনগুলোর ম্যানেজমেন্টগুলো দেখি। পার্কিংগুলো দেখি। অবৈধ পার্কিং যতটা দূর করা যায় সেটা দেখি। গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা যেখানে গাড়ি চলাচল বেশি সেখানে প্রায়োরিটি বেশি দিই। আবার লোকজন রাস্তা পারাপার হয় তাদেরকে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করার জন্য বলি।

এগুলো আসলে অনেক ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ঢাকা শহরের বাসস্টপেজগুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা এই উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়। এগুলো হয়ে আসছে। তিনি বলেন, ট্রাফিক সিগন্যালটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। এটার টেকনিক্যাল যে বিষয়গুলো, যান্ত্রিক-কারিগরি বিষয়গুলো দেখার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। এখানে একটা কনফিউশন হয়। লাইটগুলো মেইনটেইন করবে তারা। আর প্রযুক্তিগত দিকগুলো তারা দেখবে, টেকনিক্যাল দিকগুলো তারা দেখবে, ম্যানপাওয়ারও তাদের। আমরা শুধু ঠিক থাকলে লাইট অনুযায়ী, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টগুলো আমরা চালাই।

জনপ্রিয় সংবাদ

স্মৃতিসৌধে তারেক রহমান

ট্রাফিক অব্যবস্থাপনায় বছরে ক্ষতি ৫৫ হাজার কোটি টাকার বেশি

আপডেট সময় : ০৪:৪৭:৫৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪

❖ বিশ্বের ধীরগতির শহর এখন ঢাকা
❖ প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৮০ লাখ কর্মঘণ্টা

 

⦿ ট্রাফিক সিগন্যালগুলো দেখার দায়িত্ব ঢাকার দুই সিটি কর্তৃপক্ষের : অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান
⦿ যানজট নিরসনে নীতির পরিবর্তন আনতে হবে : বুয়েটের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান

 

 

যত্রতত্র গাড়ির পার্কিং, নাজুক ট্রাফিক ব্যবস্থা, অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন, রাস্তা দখলসহ নানা কারণে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে রাজধানী ঢাকার যানজট। একই সঙ্গে প্রতিদিন বাড়ছে মানুষ ও যানবাহনের সংখ্যা। এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহরে পরিণত হয়েছে ব্যস্ততম মেগাসিটি ঢাকা। এতে কর্মস্থলে বা জরুরি কাজে যানবাহনে চলাচল করতে গিয়ে রাজধানীতে প্রতিদিন ৮০ লাখের বেশি কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। সব মিলে প্রতিদিনের ক্ষতি ১৫২ কোটি টাকার বেশি। আর বছরে তা ৫৫ হাজার কোটির বেশি। বুয়েটের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, একই সড়কে যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক সব ধরনের যানবাহন চলাচল করায় যানজট তীব্র আকার ধারণ করছে। যানজট নিরসনে নীতির পরিবর্তন আনতে হবে। সব সংস্থাকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান বলেন, রাস্তার ইন্টারসেকশনগুলোর ম্যানেজমেন্টগুলো আমরা দেখছি। তবে যেসব সড়কে যানবাহনের চাপ বেশি সেগুলো বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ঢাকার যানজট এড়াতে প্রতিনিয়ত কাজ করছে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্যচিত্র পাওয়া গেছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, তাপপ্রবাহের মধ্যেই পল্টন মোড় থেকে জিরো পয়েন্ট হয়ে সদরঘাট পর্যন্ত তীব্র যানজটে আটকে রয়েছে হাঁটাচলার পথটিও। স্থবির হয়ে পড়েছে রাস্তার চারদিক, নড়ছে না যানবাহনের চাকা, যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশের প্রাণান্তকর চেষ্টা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকা গণপরিবহনের যাত্রীরাও অতিষ্ঠ। অনেকেই গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যের দিকে রওনা করেছেন। কথা হয় ষাটোর্ধ্ব বাসযাত্রী ওমর আলীর সঙ্গে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে দৈনিক সুবজ বাংলাকে বলেন, আইনি পরামর্শ নিতে গাবতলী থেকে একটি বাসে ওঠেন বেলা ১১টার দিকে। দুপুর ১টায় কোর্ট চত্বরের অদুরে রায়সাহেব বাজারের চেম্বারে থাকতে বলেছেন আইনজীবী। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল আর বাসস্ট্যান্ড ছাড়াও যেখানে সেখানে থামিয়ে যাত্রী তুলে বাসটি গুলিস্তান পৌঁছাতেই দুপুর ২টা বেজে গেছে। গুলিস্তানে এসে দেখি, আধাঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও গাড়ির চাকা আর ঘুরেনা। ভ্যাপসা গরমেও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি।

 

চেম্বারে আইনজীবীকে না পাওয়ার শঙ্কায় বাস থেকে নেমে হেঁটে রওনা দিয়েছি। ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত কাজে প্রায় প্রতিদিনই ঢাকার একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে যান বাইকার মো. আমির হোসেন। তিনি দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, রাজধানীর অধিকাংশ সড়কই যানজটে নতজানু। যানজটের কারণে ৫ মিনিটের পথ পোরোতে সময় গড়িয়ে যায় এক থেকে দেড়ঘণ্টা। মালিবাগের আবুল হোটেল থেকে মেরুল বাড্ডা হয়ে কুড়িল বিশ্বরোড, মুগদা-খিলগাঁও-মানিকনগর, কাকরাইল-পল্টন-সদরঘাট, উত্তরার রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্স থেকে খিলক্ষেত-বনানী-মহাখালী, ফার্মগেট থেকে শাহবাগ-মৎস্যভবন মোড় হয়ে প্রেস ক্লাব-পল্টন মোড়, তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড় থেকে বনানী, গুলশান-১ ও ২, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে পান্থপথ মোড় হয়ে কারওয়ান বাজার মোড়, গ্রিনরোড, আজিমপুর থেকে নিউমার্কেট হয়ে ধানমন্ডি-২৭ নম্বর মিরপুর রোড, মিরপুর-পল্লবী, গাবতলী থেকে আসাদগেট পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই যানজট লেগে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অপরদিকে দৈনিক বাংলার মোড় থেকে ফকিরাপুল ও রাজারবাগ হয়ে খিলগাঁও রেলগেট পর্যন্ত গণপরিবহন না থাকায় পুরো সড়কটিই রিকশা আর লেগুনার দখলে থাকে। যানজটের অন্যতন কারণ হিসেবে ভুক্তভোগী আমির হোসেন বলেন, গণপরিবহনগুলো কে কার আগে যাত্রী তুলবে, এমন প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে দুই লেনের সড়কের দেড়অংশজুড়েই আড়াআড়ি করে বাস থামানোয় মুহূর্তের মধ্যে পুরো সড়কজুড়েই তীব্র যানজট লেগে যায়। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ট্রাফিক পুলিশ দিন-রাত রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে-পুড়ে যানজট এড়াতে দায়িত্ব পালন করলেও চালকরা অনেকেই ট্রাফিক আইন মেনে চলেন না। এতে মামলা দেওয়া ছাড়া ট্রাফিক পুলিশের আর কিছুই করার থাকে না।

সড়ক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, নগরায়ণের কারণে ভারী বর্ষণে সড়কে জলাবদ্ধতা আর তীব্র গরমে রাজধানীর সড়কগুলোতে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। যানজট নিরসনে নানামুখী উদ্যোগ নিলেও সমন্বয়হীনতার কারণে সবই যেন ব্যর্থতায় রূপধারণ করছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকাই যেন ঢাকাবাসীর নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহরের রেকর্ড গড়েছে রাজধানী ঢাকা।

যানজট নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও বুয়েটের গবেষণা বলছে, ২০২২ সালেই রাজধানীর সড়কে যানবাহনের গড় গতি নেমে এসেছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে। অপ্রতুল ও সরু রাস্তাঘাটের কারণে যানজট বাড়ছে। সাথে দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থা, যত্রতত্র পার্কিং, রাস্তা ও ফুটপাথ দখল, বিশৃঙ্খলভাবে যান চলাচলের কারণে পরিস্থিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।

বুয়েটের দুর্ঘটনা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুযায়ী, যানজটের কারণে রাজধানীতে প্রতিদিন ৮০ লাখের বেশি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। সবমিলে প্রতিদিনের ক্ষতি ১৫২ কোটি টাকার বেশি। যানজটের কারণে বছরে জিডিপির ক্ষতি ২.৯ শতাংশ। একদিকে বিনিয়োগ বাড়ছে, অন্যদিকে যানজটের কারণে গতি কমছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, আমাদের দেশের সড়কগুলোর সক্ষমতার চেয়ে যানবাহনের সংখ্যা ৩-৪ গুণ বেশি। একই সড়ক দিয়ে চলছে দ্রত ও ধীরগতির সব ধরনের যান। এর ফলে যতই উদ্যোগ নেওয়া হোক না কেন, সহসাই যানজট নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভভ হবে না। গণপরিবহন মানেই নির্দিষ্ট একটি সময়সূচিতে গন্তব্যে পৌঁছাবে। কিন্তু কোনো যাত্রীবাহী বাস যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে? এখন মেট্রো রেলকে আমরা গণপরিবহন বলতে পারি। মেট্রো রেলটি নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে। তবে যানজটের নগরীতে আশার আলো দেখাচ্ছে মেট্রো রেল। তিনি বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ জানে, তাদের সড়কের সক্ষমতা কতটুকু? বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গাড়ি আমদানির অনুমোদন দিচ্ছে, বিআরটিএ বিক্রিত গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দিচ্ছে। কোনো সংস্থার সঙ্গে কারও কোনো সমন্বয় নেই।

ট্রাফিক পুলিশ অনেক চেষ্টা করছে। তাদের তো একটা চোখ রয়েছে। একজন মানুষের পক্ষে কতক্ষণ সম্ভভ সেন্সর প্রয়োগ করা। অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, গণপরিবহনকে আমরা যদি ঢেলে সাজাতে না পারি, তবে মেট্রো দিয়ে ঢাকা শহরে যানজট নিরসন করা যাবে না। যানজটের মূলেই ৫০ বছরের পুরোনো গাড়ি চলাচল, অবৈধ ইজিবাইক, অটোরিকশা, অদক্ষ চালক দ্বারা গাড়ি চালানো। যানজট নিরসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সব সংস্থাকে একসঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। আমাদের নীতির পরিবর্তন আনতে হবে। সড়কে কোম্পানিভিত্তিক বাস চালাতে হবে। আনফিট গাড়িগুলো দ্রুত ধ্বংস করতে হবে। গাড়ির সংখ্যা কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই সড়কের সক্ষমতা তৈরি হবে, যানজটের অবসানসহ গতি ফিরবে গাড়িতে।

অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মনিবুর রহমান দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, যানজট নিরসনের জন্য আমরা বিভিন্ন রাস্তার ইন্টারসেকশনগুলোর ম্যানেজমেন্টগুলো দেখি। পার্কিংগুলো দেখি। অবৈধ পার্কিং যতটা দূর করা যায় সেটা দেখি। গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা যেখানে গাড়ি চলাচল বেশি সেখানে প্রায়োরিটি বেশি দিই। আবার লোকজন রাস্তা পারাপার হয় তাদেরকে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করার জন্য বলি।

এগুলো আসলে অনেক ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ঢাকা শহরের বাসস্টপেজগুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা এই উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়। এগুলো হয়ে আসছে। তিনি বলেন, ট্রাফিক সিগন্যালটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। এটার টেকনিক্যাল যে বিষয়গুলো, যান্ত্রিক-কারিগরি বিষয়গুলো দেখার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। এখানে একটা কনফিউশন হয়। লাইটগুলো মেইনটেইন করবে তারা। আর প্রযুক্তিগত দিকগুলো তারা দেখবে, টেকনিক্যাল দিকগুলো তারা দেখবে, ম্যানপাওয়ারও তাদের। আমরা শুধু ঠিক থাকলে লাইট অনুযায়ী, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টগুলো আমরা চালাই।