০৭:২১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সাংবাদিকদেরও একটা রাজনীতি আছে : মাহমুদা চৌধুরী

স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় যেসব নারী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মাহমুদা চৌধুরী। তিনি চল্লিশ বছর ধরে এই পেশায় থেকে পেশাকে সমৃদ্ধ করেছেন। দীর্ঘ সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে পেরিয়েছেন নানা চড়াই-উৎরাই। তিনি একান্ত আলাপচারিতায় বলেছেন, তার জীবনের না বলা অনেক কথা। তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন দৈনিক সবুজ বাংলা’র রিপোর্টার তাসকিনা ইয়াসমিন। আজ থেকে ধারাবাহিকভাবে তার সাক্ষাতকার ছাপা হচ্ছে।

পর্ব-১

মাহমুদা চৌধুরী বলেন, আমার সাংবাদিকতা করার অনেক তৃষ্ণা ছিল। আমাদের বাসায় দুটো পত্রিকা আসত। মর্নিং নিউজ এবং ইত্তেফাক। পরবর্তীতে অবশ্য দৈনিক পাকিস্তান বেরিয়েছিল সেটা আসত। আমি লক্ষ্য করে দেখতাম মামা-চাচা-বাবা প্রত্যেকেই যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এছাড়া আরও কয়েকটা পত্রিকা আসত আমাদের বাসায়, সিনেমার পত্রিকা। কলকাতা থেকে ছবির পত্রিকা আসত উল্টোরথ, প্রসাদ। তারপর জলসা।

তখনও পড়তে শিখিনি কিন্তু ছবি দেখতে খুব ভাল লাগত। তখন সপরিবারে ছবি দেখার একটা চল ছিল। ঐ ছবি দেখতে যেয়ে ছবির মেয়েদের দেখতাম। তখন আমি একটু বড় হয়েছি। ঢাকায় পত্রিকা বেরিয়েছে চিত্রালি, সিনেমা। তারপর পূর্বানী বের হয়েছে আরও পরে। তখন যেই পত্রিকা বের হতো আমার মা-চাচারা সবাই মিলে এই পত্রিকা বাসায় রাখতই। মাকে দেখতাম দুপুরবেলায় খেয়ে দেয়ে ইজি চেয়ারে চুল ছড়িয়ে দিয়ে হেলান দিয়ে পত্রিকাগুলো পড়ত। আর ঐ যে লাল পাড়ের মতো শাড়ী ছিল তখন। নারীরা সাদা শাড়ি পরত। চিকন পাড়ের। আমার মাও সাদা শাড়ি পরত। এই শাড়িগুলো ছিল রোহিনী কটন মিলের। সাদা কিন্তু খুব ফিনফিনে। এখন ঐ ধরণের শাড়ি আমি আর দেখিনা। ঐ শাড়িগুলো পরে মা পত্রিকা পড়তেন।

শাড়ি বিষয়ক কিন্তু একটা গল্প আছে। আমার মনে হয়, শাড়িগুলো তখন মেয়েরা পরতে পছন্দ করত। কারণ তখন মেয়েদের ঘরোয়া শিল্প কাঁথা সেলাই। ঐ শাড়ির পাড়টা দিয়ে সুতা বের হতো। সেই সুতা দিয়ে মেয়েরা কাঁথা সেলাই করত। যে কারণে এই শাড়ির কদর ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে। সেই চিকন শাড়ির মিলটাতো এখন উঠে গেছে। তখন বেগম পত্রিকাতে এই শাড়ির একটা না একটা এড থাকতই।

 

পড়ুয়া মা এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তাকে দিয়েছিল সাংবাদিকতার প্রথম দীক্ষা:

পরে যখন আমি পড়তে শিখলাম আমি বেগম পত্রিকা পড়া শুরু করলাম। আর এদিকে ইত্তেফাক পড়তাম। ইত্তেফাকে যে নিউজগুলো থাকত, যখন আমি পড়া শুরু করেছি তখন একদম উপরে যে হেয়ারিং থাকে সেখান থেকে পড়া শুরু করতাম। এরপর নিচে প্রকাশকের নাম পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম। মাও খুব বকা লাগাত। বলত ওর জন্য পত্রিকা আমি হাতেই পাইনা। ও এত মগ্ন হয়ে থাকে। বিরক্ত লাগে। এটা বলে মা বকা লাগাত। আর এভাবেই আমার সেই সময় মনে হতো যে, ছেলেদের নাম দেখি কোন মেয়েদের নাম কেন নাই? আমার মনে হতো মেয়েরা কি এগুলো লিখতে পারেনা! মেয়েরা কেন লিখে না? আর একটা বিষয় হয়েছিল, সেই সময় একটা ধারাবাহিক বেরিয়েছিল পাবনা মানসিক হাসপাতালকে নিয়ে। অসাধারণ সব স্টোরি ছিল।

ওটা পড়তাম মগ্ন হয়ে আর খুব কষ্ট পেতাম। আর ভাবতাম যদি আমি সাংবাদিক হতাম তাহলে তো আমি এমন করে লিখতে পারতাম। ক্লাস ফাইভে আমার মেজ চাচা একটা বই এনে দেয় পথের পাঁচালি। এতে একটা ছবি ছিল ছোট্ট একটা মেয়ে আর ছোট ছেলে। দুই ভাইবোনের একটা ছবি। আমার খুব ভাল লাগত। আমরাও দুই ভাইবোন খুব বন্ধু ছিলাম। যখন ছোট ছিলাম মারামারি করতাম, যা কিছু করতাম আমরা দুই ভাইবোনেই সবকিছু করতাম। আমাদের পরের ভাইবোনদের সঙ্গে অতটা করতাম না। ওরা অনেক ছোট ছোট ছিল। সতজ্যিৎ রায়ের বই। আমি সেটা দেখে গল্প না যেন আমাদের দুই ভাইবোনকেই দেখলাম। আমার ভিতরে আর একটা বিষয় কাজ করত। আমার ভাইবোনরা সবাই ফর্সা। সবাই সুন্দর দেখতে। খাড়া নাক। আর আমার নাকগুলো বোঁচা বোঁচা। চোখগুলো ভিতর দিকে। আর কালো কুঁঁচকুঁচে একটা মেয়ে। মেহমান যখন আসত বাড়িতে। তখন তো খুব নিয়ম কানুন মানা হতো। এই তোমরা আস। সালাম দাও। মেহমান এসেছে।

তখন গিয়ে দাঁড়াতাম, দাঁড়িয়ে সালাম দিতাম আসসালামু আলাইকুম। আমার দিকে তাকিয়ে মাকে সবাই বলত যে এই এটা কি তোমার মেয়ে? আমি তখন বুঝতাম না। তখন আমার মা হেসে বলতেন, না, ও আমার মেয়ে না, ও আমার কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। এভাবে বলত তো, আমি মনে মনে ভাবতাম যে, আমার মা তো না এটা তো আমার সৎমা। আর আমার মা আমাকে মারত। দুষ্টামি করতাম যে, মা আমাকে মারত। তখন তো শিশুদের কথা বলতে দিত না। মারত বেশি। সেও তো তখন তরুণী। তার জেদ বেশি ছিল। এটা করবে না। সেটা করবে না। এসব সে নিষেধ করত। অমুকের বাসায় যেয়ে কেন তুই আগে বললি যে আমি খাব। আমি লজ্জা পেলাম। তুই খাব বললি কেন? আমি ভাবতাম, মা আমাকে মারে। কই আমার ভাইটাকে তো মারে না। নিশ্চয় আমার সৎ মা। যখনই আমাকে মারত কিম্বা বকা দিত তখন আমি কাঁদতাম। কেউ যদি জিজ্ঞেস করত যে, কাঁদিস কেন? আমি তখন বলতাম যে, আমাকে মেরেছে। কে মেরেছে? সেটা আমার সৎ মা। ঐরকম একটা ফিলিংস থেকে আমি বইয়ের মধ্যে মগ্ন হয়ে গেলাম।

আমার মনে হতো, আমি লিখব। যদি সাংবাদিক হওয়া যায় তো হবো। বাসায় কোন সাংবাদিক আসলে আমার মনে হতো যে, চোখের সামনে যেন একজন লিজেন্ডকে দেখতে পাচ্ছি। যেন একটা রাজকুমার। ইনি সংবাদপত্রে লিখে! ইনি সাংবাদিক! মনে হতো আহা আমি যদি সাংবাদিক হতে পারতাম! সেই যে শুরু হয়েছিল। পরে, ধামাচাপা পড়ে যায়। বিয়ে টিয়ে হয়ে যায়।

 

 

খোদ রাজধানীতে বড় হয়েও বাল্যবিবাহের ঝুঁকির মধ্যে ছিলাম আমরা পুরান ঢাকার মেয়েরা:

আমরা পুরান ঢাকার মেয়েরা। এখন আমি বলি, আমরা শহরের অনেকেই এগিয়েছি। গ্রামেরও অনেকেই এগিয়েছি। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু গ্রাম যেমন থাকে। ঢাকা শহরে তখন দুইটা শ্রেণি ছিল। আমরা একটু নিম্নমধ্যবিত্ত কিম্বা একটা শ্রেণি ছিল মধ্যবিত্ত। আর একটা আপার ক্লাস বা উচ্চবিত্ত। দুইটা সমাজ ছিল তখন। ধনীরা ওয়ারী, গেন্ডারিয়া এসব যায়গায় থাকত। আমরা যারা কিনা লোয়ার মিডল ক্লাস কিম্বা মিডল ক্লাস। আমরা পুরান ঢাকার এদিকটায় থাকতাম। আমার দাদা ডাক্তার ছিলেন। পাড়ার সবার বড় পরিবার ছিল। তারা উর্দু স্পিকিং ছিল।

কিন্তু খুব কনজারভেটিভ পাড়া ছিল। আমরা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে স্কুলে যেতাম। ঘোড়ার গাড়িতে চলাফেরা করতে হতো। আমরা ছোটবেলায় খেলতাম পাড়ায়। কিন্তু যেই আমরা কিশোরী হলাম অমনি রাস্তা থেকে সব মেয়েরা উধাও হয়ে গেল। মেয়েরা সব জানালার কাছে বসে থাকে। মেয়ে তাই আর খেলতে পারবেনা। আমি ছোট বেলায় ঘুড়ি উড়াতাম। ছাদে যেতাম। কিন্তু আমাদের পাড়ার মেয়েরা সবাই সাংষ্কৃতিকভাবে উন্নত হয়েছিল। পাড়ায় একটা সাংস্কৃতিক ক্লাব ছিল। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। তো আমাদের গলির মুখে ছিল লিও, এহতেশাম, মোস্তাফিজুর রহমান ওদের বাড়ি। ওদের বাড়িতে লিও ফ্লিমসের অফিস ছিল। ওখানে আসত নায়ক-নায়িকারা। শ্যুটিং হতো। আমরা স্কুলে থাকতে দলবেঁধে সেখানে যেতাম। এহতেশামের মেয়ে ছিল ফারজানা।

সে আমাদের বয়স। সে আমাদের বন্ধু ছিল। আমরাও ওর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। ঐ ফাঁকে শ্যুটিংয়ে কখনও কখনও রিহার্সাল হতো। ৬২’র দিকে, ঝর্না বসাক, নার্গিস মোরশেদা, এরা আমাদের দেশের মেয়েরা নাচের প্র্যাকটিস করছে। তখন আমার সিনেমার প্রতি একটা আগ্রহ ছিল। এত সিনেমা দেখি কিন্তু সিনেমার শ্যুটিং দেখতে ভাল লাগত। ঐভাবে হয়ত খবরের অন্বেষণটা দেখে দেখে সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। দেখে দেখে মনে বিদ্রোহী হয়ে উঠল সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছেটা আর লেখালেখি করার ইচ্ছে টা।

জনপ্রিয় সংবাদ

একনেক সভায় ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকার ২২ প্রকল্প অনুমোদন

সাংবাদিকদেরও একটা রাজনীতি আছে : মাহমুদা চৌধুরী

আপডেট সময় : ১১:০৩:৫১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ মে ২০২৪

স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় যেসব নারী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মাহমুদা চৌধুরী। তিনি চল্লিশ বছর ধরে এই পেশায় থেকে পেশাকে সমৃদ্ধ করেছেন। দীর্ঘ সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে পেরিয়েছেন নানা চড়াই-উৎরাই। তিনি একান্ত আলাপচারিতায় বলেছেন, তার জীবনের না বলা অনেক কথা। তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন দৈনিক সবুজ বাংলা’র রিপোর্টার তাসকিনা ইয়াসমিন। আজ থেকে ধারাবাহিকভাবে তার সাক্ষাতকার ছাপা হচ্ছে।

পর্ব-১

মাহমুদা চৌধুরী বলেন, আমার সাংবাদিকতা করার অনেক তৃষ্ণা ছিল। আমাদের বাসায় দুটো পত্রিকা আসত। মর্নিং নিউজ এবং ইত্তেফাক। পরবর্তীতে অবশ্য দৈনিক পাকিস্তান বেরিয়েছিল সেটা আসত। আমি লক্ষ্য করে দেখতাম মামা-চাচা-বাবা প্রত্যেকেই যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এছাড়া আরও কয়েকটা পত্রিকা আসত আমাদের বাসায়, সিনেমার পত্রিকা। কলকাতা থেকে ছবির পত্রিকা আসত উল্টোরথ, প্রসাদ। তারপর জলসা।

তখনও পড়তে শিখিনি কিন্তু ছবি দেখতে খুব ভাল লাগত। তখন সপরিবারে ছবি দেখার একটা চল ছিল। ঐ ছবি দেখতে যেয়ে ছবির মেয়েদের দেখতাম। তখন আমি একটু বড় হয়েছি। ঢাকায় পত্রিকা বেরিয়েছে চিত্রালি, সিনেমা। তারপর পূর্বানী বের হয়েছে আরও পরে। তখন যেই পত্রিকা বের হতো আমার মা-চাচারা সবাই মিলে এই পত্রিকা বাসায় রাখতই। মাকে দেখতাম দুপুরবেলায় খেয়ে দেয়ে ইজি চেয়ারে চুল ছড়িয়ে দিয়ে হেলান দিয়ে পত্রিকাগুলো পড়ত। আর ঐ যে লাল পাড়ের মতো শাড়ী ছিল তখন। নারীরা সাদা শাড়ি পরত। চিকন পাড়ের। আমার মাও সাদা শাড়ি পরত। এই শাড়িগুলো ছিল রোহিনী কটন মিলের। সাদা কিন্তু খুব ফিনফিনে। এখন ঐ ধরণের শাড়ি আমি আর দেখিনা। ঐ শাড়িগুলো পরে মা পত্রিকা পড়তেন।

শাড়ি বিষয়ক কিন্তু একটা গল্প আছে। আমার মনে হয়, শাড়িগুলো তখন মেয়েরা পরতে পছন্দ করত। কারণ তখন মেয়েদের ঘরোয়া শিল্প কাঁথা সেলাই। ঐ শাড়ির পাড়টা দিয়ে সুতা বের হতো। সেই সুতা দিয়ে মেয়েরা কাঁথা সেলাই করত। যে কারণে এই শাড়ির কদর ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে। সেই চিকন শাড়ির মিলটাতো এখন উঠে গেছে। তখন বেগম পত্রিকাতে এই শাড়ির একটা না একটা এড থাকতই।

 

পড়ুয়া মা এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তাকে দিয়েছিল সাংবাদিকতার প্রথম দীক্ষা:

পরে যখন আমি পড়তে শিখলাম আমি বেগম পত্রিকা পড়া শুরু করলাম। আর এদিকে ইত্তেফাক পড়তাম। ইত্তেফাকে যে নিউজগুলো থাকত, যখন আমি পড়া শুরু করেছি তখন একদম উপরে যে হেয়ারিং থাকে সেখান থেকে পড়া শুরু করতাম। এরপর নিচে প্রকাশকের নাম পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম। মাও খুব বকা লাগাত। বলত ওর জন্য পত্রিকা আমি হাতেই পাইনা। ও এত মগ্ন হয়ে থাকে। বিরক্ত লাগে। এটা বলে মা বকা লাগাত। আর এভাবেই আমার সেই সময় মনে হতো যে, ছেলেদের নাম দেখি কোন মেয়েদের নাম কেন নাই? আমার মনে হতো মেয়েরা কি এগুলো লিখতে পারেনা! মেয়েরা কেন লিখে না? আর একটা বিষয় হয়েছিল, সেই সময় একটা ধারাবাহিক বেরিয়েছিল পাবনা মানসিক হাসপাতালকে নিয়ে। অসাধারণ সব স্টোরি ছিল।

ওটা পড়তাম মগ্ন হয়ে আর খুব কষ্ট পেতাম। আর ভাবতাম যদি আমি সাংবাদিক হতাম তাহলে তো আমি এমন করে লিখতে পারতাম। ক্লাস ফাইভে আমার মেজ চাচা একটা বই এনে দেয় পথের পাঁচালি। এতে একটা ছবি ছিল ছোট্ট একটা মেয়ে আর ছোট ছেলে। দুই ভাইবোনের একটা ছবি। আমার খুব ভাল লাগত। আমরাও দুই ভাইবোন খুব বন্ধু ছিলাম। যখন ছোট ছিলাম মারামারি করতাম, যা কিছু করতাম আমরা দুই ভাইবোনেই সবকিছু করতাম। আমাদের পরের ভাইবোনদের সঙ্গে অতটা করতাম না। ওরা অনেক ছোট ছোট ছিল। সতজ্যিৎ রায়ের বই। আমি সেটা দেখে গল্প না যেন আমাদের দুই ভাইবোনকেই দেখলাম। আমার ভিতরে আর একটা বিষয় কাজ করত। আমার ভাইবোনরা সবাই ফর্সা। সবাই সুন্দর দেখতে। খাড়া নাক। আর আমার নাকগুলো বোঁচা বোঁচা। চোখগুলো ভিতর দিকে। আর কালো কুঁঁচকুঁচে একটা মেয়ে। মেহমান যখন আসত বাড়িতে। তখন তো খুব নিয়ম কানুন মানা হতো। এই তোমরা আস। সালাম দাও। মেহমান এসেছে।

তখন গিয়ে দাঁড়াতাম, দাঁড়িয়ে সালাম দিতাম আসসালামু আলাইকুম। আমার দিকে তাকিয়ে মাকে সবাই বলত যে এই এটা কি তোমার মেয়ে? আমি তখন বুঝতাম না। তখন আমার মা হেসে বলতেন, না, ও আমার মেয়ে না, ও আমার কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। এভাবে বলত তো, আমি মনে মনে ভাবতাম যে, আমার মা তো না এটা তো আমার সৎমা। আর আমার মা আমাকে মারত। দুষ্টামি করতাম যে, মা আমাকে মারত। তখন তো শিশুদের কথা বলতে দিত না। মারত বেশি। সেও তো তখন তরুণী। তার জেদ বেশি ছিল। এটা করবে না। সেটা করবে না। এসব সে নিষেধ করত। অমুকের বাসায় যেয়ে কেন তুই আগে বললি যে আমি খাব। আমি লজ্জা পেলাম। তুই খাব বললি কেন? আমি ভাবতাম, মা আমাকে মারে। কই আমার ভাইটাকে তো মারে না। নিশ্চয় আমার সৎ মা। যখনই আমাকে মারত কিম্বা বকা দিত তখন আমি কাঁদতাম। কেউ যদি জিজ্ঞেস করত যে, কাঁদিস কেন? আমি তখন বলতাম যে, আমাকে মেরেছে। কে মেরেছে? সেটা আমার সৎ মা। ঐরকম একটা ফিলিংস থেকে আমি বইয়ের মধ্যে মগ্ন হয়ে গেলাম।

আমার মনে হতো, আমি লিখব। যদি সাংবাদিক হওয়া যায় তো হবো। বাসায় কোন সাংবাদিক আসলে আমার মনে হতো যে, চোখের সামনে যেন একজন লিজেন্ডকে দেখতে পাচ্ছি। যেন একটা রাজকুমার। ইনি সংবাদপত্রে লিখে! ইনি সাংবাদিক! মনে হতো আহা আমি যদি সাংবাদিক হতে পারতাম! সেই যে শুরু হয়েছিল। পরে, ধামাচাপা পড়ে যায়। বিয়ে টিয়ে হয়ে যায়।

 

 

খোদ রাজধানীতে বড় হয়েও বাল্যবিবাহের ঝুঁকির মধ্যে ছিলাম আমরা পুরান ঢাকার মেয়েরা:

আমরা পুরান ঢাকার মেয়েরা। এখন আমি বলি, আমরা শহরের অনেকেই এগিয়েছি। গ্রামেরও অনেকেই এগিয়েছি। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু গ্রাম যেমন থাকে। ঢাকা শহরে তখন দুইটা শ্রেণি ছিল। আমরা একটু নিম্নমধ্যবিত্ত কিম্বা একটা শ্রেণি ছিল মধ্যবিত্ত। আর একটা আপার ক্লাস বা উচ্চবিত্ত। দুইটা সমাজ ছিল তখন। ধনীরা ওয়ারী, গেন্ডারিয়া এসব যায়গায় থাকত। আমরা যারা কিনা লোয়ার মিডল ক্লাস কিম্বা মিডল ক্লাস। আমরা পুরান ঢাকার এদিকটায় থাকতাম। আমার দাদা ডাক্তার ছিলেন। পাড়ার সবার বড় পরিবার ছিল। তারা উর্দু স্পিকিং ছিল।

কিন্তু খুব কনজারভেটিভ পাড়া ছিল। আমরা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে স্কুলে যেতাম। ঘোড়ার গাড়িতে চলাফেরা করতে হতো। আমরা ছোটবেলায় খেলতাম পাড়ায়। কিন্তু যেই আমরা কিশোরী হলাম অমনি রাস্তা থেকে সব মেয়েরা উধাও হয়ে গেল। মেয়েরা সব জানালার কাছে বসে থাকে। মেয়ে তাই আর খেলতে পারবেনা। আমি ছোট বেলায় ঘুড়ি উড়াতাম। ছাদে যেতাম। কিন্তু আমাদের পাড়ার মেয়েরা সবাই সাংষ্কৃতিকভাবে উন্নত হয়েছিল। পাড়ায় একটা সাংস্কৃতিক ক্লাব ছিল। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। তো আমাদের গলির মুখে ছিল লিও, এহতেশাম, মোস্তাফিজুর রহমান ওদের বাড়ি। ওদের বাড়িতে লিও ফ্লিমসের অফিস ছিল। ওখানে আসত নায়ক-নায়িকারা। শ্যুটিং হতো। আমরা স্কুলে থাকতে দলবেঁধে সেখানে যেতাম। এহতেশামের মেয়ে ছিল ফারজানা।

সে আমাদের বয়স। সে আমাদের বন্ধু ছিল। আমরাও ওর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। ঐ ফাঁকে শ্যুটিংয়ে কখনও কখনও রিহার্সাল হতো। ৬২’র দিকে, ঝর্না বসাক, নার্গিস মোরশেদা, এরা আমাদের দেশের মেয়েরা নাচের প্র্যাকটিস করছে। তখন আমার সিনেমার প্রতি একটা আগ্রহ ছিল। এত সিনেমা দেখি কিন্তু সিনেমার শ্যুটিং দেখতে ভাল লাগত। ঐভাবে হয়ত খবরের অন্বেষণটা দেখে দেখে সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। দেখে দেখে মনে বিদ্রোহী হয়ে উঠল সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছেটা আর লেখালেখি করার ইচ্ছে টা।