◉ অবসরের পর যাত্রাবাড়ীর ফার্মেসিতে খুলেছেন ব্যক্তিগত চেম্বার
◉ দিনে একটানা ১২ ঘণ্টা রোগী দেখেন তিনি
◉ কম ভিজিট ও ওষুধে চিকিৎসা দেওয়ায় রোগীদের কাছে জনপ্রিয়
সকাল ১১টার সময় চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে দেখা গেল- চেম্বারের বাইরে প্রায় ২০ জন চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছেন। এদের মধ্যে হয়ত ১০ জন রোগী বাকিরা রোগীর সঙ্গে এসেছেন। সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত একটানা রোগী দেখেন চিকিৎসক ডা. দিদারুল আলম। শুধু শুক্রবার বিকালটা ছুটি থাকে। রোগীদের ভীষণ প্রিয় চিকিৎসক এই দিদারুল আলম। তার তিনটা কারণ রোগীদের মুখেই শোনা, ১. চিকিৎসকের ভিজিট খুব কম মাত্র ২০০ টাকা। ২. তাকে প্রয়োজনের সময় চেম্বারে পাওয়া যায় ৩. তিনি সবসময় রোগীকে খুব কম ঔষধ দেন।
যেখানে রাজধানীর অভিজাত হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের ভিজিট ধরা হয় ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা, সেখানে এই চিকিৎসক ডা. দিদারুল আলম মাত্র ২০০ টাকা ভিজিটে রোগী দেখছেন। আর সেটি খোদ রাজধানীতেই, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায়।
এ প্রসঙ্গে দৈনিক সবুজ বাংলাকে ডা. দিদারুল আলম বলেন, এমবিবিএস পাস করার পর সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে আমি অনেক জায়গায় চাকরি করেছি। সবশেষে সিনিয়র কনসালটেন্ট, কার্ডিওলজি হিসেবে রাজধানীর সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল থেকে অবসরে যাই ২০২০ সালে। বর্তমানে এখানে প্র্যাকটিস করি। প্রথম প্র্যাকটিস এখানে। এখানেই সবসময় করছি। আর কি!
রোগীর প্রতি এত মায়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমি আমার মাকে হারাইছি ছোটবেলায় ক্লাস ফাইভে যখন পড়ি। তো মা সবসময় বলত আর কি! তুমি ডাক্তার হবা এবং গরিব মানুষদের সেবা করবা। আমার ঐটার ভেতর থেকে একটা আগ্রহ ছিল যে, যতটা মিনিমাম নিয়ে আমার চলতে পারি, যতটা মিনিমাম নিয়ে আমার জীবন চলে যাবে আর কি! আর যদি আমার ছেলেমেয়ে সন্তান থাকে তাদের যদি আমি মানুষ করতে পারি সেটা করব। তো আমার এই ২০০ টাকা ভিজিট নিয়েই চলে যায়। আমার দুই মেয়ে। একজন অলরেডি ডাক্তার হয়ে গেছে। ওর পোস্টিং হয়েছে। আর একজন ইঞ্জিনিয়ার। ও চাকরি করতেছে। আমার চাওয়া পাওয়ার তো আর বেশি কিছু নাই, যেটুকু সেবা করতে পারি ঐটুকুই আমার আনন্দ।
এই চিকিৎসকের চেম্বারে সারা দিনই রোগী আসতেই থাকে। সেখানে থাকা রোগীদের সঙ্গে কথা হয়। খালেদা (৪৫) নাতি সালমান (৭) কে নিয়ে এসেছেন চিকিৎসকের কাছে। নাতির খুব জ¦র। খাবার খেতে কষ্ট হচ্ছে। কথা বলতে পারছে না।
খালেদা দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, এই ডাক্তারের কাছে অনেক বারই দেখাইছি। যতবার অসুখ হয়, এই ছেলে, আমি, আমরা সবাই এই ডাক্তারকেই দেখাই। এই ডাক্তার মাত্র ২০০ টাকা ভিজিট নেয়। ২০০ টাকা ভিজিটে আমরা এই ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিয়ে অনেক উপকার পাচ্ছি। যার জন্য আমাদের এখানের সবাই এই ডাক্তারের কাছে আসে। এই ডাক্তার অনেক ভালো সেবা দেয়। অনেক ভালো সেবা পাইতেছি। উনার ব্যবহার অনেক ভালো। আমি আরও অন্য জায়গায় রোগী নিয়ে গেছি কিন্তু উনার মতো ডাক্তার কোথাও পাইনি। নরসিংদীতেও ডাক্তার দেখাইছি। কিন্তু উনার মতো এমন ভালো ডাক্তারও পাইনি। এমন ভালো সেবাও পাইনি। যার কারণে আমি নরসিংদী থেকে এখানে এসে ডাক্তার দেখাইতাছি। আমার শ^শুর বাড়ি নরসিংদী।
ডলি (৫৫) দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, এই ডাক্তারের খোঁজ আমার জালের (জা) থেকে পেয়েছি। আরও অনেক জায়গায় গেছি। এই ডাক্তার ভালো তাই তার কাছে এসেছি।
ফার্মেসির কর্মী রবিউল (৩৫) বলেন, স্যার সকাল সাড়ে ৮টায় আসে। যায় সন্ধ্যায়। প্রায় একশ বিশ থেকে ত্রিশজন রোগী হয়। এখানে সব ধরনের রোগীই আসে।
এক মাসের নাতি আদনান আমিনের ঠান্ডা লেগেছে। জ¦র। তাই তাকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে এসেছেন মশলা ব্যবসায়ী মো. জাকির হোসেন (৪৭)। তিনি দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, আমাদের ছোটবেলা থেকেই এই চিকিৎসকের সঙ্গে সম্পর্ক। আমাদের সব ছেলেমেয়েই উনার কাছে দেখানো হয়। উনার আচার ব্যবহার খুবই ভালো। আর দ্বিতীয় কথা ঔষধ কম দেয় আর ভিজিটও কম নেয়। সর্বদিক থেকে উনি সেরা। আমাদের এই পুরান ঢাকার জন্য। আমরা এইজন্যই উনার কাছে আসি। সকালে এসে সিরিয়াল দিয়ে গেছি। এখন দুপুরে আসছি। আমার ভাতিজা, আমার ছেলেমেয়ে সবাইকে উনাকে দেখানো হয়েছে। সবাই আমরা এখানেই দেখাই। আমাদের কিছু হলেই আমরা এখানেই নিয়ে আসি।
রোগীর উপস্থিতি প্রসঙ্গে ডা. দিদারুল আলম বলেন, সারাদিনে আমার প্রায় ৭০ জন রোগী দেখা হয়। নিজের প্রত্যাশা পূরণে এই স্বল্প ভিজিট কতটুকু ভূমিকা রাখছে? এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. দিদারুল আলম বলেন, আমি কখনও অন্যের দিকে তাকাই না। আমার বন্ধুরা কেউ বেশি আয় করছে। আমি কম আয় করছি। ওর কেন হচ্ছে? আমার কেন হচ্ছে না। আমি আরও পাইতে পারি। ওইরকম চিন্তা করি না কখনও, আমি ভালো আছি।
এই রোগীদের দোয়ায় আমি বেঁচে ফিরেছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আবার আমার এখানে অনেক সম্মান আছে। যেমন করোনার সময় আমাকে ডাক্তার দুইবার ডিক্লায়ার দিয়েছে আমি আর বাঁচব না। তো, আমার মনে হয়, আমি এই যে গরীব মানুষের সেবা করেছি। আমি এদের দোয়ায় বেঁচে গেছি। অনেক গরীব মানুষ এখানে এসে কান্নাকাটি করেছে। আমি যে বেঁচে আসছি।
তিনি রোগীদের প্রসঙ্গে বলেন, আমি এখানে কার্ডিওলজির রোগীও পাই। আবার আমি মেডিসিনের ওপর কোর্স করা। মেডিসিনের যত রোগী সবই দেখি। আমি প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ রোগী ফ্রি দেখি। অনেকেই বলে যে, স্যার অল্প কিছু টাকা আছে আর কিছু করতে পারিনি। স্যার, আজকে এটা রাখেন। আমি তাই নেই। আমার কথা হলো, আমার কাছে যারা চিকিৎসা নিবে তারা যেন কোনোভাবেই আমাকে বার্ডেন না ভাবে যে, ডাক্তারকে দেখাইতে পারছি না। রোগীর যেন কোনো কষ্ট না হয়।
তার মতো এমন চিকিৎসক এখন বিরল। এমন কথা বলতেই তিনি বলেন, হয়ত এমন চিকিৎসক আরও আছে আমরা জানি না। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এভাবেই চলবে। আমার মেয়েটাকে এইভাবেই ট্রেইন্ডআপ করব সেও যেন এভাবেই রোগীদের সেবা দেয়। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর জয় ফার্মেসিতে এই চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বার।


























