- আস্থা বাড়াতে স্বচ্ছতা ও সুশাসন জরুরি
- পলিসির মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে টাকা দিতে গড়িমসি
- টাকা উত্তোলন করতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন বিমাকারীরা
- আইডিআরএ অভিযোগ করেও মিলছে না সুরাহ
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। দেশের বিমা খাত ঠিকভাবে মানুষের বিমা দাবি নিষ্পত্তি করছে না। বিমা খাত থেকে টাকা পয়সা নিয়ে অনেকে পালিয়ে যাচ্ছেন- এমন অভিযোগও রয়েছে। দীর্ঘদিন ঘুরেও বিমার টাকা তোলা যাচ্ছে না। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) কার্যালয়ে নানা অভিযোগ নিয়ে ঘুরছেন ভুক্তভোগীরা। তবুও সুরাহা হচ্ছে না। ভুক্তভোগী ও বিশ্লেষকরা বলছেন, চরম অনিয়ম- দুর্নীতির কারণে বর্তমানে আস্থা সংকটে পড়েছে খাতটি। এ খাতের প্রতি আস্থা বাড়াতে স্বচ্ছতা ও সুশাসন জরুরি। বিমা পলিসির মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও টাকা উত্তোলন করতে পারছেন না পিরোজপুরের নাজমুল। তাই তিনি ঢাকার মতিঝিলে আইডিআরএ আসেন টাকা উদ্ধার করতে। তার পরিবারে দুটি পলিসির মেয়াদ শেষ হবার পর এ টাকার পেছনে তিনি ঘুরছেন প্রায় দুই বছর ধরে।
নাজমুল বলছেন, পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর যখন তারা টাকা তুলে নিতে চান, তখন স্থানীয় বিমা কোম্পানির অফিস থেকে চাপ দেওয়া হয় টাকাটা একই কোম্পানিতে ডিপিএস করে রাখতে। কিন্তু আমরা ডিপিএস করতে চাই নাই। আমরা টাকা চেয়েছিলাম। পরে হঠাৎ একদিন শুনি আমাদের অনুমিতি ছাড়াই তারা ডিপিএস করে ফেলেছে। আমরা যখন এর প্রতিবাদ করি এবং হেড অফিসে জানাই তখন বলা হয় যে, টাকা ফেরত দেবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সুশাসনের অভাব ও অনিয়ম করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই আর্থিক খাতে আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে। তারা বলছেন, বিমা সম্পর্কে মানুষের মাঝে একটা নেতিবাচক ধারণা আছে। যে কারণে পুরো খাতের ওপর মানুষ বিশ্বাস এবং আস্থা হারাচ্ছে। পরিবহন দুর্ঘটনার শিকার হলে বিমা কোম্পানি থেকে ক্ষতিপূরণ নিতে সাধারণ মানুষের বেগ পেতে হয়। প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির ডানে-বামে ছবি তুলে জিডি করতে হয়। ছবিতে পুরো ক্ষতির চিত্র ফুটে ওঠে না। দেখা গেল, রি-পেয়ার করতে ৩০ হাজার টাকা খরচ হলো, বিপরীতে দিল পাঁচ হাজার টাকা, তাও অনেক দিন পরে। এরকম ফিডব্যাক পেলে বিমার প্রতি আস্থা থাকার কথা না। এদিকে অভিযোগ রয়েছে, ফারইস্ট ইনস্যুরেন্সের মালিকপক্ষ টাকা পয়সা নিয়ে উধাও হয়ে গেছেন। যাদের বিমা ম্যাচিউরড হয়ে গেছে, তারাও টাকা পাচ্ছেন না। এক ভুক্তভোগী সবুজ বাংলাকে জানান, যারা বিমা করছেন তাদের বেশির ভাগই সরকারি-বেসরকারি চাকরি করেন। অনেক আশা করে বিমা করেছেন। একই পরিবারে চার-পাঁচটি বিমা। টাকা পাচ্ছেন না। এভাবে যদি বিমা কোম্পানিগুলো কাজ করে তাহলে মানুষের আস্থা থাকার কথা নয়। সে জন্য প্রথমে আস্থা তৈরি করতে হবে। সুমন মন্ডল নামে এক ব্যক্তি বলেন, এক বছর হয়েছে বিমার ম্যাচিউর হয়েছে তার পরও টাকা তুলতে পারছি না। বারবার কালক্ষেপণ করে আমার সাথে প্রতারণ করছে কোম্পানিটি। দেশের বিমা খাত ভালো করছে না, কারণ বিমা দাবির বিপরীতে নিষ্পত্তির অনুপাত প্রত্যাশার চেয়েও অনেক কম। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে জীবন বিমা খাতে দাবি নিষ্পত্তির হার ছিল ৬৭ শতাংশ, তার মানে ৩৩ শতাংশ দাবি অমীমাংসিত থেকে গেছে। নন-লাইফ বিমা খাতে দাবি নিষ্পত্তির অনুপাত আরও কম, গত বছর যা ছিল ৩৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক মাইন উদ্দিন বলেন, বিমা দাবি পূরণ না করায় বিমা খাতের প্রতি মানুষের আস্থা কমে গেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকারের যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে, সেখানে উত্তরণ দরকার। কীভাবে তাদের সামাজিক বিমা কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এ ধরনের কর্মসূচির নীতিকাঠামো রয়েছে। এখন এটি বাস্তবায়নে বিভি- ন্ন মন্ত্রণালয়কে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা কীভাবে কাজ করছে, সেটা দেখা। মোয়াজ্জেম আরও বলেন, রাজনৈতিকভাবে সরকারের বিমা খাতের অঙ্গীকার হয়তো পরিষ্কার, কিন্তু সেটা বাস্তবায়নে এজেন্সিগুলো যথেষ্ট সচেতন নয়। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, করপোরেট গভর্নেন্স ও রেগুলেটরি গভর্নেন্সের অভাবে আর্থিক খাতে সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়েছে। তিনি জানান, করপোরেট গভর্নেন্সের অভাবে সম্পদের মান কমে যাচ্ছে। মানুষ যখন এসব দেখতে পায়, তখন তারা কীভাবে বিশ্বাস করবে- তাদের অর্থ পেশাদার উপায়ে ও নৈতিকভাব ব্যবহার করা হচ্ছে? এছাড়া যখন মানুষ জানতে পারে- আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রকের কাছ থেকেও প্রশ্রয় পাচ্ছে, তখন সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট আরও তীব্র হয়।

























