◉অনুমোদন ছাড়া অটোরাইস মিল কিনতে পারবে না করপোরেট প্রতিষ্ঠান
◉নতুন করে করপোরেট লাইসেন্স নিতে হবে
◉ফসলের ওপর করপোরেট দখলদারিত্বে বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা
❖করপোরেট দখলের কারণে চালটা বাণিজ্যিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, ধানের উৎপাদন ব্যবস্থা পুরোটাই করপোরেট নিয়ন্ত্রিত- পাভেল পার্থ, গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ
❖ভোক্তা পর্যায়ে চাল ও ধানের দাম অন্য কারও নিয়ন্ত্রণে নেই, এটা বড় বড় কোম্পানির হাতে- দেলোয়ার জাহান, সমন্বয়কারী, প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলন
দেশের মানুষের প্রধান খাবার ভাত। আবহাওয়া ও ভৌগোলিক কারণে এ অঞ্চল ধান চাষের জন্য উৎকৃষ্ট জায়গা। বলতে গেলে, সারা বছরই ধান চাষ হচ্ছে। একটি পরিবারের খাদ্য বাবদ ব্যয়ের সিংহভাগ চাল কেনার ক্ষেত্রে চলে যায়। কিন্তু চালের মূল্য বৃদ্ধির ফলে দরিদ্র মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। উৎপাদন ভালো হলেও বাংলাদেশের বাজারে অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কারসাজিতে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বছরের শুরু থেকে চালের বাজারের অস্থিরতা বিরাজমান। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন সময় নানা পদক্ষেপ কিছুদিন কার্যকর করা হলে তখন বাজার মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে থাকে। সরকারের এই পদক্ষেপ কয়েকদিন যেতে না যেতে আবারও সেই পূর্বের অবস্থানে ফিরে যায় বাজার। এমনকি মন্ত্রী পর্যায় থেকে প্রশাসনের দৌড়ঝাঁপেও চালের দাম কমে না। ফলে সিন্ডিকেট অযৌক্তিক মুনাফা করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়। আবার চালের দাম বাড়ার ফলে অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে নতুন কৌশল হাতে নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে সরকারের বিশেষ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া অটোরাইস মিল কিনতে পারবে না কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠান। এছাড়া আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়ে ঈদুল আজহার পর পরিপত্র জারি করবে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এমন তথ্যই জানিয়েছেন খাদ্যসচিব ইসমাইল হোসেন।
বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে খাদ্যসচিব জানান, সরকারের বিশেষ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠান অটোরাইস মিল কিনতে পারবে না। এটা টাকা থাকলেও কিনতে পারবে না, কেউ বিক্রি করতে চাইলেও কিনতে পারবে না। গত দু-তিন মাসে আমরা কয়েকটা পরিপত্র জারি করেছি। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে আমরা কাজ করছি। অটোরাইস মিলগুলোকে নিয়েও কাজ করছি। এটা শেষ পর্যায়ে। এটা শেষ হলেই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে আবার বসবো। তৃতীয় বৈঠকে আশা করছি, অনেকগুলো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলাপ হবে।
বর্তমানে বাজার পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করতে গিয়ে গতকাল গবেষণা সংস্থা সিপিডি’র বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৩-২৪: তৃতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০১৯ সালের তুলনায় মিনিকেট চালের দাম বেড়েছে ১৭ ভাগ, পাইজামের দাম ১৫ ও মোটা চাল ৩০ ভাগ। অর্থাৎ মুনাফাখোররা বেশি লাভ যেখানে করছে, যে পণ্য গরিব ও মধ্যবিত্তরা ব্যবহর করে এবং বাজারে বেশি বিক্রি হয়।
ধান-চালে করপোরেট নজর : বর্তমানে এই সিন্ডিকেট ও দাম বাড়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে এ বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, করপোরেট দখলদারিত্বের কারণে চাল মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। ধান ও চালের বৈচিত্র্যও হারিয়ে যাবে।
চালের ওপর কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় বাজার ব্যবস্থাটাও ধসে যাবে বলে জানান গবেষকরা। পাভেল পার্থ বলেন, কোম্পানিগুলো যখন চালের বাজার দখল করছে, তখন আমাদের সমাজের কৃষক বা ফড়িয়া, মহাজন- সব মিলিয়ে চালের যে স্থানীয় বাজার গড়ে উঠেছে, সেটা আর থাকবে না। সবকিছু কোম্পানির হাতে চলে যাবে। করপোরেট দখলের কারণে চালটা বাণিজ্যিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আর ধানের উৎপাদন ব্যবস্থা পুরোটাই করপোরেট নিয়ন্ত্রিত। এখানে যদি বীজের কথা বলি, কিছু হাইব্রিড বীজ চীন থেকে আসছে, কিছু আসছে ভারত থেকে। বাংলাদেশে জিএমও বীজ বিক্রি হয় না। এছাড়া আমাদের দেশীয় জাতগুলো সেভাবে নেই। আর বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মাধ্যমে যে বীজগুলো দেয়া হয়, সেগুলো কৃষকের কাছে পৌঁছে না।
কৃষকের কাছ থেকে খাদ্য কোম্পানির দখলে চলে যাচ্ছে বলে জানান প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলনের সমন্বয়কারী দেলোয়ার জাহান। তিনি বলেন, ভোক্তা পর্যায়ে চাল ও ধানের দাম অন্য কারও নিয়ন্ত্রণে নেই। এটা বড় বড় কোম্পানির হাতে। সরকার বা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবেই বলুক না কেন, দামের নিয়ন্ত্রণ বড় কোম্পানিগুলোর হাতে চলে গেছে।
খাদ্যপণ্য কোম্পানির হাতে চলে যাওয়ার জন্য গ্রাম পর্যায়ে বাড়িগুলোতে কৃষিপণ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকাটাকেও একটা কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন দেলোয়ার জাহান। তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রাম পর্যায়ে প্রতিটি বাড়িতে কৃষিপণ্য সংরক্ষণের যে ব্যবস্থা ছিল, সেটা এখন আর নেই। বাড়িতে টোল, গোলা, দোল, ধানের ছোটো ছোটো আউল থাকতো আগে। এভাবে ধান সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। সেখান থেকে কৃষকরা নিজেদের প্রয়োজনে ধান থেকে চাল তৈরি করে খেত। আর এখন উৎপাদন করতে কৃষকের খরচ অনেক বেশি হচ্ছে। নানাভাবে তারা ঋণগ্রস্ত থাকেন। কারণ কৃষির উৎপাদন পর্যায়টিও করপোরেটের দখলে।’
টাকার প্রয়োজনেই কৃষককে প্রথম স্তরেই ধান বিক্রি করে ফেলতে হয় বলে জানান দেলোয়ার জাহান। তিনি বলেন, ফলে কোম্পানিগুলোই নির্ধারণ করে দেয় বাজারে ধান ও চালের দাম কেমন হবে। জাতীয় পর্যায়ে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা এতে বিঘ্নিত হয়। সেগুলো গুটিকয়েক মানুষের হাতে চলে যায়। ধান ও চালে প্রতিটি বাড়িতে আগে যে স্বনির্ভরতা ছিল, সেটা চলে গেছে কোম্পানিগুলোর কাছে। উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণন- সবই এখন কোম্পানির দখলে। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। খাদ্য নিরাপত্তায় বিভিন্ন ঝামেলা তৈরি হবে।























