০৫:০৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

লেভেল ক্রসিংয়ে মৃত্যুফাঁদ

◉২০২৩ সালে রেলে প্রাণহানি ৫১২, আহত ৪৭৫
◉সারাদেশে ২৮৫৬টি ক্রসিংয়ের মধ্যে অনুমোদন নেই ১৩৬১টির
◉ঢাকায় ৫৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের ২৩টি অরক্ষিত

দুর্ঘটনারোধে সংস্থাগুলোর সমন্বয় করে রেলওয়ের সিগন্যাল ও সাইরেন দুটোই সচল করতে হবে: সহকারী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ সাইফুন নেওয়াজ, বুয়েট (এআরআই)

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিদিনই কেউ না কেউ রেললাইনে হাঁটতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। অরক্ষিত রেলক্রসিং আর অসচেতনতায় ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। কেউ চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে, কেউ মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন দিয়ে হাঁটতে গিয়ে সিøপারে পা আটকে, কেউ ট্রেন থেকে নামতে ও রেললাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনের নিচে প্রাণ হারাচ্ছেন। এভাবেই প্রতিনিয়ত ট্রেনে কাটা পড়ে মরছে মানুষ। তারপরও নেই সচেতনতা। এমনই একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় গত ৫ জুন সকালে রাজধানীর মহাখালী লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছেন আব্দুল আলিম (৫৫)। এমন বাস্তবতায় মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে দেশের অধিকাংশ লেভেল ক্রসিং। রেলওয়ের তথ্যমতে, সারা দেশে ২ হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথে লেভেল ক্রসিং আছে ২ হাজার ৮৫৬টি। এর মধ্যে বৈধ ১ হাজার ৪৯৫টি এবং অবৈধ ১ হাজার ৩৬১টি। কোনো গেটম্যান নেই ৯৬১টিতে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ২০২৩ সালে সারা দেশে রেলে ৫১২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪৭৫ জন যাত্রী-পথচারী। সংস্থাটি বলছে, গেটম্যান ও সিগন্যাল বারে দায়িত্বপ্রাপ্তদের উদাসীনতায় রেললাইনে দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার বাড়ছে। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ সাইফুন নেওয়াজ বলেন, দুর্ঘটনারোধে সড়কসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সমন্বয় করে রেললাইনে বিভিন্ন রেলক্রসিংয়ের সিগন্যাল বাতি ও রেলের সাইরেন দু’টোই সচল করতে হবে। তবেই দুর্ঘটনা কমতে পারে। গতকাল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতকাল শুক্রবার বিকাল ৩টায় লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নের উত্তর গোপালবায় এলাকায় রেললাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গরু সরাতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারান আব্দুল কাইয়ুম (১৮) নামের এক তরুণ। এর আগে গত ৬ জুন বিকাল ৪টায় কিশোরগঞ্জের ভৈরবের শম্ভুপুর লেভেলক্রসিংয়ে নামতে গিয়ে ঢাকাগামী আন্তঃনগর এগারো সিন্দু এক্সপ্রেস ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে প্রাণ হারায় সপ্তম শ্রেণির ছাত্র বনুতাইন (১৪)। গত ৫ জুন সকালে রাজধানীর মহাখালী লেভেলক্রসিংয়ে রেললাইন পার হতে গিয়ে ঢাকাগামী ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে প্রাণ হারান পথচারী আব্দুল আলীম। এদিন রাত সোয়া ৮টায় শাজাহানপুরে রেললাইন পার হওয়ার সময় ট্রেনের ধাক্কায় নিহত হন এনায়েত উল্ল্যাহ (৪০)। বিষয় দুটি নিশ্চিত করে জিআরপি থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল আলিম পলাশ বলেন, অসাবধানতাবশত লেভেলক্রসিং ও রেললাইন পার হতে গিয়ে রেলের ধাক্কায় প্রাণ হারান দু’জন। একইদিন সকালে কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইনের ওপরে হাঁটতে গিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর দুই নম্বর এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে ইব্রাহীম উদ্দিন নামে এক কলেজ ছাত্র নিহত হয়েছে। এদিন দিবাগত রাত ১টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মো. ইদ্রিস মিয়া (২০) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এভাবে প্রায় প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটলেও মানুষ সচেতন হচ্ছে না বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

 

সরেজমিনে রাজধানীর খিলক্ষেত, তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া বাজার, মালিবাগ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে রেললাইন ঘেঁষে গড়ে উঠেছে পাইকারি বাজার। বাজার থেকে শাক-সবজি কিনে ভ্যানে করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। ট্রেন আসছে দেখেও অবলীলায় কাওলার রেলক্রসিং পার হচ্ছেন তারা। মাত্র কয়েক হাত দূরে ট্রেন দেখেও মাথায় বস্তা নিয়ে দৌড় দিলেন আরেক দোকানি। এভাবেই প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে রেললাইন পার হচ্ছেন মানুষ। এতে হতাহতের শিকার হচ্ছেন তারা। ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ লেভেলক্রসিংয়ের একই চিত্র দেখা গেছে। ট্রেন আসার আগ মুহূর্তে লাইনম্যান দুদিকে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা পারাপার বন্ধ করে দেন। কিন্তু ব্যারিকেডের নিচ দিয়ে কিংবা একটু দূরে লোহার বার তুলে ঢুকে পড়েন পথচারী এবং সাইকেল-মোটরসাইকেল চালকদের অনেকেই। ট্রেন কাছাকাছি চলে এলেও অবাধে পার হয়ে যান তারা। শ্যাওড়া রেলক্রসিং এলাকায় দেখা যায়, সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক গেটম্যানরা সতর্কীকরণ সাইরেন বাজালেও তাতে ভ্রক্ষেপ নেই কারও।

 

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর রেল দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০০ মানুষ মারা যায়। রেলওয়ে আইন অনুযায়ী, রেলপথের দুই পাশে ১০ ফুট এলাকায় চলাচল আইনত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ওই সীমানার ভেতর কেউ প্রবেশ করলে তাকে গ্রেপ্তারের বিধান রয়েছে। এমনকি ওই সীমানায় গবাদিপশু প্রবেশ করলে তা বিক্রি করে এর অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দিতে হয়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিনা পরোয়ানায় দায়ী ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পাশাপাশি অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা রাখে। রেললাইনে দুর্ঘটনার জন্য বেশ কিছু কারণ শনাক্ত করেছে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ। এসবের মধ্যে আছে, অসচেতনভাবে রেললাইন দিয়ে হাঁটাচলা ও পারাপার।

 

রেল মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বৈঠকে দুর্ঘটনা রোধে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মহাসড়ক রেলক্রসিংয়ের পরিবর্তে ফ্লাইওভার, ওভারপাস, আন্ডারপাস নির্মাণ, অননুমোদিত রেলক্রসিং বন্ধ করার কথা বলা হয়। সূত্র মতে, রাজধানীসহ আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ৫৮টি লেভেলক্রসিংয়ের ২৩টি অরক্ষিত ও অননুমোদিত। এর মধ্যে কোনোটিতে নেই গেটম্যান ও সিগন্যাল বার। রেলওয়ের সূত্র মতে, সারা দেশে ২ হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথে লেভেলক্রসিং আছে ২ হাজার ৮৫৬টি। এর মধ্যে বৈধ ১ হাজার ৪৯৫টি এবং অবৈধ ১ হাজার ৩৬১টি। কোনো গেটম্যান নেই ৯৬১টিতে। এসব ক্রসিংয়ের বেশিরভাগ তৈরি হয়েছে এলজিইডি, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের রাস্তার কারণে। সূত্র জানায়, গত পনেরো বছরে এসব স্থানে প্রায় পাঁচ হাজার দুর্ঘটনায় মারা গেছেন অন্তত ৪১৯ জন। আহত হয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার।

 

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে সারা দেশে রেলপথে ৫২০টি দুর্ঘটনায় ৫১২ জন নিহত, ৪৭৫ জন আহত হয়েছে। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা ৩৫.০২ শতাংশ, রেলক্রসিং-এ ০.১৬ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

সংগঠনের মহাসচিব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক চৌধুরী দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, রেলের অনুমতি ছাড়া রেলক্রসিং নির্মাণরোধ করাসহ নানারকম সিদ্ধান্ত নিলেও এগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই। ফলে, প্রতিদিনই মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে দেশের লেভেলক্রসিংগুলো।

 

বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা এড়াতে অটোম্যাটিক সিগন্যাল ও রেলের সাইরেনকে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, এখন আমাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। ট্রেন আসার আগে যেন একটা লাইট জ্বলে সতর্কতা সৃষ্টি করা যায় বা সাইরেন বাজিয়ে বোঝানো যায় তেমন পদ্ধতি চালু করতে হবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

নরসিংদীর পলাশে ডাকাতির প্রস্তুতিতে ৫ জন গ্রেপ্তার

লেভেল ক্রসিংয়ে মৃত্যুফাঁদ

আপডেট সময় : ০৫:১৭:০৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ জুন ২০২৪

◉২০২৩ সালে রেলে প্রাণহানি ৫১২, আহত ৪৭৫
◉সারাদেশে ২৮৫৬টি ক্রসিংয়ের মধ্যে অনুমোদন নেই ১৩৬১টির
◉ঢাকায় ৫৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের ২৩টি অরক্ষিত

দুর্ঘটনারোধে সংস্থাগুলোর সমন্বয় করে রেলওয়ের সিগন্যাল ও সাইরেন দুটোই সচল করতে হবে: সহকারী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ সাইফুন নেওয়াজ, বুয়েট (এআরআই)

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিদিনই কেউ না কেউ রেললাইনে হাঁটতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। অরক্ষিত রেলক্রসিং আর অসচেতনতায় ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। কেউ চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে, কেউ মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন দিয়ে হাঁটতে গিয়ে সিøপারে পা আটকে, কেউ ট্রেন থেকে নামতে ও রেললাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনের নিচে প্রাণ হারাচ্ছেন। এভাবেই প্রতিনিয়ত ট্রেনে কাটা পড়ে মরছে মানুষ। তারপরও নেই সচেতনতা। এমনই একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় গত ৫ জুন সকালে রাজধানীর মহাখালী লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছেন আব্দুল আলিম (৫৫)। এমন বাস্তবতায় মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে দেশের অধিকাংশ লেভেল ক্রসিং। রেলওয়ের তথ্যমতে, সারা দেশে ২ হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথে লেভেল ক্রসিং আছে ২ হাজার ৮৫৬টি। এর মধ্যে বৈধ ১ হাজার ৪৯৫টি এবং অবৈধ ১ হাজার ৩৬১টি। কোনো গেটম্যান নেই ৯৬১টিতে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ২০২৩ সালে সারা দেশে রেলে ৫১২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪৭৫ জন যাত্রী-পথচারী। সংস্থাটি বলছে, গেটম্যান ও সিগন্যাল বারে দায়িত্বপ্রাপ্তদের উদাসীনতায় রেললাইনে দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার বাড়ছে। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ সাইফুন নেওয়াজ বলেন, দুর্ঘটনারোধে সড়কসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সমন্বয় করে রেললাইনে বিভিন্ন রেলক্রসিংয়ের সিগন্যাল বাতি ও রেলের সাইরেন দু’টোই সচল করতে হবে। তবেই দুর্ঘটনা কমতে পারে। গতকাল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতকাল শুক্রবার বিকাল ৩টায় লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নের উত্তর গোপালবায় এলাকায় রেললাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গরু সরাতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারান আব্দুল কাইয়ুম (১৮) নামের এক তরুণ। এর আগে গত ৬ জুন বিকাল ৪টায় কিশোরগঞ্জের ভৈরবের শম্ভুপুর লেভেলক্রসিংয়ে নামতে গিয়ে ঢাকাগামী আন্তঃনগর এগারো সিন্দু এক্সপ্রেস ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে প্রাণ হারায় সপ্তম শ্রেণির ছাত্র বনুতাইন (১৪)। গত ৫ জুন সকালে রাজধানীর মহাখালী লেভেলক্রসিংয়ে রেললাইন পার হতে গিয়ে ঢাকাগামী ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে প্রাণ হারান পথচারী আব্দুল আলীম। এদিন রাত সোয়া ৮টায় শাজাহানপুরে রেললাইন পার হওয়ার সময় ট্রেনের ধাক্কায় নিহত হন এনায়েত উল্ল্যাহ (৪০)। বিষয় দুটি নিশ্চিত করে জিআরপি থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল আলিম পলাশ বলেন, অসাবধানতাবশত লেভেলক্রসিং ও রেললাইন পার হতে গিয়ে রেলের ধাক্কায় প্রাণ হারান দু’জন। একইদিন সকালে কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইনের ওপরে হাঁটতে গিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর দুই নম্বর এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে ইব্রাহীম উদ্দিন নামে এক কলেজ ছাত্র নিহত হয়েছে। এদিন দিবাগত রাত ১টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মো. ইদ্রিস মিয়া (২০) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এভাবে প্রায় প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটলেও মানুষ সচেতন হচ্ছে না বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

 

সরেজমিনে রাজধানীর খিলক্ষেত, তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া বাজার, মালিবাগ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে রেললাইন ঘেঁষে গড়ে উঠেছে পাইকারি বাজার। বাজার থেকে শাক-সবজি কিনে ভ্যানে করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। ট্রেন আসছে দেখেও অবলীলায় কাওলার রেলক্রসিং পার হচ্ছেন তারা। মাত্র কয়েক হাত দূরে ট্রেন দেখেও মাথায় বস্তা নিয়ে দৌড় দিলেন আরেক দোকানি। এভাবেই প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে রেললাইন পার হচ্ছেন মানুষ। এতে হতাহতের শিকার হচ্ছেন তারা। ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ লেভেলক্রসিংয়ের একই চিত্র দেখা গেছে। ট্রেন আসার আগ মুহূর্তে লাইনম্যান দুদিকে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা পারাপার বন্ধ করে দেন। কিন্তু ব্যারিকেডের নিচ দিয়ে কিংবা একটু দূরে লোহার বার তুলে ঢুকে পড়েন পথচারী এবং সাইকেল-মোটরসাইকেল চালকদের অনেকেই। ট্রেন কাছাকাছি চলে এলেও অবাধে পার হয়ে যান তারা। শ্যাওড়া রেলক্রসিং এলাকায় দেখা যায়, সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক গেটম্যানরা সতর্কীকরণ সাইরেন বাজালেও তাতে ভ্রক্ষেপ নেই কারও।

 

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর রেল দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০০ মানুষ মারা যায়। রেলওয়ে আইন অনুযায়ী, রেলপথের দুই পাশে ১০ ফুট এলাকায় চলাচল আইনত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ওই সীমানার ভেতর কেউ প্রবেশ করলে তাকে গ্রেপ্তারের বিধান রয়েছে। এমনকি ওই সীমানায় গবাদিপশু প্রবেশ করলে তা বিক্রি করে এর অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দিতে হয়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিনা পরোয়ানায় দায়ী ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পাশাপাশি অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা রাখে। রেললাইনে দুর্ঘটনার জন্য বেশ কিছু কারণ শনাক্ত করেছে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ। এসবের মধ্যে আছে, অসচেতনভাবে রেললাইন দিয়ে হাঁটাচলা ও পারাপার।

 

রেল মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বৈঠকে দুর্ঘটনা রোধে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মহাসড়ক রেলক্রসিংয়ের পরিবর্তে ফ্লাইওভার, ওভারপাস, আন্ডারপাস নির্মাণ, অননুমোদিত রেলক্রসিং বন্ধ করার কথা বলা হয়। সূত্র মতে, রাজধানীসহ আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ৫৮টি লেভেলক্রসিংয়ের ২৩টি অরক্ষিত ও অননুমোদিত। এর মধ্যে কোনোটিতে নেই গেটম্যান ও সিগন্যাল বার। রেলওয়ের সূত্র মতে, সারা দেশে ২ হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথে লেভেলক্রসিং আছে ২ হাজার ৮৫৬টি। এর মধ্যে বৈধ ১ হাজার ৪৯৫টি এবং অবৈধ ১ হাজার ৩৬১টি। কোনো গেটম্যান নেই ৯৬১টিতে। এসব ক্রসিংয়ের বেশিরভাগ তৈরি হয়েছে এলজিইডি, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের রাস্তার কারণে। সূত্র জানায়, গত পনেরো বছরে এসব স্থানে প্রায় পাঁচ হাজার দুর্ঘটনায় মারা গেছেন অন্তত ৪১৯ জন। আহত হয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার।

 

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে সারা দেশে রেলপথে ৫২০টি দুর্ঘটনায় ৫১২ জন নিহত, ৪৭৫ জন আহত হয়েছে। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা ৩৫.০২ শতাংশ, রেলক্রসিং-এ ০.১৬ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

সংগঠনের মহাসচিব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক চৌধুরী দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, রেলের অনুমতি ছাড়া রেলক্রসিং নির্মাণরোধ করাসহ নানারকম সিদ্ধান্ত নিলেও এগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই। ফলে, প্রতিদিনই মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে দেশের লেভেলক্রসিংগুলো।

 

বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা এড়াতে অটোম্যাটিক সিগন্যাল ও রেলের সাইরেনকে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, এখন আমাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। ট্রেন আসার আগে যেন একটা লাইট জ্বলে সতর্কতা সৃষ্টি করা যায় বা সাইরেন বাজিয়ে বোঝানো যায় তেমন পদ্ধতি চালু করতে হবে।