➤দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পারাপার
➤ দেখার যেন কোথাও কেউ নেই
➤নগরীতে নেই প্রয়োজনীয় জেব্রাক্রসিং
❖ আসলে পথচারী পারাপারে সিস্টেম দুই পক্ষ থেকেই নেই : মোজাম্মেল হক চৌধুরী
❖ এত ছোট বিষয় নিয়ে মনে হয় না সরকার কিছু করবে : আফসান চৌধুরী
আজিমপুর গার্লস হাইস্কুলের নবম শ্রেণির সানজিদাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে এসেছে মা। সানজিদার বাসা রাজধানীর আজিমপুর এলাকায়। স্কুলের সামনে আছে ফুটওভার ব্রিজ। কিন্তু সানজিদা ও তার মাকে বহনকারী রিকশাটি স্কুলের গেট বরাবর রোড ডিভাইডারের কাছে যেখানে লোহার গ্রিল কাটা আছে সেখানে দাঁড়ায়। সানজিদা রিকশা থেকে নেমে ঐ ডিভাইডারের ফাঁক গলে রাস্তা পার হচ্ছে। এমন সময় আজিমপুর মোড় থেকে এতিমখানার দিকে এগিয়ে আসছে গুলিস্তান সাভারগামী ধামরাই বাস। স্কুলড্রেস পরা ছাত্রীকে রাস্তা পার হতে দেখে চালক গাড়ির গতি ধীর করে। ওপাশে গেটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার এই ঝুঁকিপূর্ণ পারাপার দেখে। এমন দৃশ্য প্রতিদিনের এবং শুধু সানজিদার স্কুল নয়, সারা দেশের বেশিরভাগ এলাকাতেই এভাবেই বিশৃঙ্খলার সাথে রাস্তা পার হন পথচারীরা। যেন কোথাও দেখার কেউ নেই।
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের রাস্তাগুলো যেন বিশৃঙ্খলার চরম দৃষ্টান্ত। দেখার জন্য যেন কোথাও কেউ নেই! বেশিরভাগ সড়কেই নেই জেব্রাক্রসিং। কোথাও কোথাও ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও তিনতলা সমান উঁচু ওভারব্রিজ পার হওয়া কষ্টসাধ্য। এমন অবস্থার মধ্য দিয়েই চলছে দেশের পথচারী পারাপার।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যানুযায়ী, গত মে মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৬ জন পথচারী নিহত হয়েছে। এপ্রিল মাসে ৬৩ জন পথচারী নিহত হয়েছে। তবে, এ সংখ্যাটা আরও বেশি বলে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজ্জামেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, আসলে এই সংখ্যাটা আরও বেশি। গণমাধ্যমে গত দুই মাস ধরে নির্বাচন ছিল তখন সড়ক দুর্ঘটনার রিপোর্টগুলো সেভাবে প্রায়োরিটি দিতে পারেন না। সে কারণে সারা দেশের চিত্র সেভাবে তুলে আনা সম্ভব হয় না। এটা একটা প্রতীকী রিপোর্ট। এখানে যেটুকু রিপোর্ট এসেছে আমি মনে করি এটা অনেক বেশি। আমাদের আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সবার আগে যেটা প্রয়োজন আমাদেরকে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা সরকার বলছে কিন্তু এখন স্মার্ট বাংলাদেশ তো আসলে ট্রাফিক সিগন্যাল, রাস্তায় দাঁড়িয়ে একজন কনস্টেবল আমাকে হাত তুলে রাস্তা পার করে দেবেন, এমনটিকে বলে না। আমরা যদি কলকাতা শহরে দেখি সেখানে কিন্তু শতভাগ সিসি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ চালু হয়েছে। সেখানে কিন্তু তারা জেব্রাক্রসিং মানছে, তারা সিগন্যালগুলোকে মানছে। রাত ১২টার সময়ও কিন্তু তারা একটি গাড়ি হলেও ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে যাচ্ছে। বসে থাকছে এবং আমরা গাড়িতে উঠলেই তারা বলে যে, দাদা আগে সিটবেল্টটা বাঁধুন। নাহলে আমি কিন্তু স্টার্ট দিতে পারছি না। তাহলে তারা এমন নিয়ম মানতে পারলে আমরা কেন পারছি না। সেটা আমাদের যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যারা আমাদেরকে চালাচ্ছেন তারা ভেবে দেখবেন এমনটি আশা করি।
তিনি বলেন, আসলে পথচারী পারাপারে সিস্টেম দুই পক্ষ থেকেই নেই। একপক্ষ থেকে আমরা মানছি না। আর অন্যদিকে, কোনো সিস্টেম করে দেওয়া নেই। আমি গতকাল বাংলামোটরে দেখলাম ওখানে জেব্রাক্রসিং আছে ফাইভ স্টার হোটেলের সাথে। কিন্তু আমরা দেখছি যে, জেব্রা ক্রসিংয়ে কোনো চালক থামছে না। জেব্রাক্রসিংয়ে যদি না থামে তাহলে কিভাবে হবে? হাইকোর্টের আশেপাশে জেব্রাক্রসিং করে দেওয়া আছে। সেখানে সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল, জেব্রা ক্রসিংয়ের মূল অর্থটা কি? যাত্রীকে পারাপারে প্রায়োরিটি দেওয়া। আমাকে যেখানে পারাপারে প্রায়োরিটি দেওয়ার কথা সেখানে একজন যাত্রী পার হতে পারছে না। আমি গতকাল দেখলাম সেখান দিয়ে একজন যাত্রী আইনের পোশাক পরেই, আইনের বই নিয়ে জেব্রাক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে কিন্তু তাকে কোনো যানবাহন সুযোগ দিচ্ছে না। এ একটা বিষয়। আসলে আইনের শাসন যখন প্রতিষ্ঠিত থাকে না তখন কিন্তু এই ধরনের বিশৃঙ্খলা সমাজে দেখা দেয়। এটাই হলো বাস্তবতা।
এ প্রসঙ্গে গবেষক, কলামিস্ট আফসান চৌধুরী বলেন, রাস্তা পারাপারের সমস্যা আমাদের দেশে সমাধানের সম্ভাবনা কম। কারণ, আমাদের দেশে যে পরিমাণ মানুষ গাড়ি চালায় আর রাস্তার যে অবস্থা এর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। দ্বিতীয়ত হচ্ছে আমাদের দেশে যে পরিমাণ গাড়ি আছে তা অনেক বেশি। পৃথিবীর অনেক দেশে এত সহজে গাড়ি কেনা যায়না। কিন্তু সরকার যে পরিমাণ টাকা খরচ করা দরকার এই পায়ে হাঁটা আমাদের মতো মানুষদের জন্য সেটা সরকার করে না। করে না এই কারণে, আমাদের দেশে আরও কয়েকটা ব্যবস্থা আছে। সে ব্যবস্থাগুলো হচ্ছে রিকশা ও সিএনজি। কাছে যাবার জন্য রিকশা। কাছে যাবার জন্য সিএনজিচালিত অটো আছে। হেঁটে মানুষকে সারাদিনই কোনো না কোনো যায়গা থেকে বের হতে হয় এটা নিয়ে চিন্তাও করে না। যে রাষ্ট্র এবং তার যে প্রকাশ, সরকার স্বাধীনতার পর থেকে কোনোদিন সাধারণ মানুষের চিন্তা করে এগোয়নি বরং এলিট শ্রেণির কথা চিন্তা করে এগিয়েছে। এটা ধারণা করাটাই বোধহয় অসম্ভব যে এটা একটা সমস্যা হতে পারে।
তিনি বলেন, বাংলামোটরের ওভারপাসটা আমি ব্যবহার করি। কিন্তু আমার প্রকাশকের অফিস রাস্তার এই পাশে। রাস্তা পার হয়ে ওভারপাশে উঠব সেটা পারি না। পৃথিবীর অন্য দেশে বয়স্ক মানুষ দেখলে একটু সম্মান করে। বাংলাদেশে এটা হয় না। পশ্চিমে তো বয়স্কদের কোনো দোষ ধরে না। বরং গাড়ি নিজেই থেমে বয়স্কদের রাস্তা পার করে দেয়। আমার চারবার এমন হয়েছে আমি কম বয়স্ক মানুষদের হাত ধরে রাস্তা পার হয়েছি। মায়েদেরও আমি দেখি তারা কত ভয় নিয়ে রাস্তা পার হয়। কিন্তু গাড়ি হলে আমাদের দেশের মানুষ মানুষকে আর মানুষ মনে করে না। এটা যে কি মানসিকতা তৈরি হয়েছে আমি জানিনা। এটা কি সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকের মানসিকতা? তার মানে আমার সমাজে মৌলিকভাবে পরিবর্তন হয়েছে।
এখন মানুষ নিজেরটা নিজে দেখতে পারে। আইনিভাবেও চলতে পারে, আবার বেআইনিভাবেও চলতে পারে। যেটা তার পোষাবে সেটাই সে করবে। আর সেটাই হয়ে গেছে সমাজের বাস্তবতা। আর গবেষণার দিক থেকে দেখা যায়, আগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা হতো বাস থেকে নামার পর। কারণ পিছন থেকে ধাক্কা দিত। কিন্তু এখন মানুষ আল্লার নাম পড়তে পড়তে, হাত দিয়ে থামিয়ে রাস্তা পার হয়। আমার এক স্টুডেন্ট হাত ধরে রাস্তা পার করে দিলো। ও রাস্তা না পার করে দিলে আমি কিভাবে অনুষ্ঠানে যেতাম। এখন আমাদের এর মধ্যেই চলতে হবে। এত ছোট বিষয় মনে হয় না সরকার কিছু করবে। রাস্তা পার হতে গিয়ে ভয়ের চোটে জান বের হয়ে যায়।

























