০১:৫৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দখল-দূষণে বেহাত উড়াল সড়কের নিচের জমি

➤ অবৈধ গ্যারেজ, বাজার ও ভাসমান মানুষের দখল
➤ বার্ষিক ক্ষতি ২১ হাজার কোটি টাকা

উপরে ফিটফাট সড়ক আর নিচে ময়লার ভাগাড়, রিকশা-ভ্যান গ্যারেজ, অবৈধ পার্কিং, বিচিত্র সব দোকান। রাজধানীর উড়াল সড়কগুলোর নিচের এমন চিত্রের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন রাজধানীবাসী। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত মোট ১০৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ১০টি উড়ালপথের নিচে পড়ে আছে প্রায় ২০৭ একর জমি। এসব জায়াগা দখল-বেদখল, ব্যবহার-অব্যবহার ও অপব্যবহারে বেহাত হওয়ার পথে। যার কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা।

সম্প্রতি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) অর্থায়নে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজমের (সিআইএইউ) এক গবেষণায় বলা হয়, ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকায় উড়াল সড়কের নিচের জমির অপব্যবহার মূল্যবান নগর-সম্পদের অপচয়, যার বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাবের ফলে প্রতিবছর সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও জনস্বাস্থ্যগত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপরে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা অন্তত ২১ হাজার কোটি টাকা।
সরেজমিনে রাজধানীর কুড়িল, বাড্ডা, রামপুরা, মহাখালী, মালিবাগ, মৌচাক, খিলগাঁও, তেজগাঁও, ফার্মগেট, মগবাজার, গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়িসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে উড়াল সড়কগুলোর নিচের জায়গার দখল-দূষণের ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। রাজধানীর দীর্ঘতম উড়ালসড়ক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ উড়ালসড়ক ঘুরে দেখা যায়, যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান উড়ালসড়কের নিচের অংশে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। সাড়ে ১১ কিলোমিটার উড়ালসড়কের নিচের সড়কের বেশিরভাগ অংশ বাউন্ডারি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এর ফলে ছোট হয়ে গেছে নিচের সড়ক। বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা অংশকে মিডিয়ান বলা হয়।

 

মিডিয়ানগুলো স্থান ভেদে সাড়ে তিন মিটার থেকে ছয় মিটার পর্যন্ত চওড়া। মিডিয়ানের ওপর নানা অস্থায়ী স্থাপনা গড়ে উঠেছে। মিডিয়ানের ভেতরে রিক্সা, ভ্যান ও গাড়ির গ্যারেজ, পাবলিক টয়লেট, দোকানপাট, পরিচ্ছন্ন কর্মীদের আবাসস্থল, ঘোড়ার আস্তাবল, পুলিশ বক্স ও বিভিন্ন পণ্যের গুদাম ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলে ডাস্টবিন বানিয়ে রাখা হয়েছে উড়ালসড়কের নিচের মিডিয়ানে। চানখাঁরপুল এলাকায় মিডিয়ানের ওপর রাখা হয়েছে ঘোড়ার গাড়ি, ঘোড়া, বিভিন্ন দোকানের মালামাল। বঙ্গবাজার থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত অংশে মিডিয়ানজুড়ে খাবারের দোকান। ফুলবাড়িয়া থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত অংশে মিডিয়ানজুড়ে বসানো হয়েছে অস্থায়ী জুতার দোকান। মিডিয়ানের কারণে ফ্লাইওভারের নিচের সড়ক সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান। রাজধানীর অন্য উড়ালসড়কগুলোর নিচের চিত্রও প্রায় কাছাকাছি। যারা এগুলো দখল করে রেখেছে তারা স্থায়ী প্রভাবশালী, সিটি করপোরেশনের কিছু কর্মচারী ও পুলিশকে ম্যানেজ করে চলে বলে অভিযোগ আছে।

 

নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মূল্যবান নগর-জমিগুলোকে সৃজনশীল ও জনবান্ধব পরিকল্পনার মাধ্যমে গণপরিসরে রূপান্তর করা সম্ভব। পরিকল্পনা অনুযায়ী এসব জমিতে জনগণের জন্য পাবলিক টয়লেট, খেলার স্পেস, সবুজায়ন, হাঁটার পথ, জলাধারসহ নানা উপায়ে ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব।

সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজমের নির্বাহী পরিচালক স্থপতি অধ্যাপক ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ জানান, উড়াল সড়ক যেমন নগরের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থাকে গতিশীল করছে, তেমনি এর নিচের জায়গাগুলোও গণপরিসর তৈরিতে ও জনকল্যাণমুখী কাজে ব্যবহার করার সুযোগ আছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বর্তমানে উড়াল সড়ক ও এলিভেটেড স্ট্রাকচারের নিচের অংশে জনবান্ধব, টেকসই ও সাশ্রয়ীভাবে ব্যবহার উপযোগী কমিউনিটি জোন তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে থাকছে হাঁটাচলার পথ ও সাইকেলের লেন, নগর-কৃষি, বাগান, বনায়ন ও খেলাধুলার ব্যবস্থা। কিছু জায়গায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও শরীরচর্চা কেন্দ্র, সুইমিং পুল, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং পথনাটক ও শিল্পকর্ম প্রদর্শনের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। অনেক জায়গায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা নিম্নআয়ের মানুষেরা সম্পৃক্ত হচ্ছেন। উড়ালসড়কের মতো অবকাঠামোর বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা।

 

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা সম্প্রতি মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচের জায়গাকে স্ট্রিট আর্টের মাধ্যমে নান্দনিক ও আকর্ষণীয় করে তুলেছি। সাতরাস্তা ফ্লাইওভারের পিলারগুলোতেও স্ট্রিট আর্ট করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমরা উড়াল সড়কের নিচের অব্যবহৃত জায়গাগুলো নিয়ে এরই মধ্যে ভাবতে শুরু করেছি।

জনপ্রিয় সংবাদ

স্মৃতিসৌধে তারেক রহমান

দখল-দূষণে বেহাত উড়াল সড়কের নিচের জমি

আপডেট সময় : ১০:১০:০৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ জুন ২০২৪

➤ অবৈধ গ্যারেজ, বাজার ও ভাসমান মানুষের দখল
➤ বার্ষিক ক্ষতি ২১ হাজার কোটি টাকা

উপরে ফিটফাট সড়ক আর নিচে ময়লার ভাগাড়, রিকশা-ভ্যান গ্যারেজ, অবৈধ পার্কিং, বিচিত্র সব দোকান। রাজধানীর উড়াল সড়কগুলোর নিচের এমন চিত্রের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন রাজধানীবাসী। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত মোট ১০৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ১০টি উড়ালপথের নিচে পড়ে আছে প্রায় ২০৭ একর জমি। এসব জায়াগা দখল-বেদখল, ব্যবহার-অব্যবহার ও অপব্যবহারে বেহাত হওয়ার পথে। যার কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা।

সম্প্রতি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) অর্থায়নে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজমের (সিআইএইউ) এক গবেষণায় বলা হয়, ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকায় উড়াল সড়কের নিচের জমির অপব্যবহার মূল্যবান নগর-সম্পদের অপচয়, যার বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাবের ফলে প্রতিবছর সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও জনস্বাস্থ্যগত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপরে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা অন্তত ২১ হাজার কোটি টাকা।
সরেজমিনে রাজধানীর কুড়িল, বাড্ডা, রামপুরা, মহাখালী, মালিবাগ, মৌচাক, খিলগাঁও, তেজগাঁও, ফার্মগেট, মগবাজার, গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়িসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে উড়াল সড়কগুলোর নিচের জায়গার দখল-দূষণের ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। রাজধানীর দীর্ঘতম উড়ালসড়ক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ উড়ালসড়ক ঘুরে দেখা যায়, যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান উড়ালসড়কের নিচের অংশে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। সাড়ে ১১ কিলোমিটার উড়ালসড়কের নিচের সড়কের বেশিরভাগ অংশ বাউন্ডারি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এর ফলে ছোট হয়ে গেছে নিচের সড়ক। বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা অংশকে মিডিয়ান বলা হয়।

 

মিডিয়ানগুলো স্থান ভেদে সাড়ে তিন মিটার থেকে ছয় মিটার পর্যন্ত চওড়া। মিডিয়ানের ওপর নানা অস্থায়ী স্থাপনা গড়ে উঠেছে। মিডিয়ানের ভেতরে রিক্সা, ভ্যান ও গাড়ির গ্যারেজ, পাবলিক টয়লেট, দোকানপাট, পরিচ্ছন্ন কর্মীদের আবাসস্থল, ঘোড়ার আস্তাবল, পুলিশ বক্স ও বিভিন্ন পণ্যের গুদাম ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলে ডাস্টবিন বানিয়ে রাখা হয়েছে উড়ালসড়কের নিচের মিডিয়ানে। চানখাঁরপুল এলাকায় মিডিয়ানের ওপর রাখা হয়েছে ঘোড়ার গাড়ি, ঘোড়া, বিভিন্ন দোকানের মালামাল। বঙ্গবাজার থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত অংশে মিডিয়ানজুড়ে খাবারের দোকান। ফুলবাড়িয়া থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত অংশে মিডিয়ানজুড়ে বসানো হয়েছে অস্থায়ী জুতার দোকান। মিডিয়ানের কারণে ফ্লাইওভারের নিচের সড়ক সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান। রাজধানীর অন্য উড়ালসড়কগুলোর নিচের চিত্রও প্রায় কাছাকাছি। যারা এগুলো দখল করে রেখেছে তারা স্থায়ী প্রভাবশালী, সিটি করপোরেশনের কিছু কর্মচারী ও পুলিশকে ম্যানেজ করে চলে বলে অভিযোগ আছে।

 

নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মূল্যবান নগর-জমিগুলোকে সৃজনশীল ও জনবান্ধব পরিকল্পনার মাধ্যমে গণপরিসরে রূপান্তর করা সম্ভব। পরিকল্পনা অনুযায়ী এসব জমিতে জনগণের জন্য পাবলিক টয়লেট, খেলার স্পেস, সবুজায়ন, হাঁটার পথ, জলাধারসহ নানা উপায়ে ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব।

সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজমের নির্বাহী পরিচালক স্থপতি অধ্যাপক ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ জানান, উড়াল সড়ক যেমন নগরের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থাকে গতিশীল করছে, তেমনি এর নিচের জায়গাগুলোও গণপরিসর তৈরিতে ও জনকল্যাণমুখী কাজে ব্যবহার করার সুযোগ আছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বর্তমানে উড়াল সড়ক ও এলিভেটেড স্ট্রাকচারের নিচের অংশে জনবান্ধব, টেকসই ও সাশ্রয়ীভাবে ব্যবহার উপযোগী কমিউনিটি জোন তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে থাকছে হাঁটাচলার পথ ও সাইকেলের লেন, নগর-কৃষি, বাগান, বনায়ন ও খেলাধুলার ব্যবস্থা। কিছু জায়গায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও শরীরচর্চা কেন্দ্র, সুইমিং পুল, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং পথনাটক ও শিল্পকর্ম প্রদর্শনের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। অনেক জায়গায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা নিম্নআয়ের মানুষেরা সম্পৃক্ত হচ্ছেন। উড়ালসড়কের মতো অবকাঠামোর বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা।

 

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা সম্প্রতি মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচের জায়গাকে স্ট্রিট আর্টের মাধ্যমে নান্দনিক ও আকর্ষণীয় করে তুলেছি। সাতরাস্তা ফ্লাইওভারের পিলারগুলোতেও স্ট্রিট আর্ট করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমরা উড়াল সড়কের নিচের অব্যবহৃত জায়গাগুলো নিয়ে এরই মধ্যে ভাবতে শুরু করেছি।