◉ জ্বালানি খাতকে শক্তিশালী করতে প্রধান মিত্র হিসেবে কাজ করছে নরওয়ে, সুইডেন ও ডেনমার্ক
◉ বাংলাদেশসহ ৮টি দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা নরওয়ের
◉ বাংলাদেশে ৫০০ মেগাওয়াট অফশোর উইন্ড এনার্জি উৎপাদনের লক্ষ্যে ১.৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব ডেনমার্কের
দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ তার নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতকে শক্তিশালী করতে এবং শক্তির দক্ষতা বাড়াতে আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব চেয়েছে। আর এই অংশীদারত্বে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসছে নর্ডিক দেশগুলো। যেমন- নরওয়ে, সুইডেন এবং ডেনমার্ক। এ তিনটি দেশ বাংলাদেশের জ্বালানি খাতকে শক্তিশালী করতে প্রধান মিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং কৌশলগত সহযোগিতার মাধ্যমে এই দেশগুলো বাংলাদেশকে একটি সবুজ এবং টেকসই সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে।
নরওয়ে-বাংলাদেশ শক্তি সহযোগিতা: উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য নরওয়ের বিনিয়োগ তহবিল নরফান্ড ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর বাংলাদেশসহ ৮টি দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা করেছে। এই বিনিয়োগটি জলবায়ু বিনিয়োগ তহবিল বা সিআইএফ দ্বারা পরিচালিত, যা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি এবং কম-কার্বন প্রযুক্তির প্রচারে ফোকাস করে থাকে। এই উদ্যোগের লক্ষ্য বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বায়ু খামার এবং ছাদে সৌর স্থাপনার উন্নয়ন, যা দেশের টেকসই শক্তি অবকাঠামোকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করবে। এই কৌশলগত বিনিয়োগ সবুজ শক্তির উৎসে রূপান্তরের বৈশ্বিক প্রচেষ্টার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে তুলে ধরবে। সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বায়ু খামারের উপর নজর, বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে প্রচুর সূর্যালোক এবং উপকূলীয় বায়ু রয়েছে, ফলে এই প্রযুক্তিগুলোকে অত্যন্ত কার্যকর করে তোলা সম্ভব এখানে। ছাদে সৌর ইনস্টলেশনের উপর জোর দিয়ে বিকেন্দ্রিভূত শক্তি সমাধানগুলোর পথ প্রশস্ত করা যাতে শহর ও গ্রামীণ উভয় এলাকায় সরাসরি শক্তি সরবরাহ করা সম্ভব হয়। নরফান্ডের বিনিয়োগ শুধুমাত্র আর্থিক সংস্থানই আনে না বরং নবায়নযোগ্য শক্তিতে নরওয়ের বিস্তৃত অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতাকেও কাজে লাগায়। এই সহযোগিতা বাংলাদেশে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং শক্তি দক্ষতা উন্নত করবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষজ্ঞরা। নবায়নযোগ্য শক্তিকে তার পাওয়ার গ্রিডে একীভূত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করবে এবং শক্তি নিরাপত্তা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশের জ্বালানি ও পোশাক খাত রূপান্তরের প্রতি সুইডেনের প্রতিশ্রুতি: সুইডেন বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের উন্নয়নে সহায়তা করার প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেছে। ২০২০ সালের ১০ নভেম্বর সুইডেন দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অবকাঠামো উন্নত করতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করার আগ্রহ প্রকাশ করে। এই অংশীদারত্বের মধ্যে রয়েছে ট্রান্সমিশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেম এবং সাশ্রয়ী মূল্যের শক্তি উৎপাদন। এই সেক্টরে সুইডেনের সম্পৃক্ততা দক্ষতার আদান-প্রদান এবং টেকসই উন্নয়নকে উৎসাহিত করার উপর জোর দেয়। সহযোগিতার লক্ষ্য বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে ওঠা- যেমন ট্রান্সমিশন লস, অপর্যাপ্ত বণ্টন নেটওয়ার্ক এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অনুশীলন। এসব ক্ষেত্রে উন্নতির মাধ্যমে সুইডেন বাংলাদেশে আরও দক্ষ ও টেকসই জ্বালানি অবকাঠামো তৈরি করতে চায়। এই সহযোগিতার একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক চলতি বছরের গত ৫ মে সামনে এসেছিল। যখন সুইডেন বাংলাদেশের পোশাক খাতের মধ্যে সবুজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি অংশীদারত্বের প্রস্তাব করেছিল, যা দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদানকারী হিসেবে প্রতিভাত হয়। এই প্রস্তাবটি শিল্প ক্রিয়াকলাপে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উন্নয়ন এবং শক্তি দক্ষতার গুরুত্বের উপর জোর দেয়। প্রতিবেদনে চলমান এবং প্রস্তাবিত সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো তুলে ধরা হয়েছে, যার লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে ক্লিন এনার্জি থেকে বাংলাদেশে ৪০% বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। সুইডেনের এমন যুগান্তকারী উদ্যোগ বাংলাদেশকে আরও টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব শিল্প খাত অর্জনে সহায়তা করার বৃহত্তর অঙ্গীকারের প্রতিফলিত। এর মধ্যে পোশাক শিল্পের উপর বিশেষ ফোকাস, যা অন্যান্য দেশে উচ্চ শক্তি খরচের জন্য পরিচিত, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তর এবং শক্তি-দক্ষ অনুশীলন বাস্তবায়নের মাধ্যমে, পোশাক খাত কার্বন নির্গমন কমাতে সক্ষম হবে এবং বাংলাদেশের সামগ্রিক টেকসই লক্ষ্যে অবদান রাখতে পারবে।
বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিপ্লবে ডেনমার্কের ভূমিকা : নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে উল্লেখযোগ্য একটি দেশ ডেনমার্ক বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে সহায়তার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ডেনিশ কোম্পানি কোপেনহেগেন ইনফ্রাস্ট্রাকচার পার্টনার্স (সিআইপি) এবং কোপেনহেগেন অফশোর পার্টনার্স (সিওপি) বাংলাদেশে ৫০০ মেগাওয়াট অফশোর উইন্ড এনার্জি উৎপাদনের লক্ষ্যে ১.৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। এই চলমান প্রকল্পটি মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যার লক্ষ্য বাংলাদেশে জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা এবং টেকসই উন্নয়ন বৃদ্ধি করা। এ জন্য বঙ্গোপসাগরের উপকূলে একটি বাণিজ্যিক অফশোর উইন্ড প্রজেক্ট তৈরির প্রস্তাবনা রয়েছে। এই প্রকল্পটি এই অঞ্চলের শক্তিশালী উপকূলীয় বায়ুকে পরিচ্ছন্ন শক্তি বা ক্লিন এনার্জি উৎপাদনে কাজে লাগাবে বলে আশা করা হচ্ছে; যা বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখবে। উপরন্তু, সামিট গ্রুপ, দক্ষিণ এশিয়ার একটি বিশিষ্ট অবকাঠামো অপারেটর এবং বিকাশকারী সংস্থাগুলো প্রকল্পের সম্ভাব্য অগ্রগতিকে আরও জোরদার করতে এই কনসোর্টিয়ামে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ২০২৩ সালের ৯ জুন বাংলাদেশ এবং ডেনমার্ক টেকসই এবং সবুজ ফ্রেমওয়ার্ক এনগেজমেন্টের অধীনে একটি যৌথ কর্ম পরিকল্পনা (২০২৩-২০২৮) অনুমোদন করেছে। এই পরিকল্পনাটি তাদের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং সবুজ ও পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তিতে অংশীদারিত্বের ওপর জোর দেয়। এই সহযোগিতার লক্ষ্য নবায়নযোগ্য শক্তি, বৃত্তাকার অর্থনীতি, টেকসই নগরায়ণ এবং নীল অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের মাধ্যমে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা। বাংলাদেশের সঙ্গে তার সহযোগিতাকে আরও সুদৃঢ় করতে ডেনমার্কের যে গভীর আগ্রহ রয়েছে তাতে জয়েন্ট অ্যাকশন প্ল্যান নবায়নযোগ্য শক্তির উন্নয়ন, শক্তি দক্ষতার উন্নতি এবং টেকসই নগরায়ণকে উৎসাহিত করার কৌশলগুলোর আভাস দেয়। এটি একটি বৃত্তাকার অর্থনীতির গুরুত্বের উপরও জোর দেয়, যার লক্ষ্য বর্জ্য হ্রাস করা এবং সম্পদের সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। অধিকন্তু, নীল অর্থনীতির অন্তর্ভুক্তি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নত জীবিকা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সমুদ্র সম্পদের ব্যবহারের সম্ভাবনাকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা।
বাংলাদেশ-ফিনল্যান্ড জ্বালানি সহযোগিতা : ২০২২ সালের ২৮ নভেম্বর ফিনল্যান্ডের স্মার্ট অবকাঠামো দিবসে, ‘বিল্ডিং বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে, ফিনল্যান্ড বাংলাদেশের জ্বালানি খাত, স্মার্ট সিটি উদ্যোগ এবং স্মার্ট পোর্ট সমাধানে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। সেখানে ফিনিশ রাষ্ট্রদূত রিতভা কউক্কু-রন্ডে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার সুযোগ তুলে ধরেন, ফিনিশ কোম্পানিগুলোকে এই খাতে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানান। এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বাংলাদেশের উন্নয়নে ফিনিশ বিশেষজ্ঞদের সুবিধার ওপর জোর দেন। ঢাকায় ফিনিশ দূতাবাস এবং এফবিসিসিআই আয়োজিত এই সেমিনারে সম্ভাব্য সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনার সময় উভয় দেশের প্রধান ব্যবসায়িক ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ এবং নর্ডিক দেশ নরওয়ে, সুইডেন এবং ডেনমার্কের মধ্যে জ্বালানি সহযোগিতা টেকসই উন্নয়ন এবং নবায়নযোগ্য শক্তির বৈশ্বিক রূপান্তরের জন্য যৌথ অঙ্গীকার প্রদর্শন করে। এই অংশীদারত্বগুলো শক্তি দক্ষতা এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথেষ্ট আর্থিক বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং উদ্ভাবনী সমাধান প্রদান করে। নরফান্ডের মাধ্যমে নরওয়ের ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্য বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি অবকাঠামোকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করা, বিশ্বব্যাপী পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি খাতে দেশটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসাবে তুলে ধরা। সুইডেনের সহযোগিতার লক্ষ্য বাংলাদেশের শিল্প খাত, বিশেষ করে পোশাক শিল্পে শক্তির দক্ষতার উন্নতি এবং সবুজ পরিবর্তন। অফশোর বায়ু শক্তিতে ডেনমার্কের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ এবং সবুজ ফ্রেমওয়ার্ক এনগেজমেন্টের অধীনে জয়েন্ট অ্যাকশন প্ল্যান বিভিন্ন সেক্টরে উন্নয়নের দিকে ফোকাস করে।
এই সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি সবুজ এবং আরও টেকসই ভবিষ্যত অর্জনের বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। নরওয়ে, সুইডেন এবং ডেনমার্কের সহায়তা শুধু বাংলাদেশকে তার জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সাহায্য করে না বরং বৈশ্বিক জলবায়ু লক্ষ্যে অবদান রাখে। এই অংশীদারত্বগুলো টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শক্তি নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে একটি যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে। বাংলাদেশের সঙ্গে নর্ডিক দেশগুলোর জ্বালানি সহযোগিতা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মডেল হিসেবে কাজ করে। কৌশলগত বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং নবায়নযোগ্য শক্তির প্রতি অঙ্গীকারের মাধ্যমে নরওয়ে, সুইডেন এবং ডেনমার্ক বাংলাদেশকে একটি স্বচ্ছ, আরও স্থিতিশীল এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করতে সাহায্য করছে।






















