০৪:৪৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

হুঁমকির মুখে ট্যানারি শিল্প

➤ সিন্ডিকেটের কারণে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে না গুরুত্বপূর্ণ এ শিল্পখাত
➤ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৯ লাখ মানুষ এই খাতে জড়িত
➤ সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও মান নিশ্চিতে যথেষ্ঠ অভাব দেখছেন বিশেষজ্ঞরা
➤ এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত ট্যানারির সংখ্যা মাত্র ৬টি
➤ দূষণ বন্ধ না হওয়ায় বিদেশি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের অনিহা
➤ সাভারের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার ২ বছরে অর্ধেক সক্ষমতা হারিয়েছে

❖ কমপ্লায়েন্সের সমস্যার সমাধান, সহজ শর্তে ঋণ দেওয়াসহ যে সমস্যা সেটা সমাধান করলে চামড়া খাত এগিয়ে যাবে- মো. শাহীন আহমেদ, চেয়ারম্যান, বিটিএ
❖ কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার এখনো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পৌঁছাতে পারেনি- সাখাওয়াত উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক- বিটিএ

চামড়া দেশের গুরুত্বপূর্ণ রফতানি পণ্য। পোশাক শিল্পের পরই চামড়ার স্থান। আশির দশক থেকেই এই শিল্পের নানা সমস্যার কথা বলা হলেও একে একটি সুষ্ঠু কাঠামোর মধ্যে আনা যায়নি। বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে চামড়া শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বাস্তব পরিকল্পনার অভাব এবং আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত না করার কারণে এ শিল্পের বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে আছে। চামড়ার ওপর নির্ভর করে দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় ৯ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে গড়ে উঠেছে ২৩০টিরও বেশি ট্যানারি। গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম কম। কোরবানির সময় পানির চেয়েও কম দামে চামড়া বিক্রি হচ্ছে। আবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করার কারণে ও উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় অতীতে চামড়া নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে, মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। এ ধরনের খবর খুবই উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

১৯৫০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত রাজধানীর হাজারীবাগ ছিল ট্যানারি শিল্পের বৃহৎ ঠিকানা। কিন্তু ট্যানারি শিল্প এলাকায় ছিল না আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। আবার লোকালয়ের কাছে হওয়ায় এর দূষণ বিপর্যস্ত করছিল স্থানীয়দের, দূষিত হচ্ছিল বুড়িগঙ্গা। ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সরাতে ২০০৩ সালে সাভার চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্প হাতে নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। মোট ১২ দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হয় নগরী। ২০১৭ সালে বিসিকের নেতৃত্বে হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্প সাভারে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে সাভারে ১৪১টি ট্যানারি রয়েছে। যেখানে ৭শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারটি (সিইটিপি)। নিমার্ণের মাত্র ২ বছরেই মাথায় সক্ষমতা নেমেছে অর্ধেকে। প্রতিদিন ২৫ হাজার ঘনমিটার দূষিত পানি পরিশোধন করার সক্ষমতা সিইটিপিটির। চামড়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর সক্ষমতা ৫০ হাজার ঘনমিটার হওয়া উচিত ছিল। এখন সিইটিপি যে অবস্থায় আছে তা দিয়ে এলডাব্লিউজি সনদ পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি লেদার কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে ট্যানারির মালিকদের। আর এই সুযোগ নিচ্ছে চীন। তারা কম দামে বাংলাদেশ থেকে ওয়েট ব্লু লেদার কিনে নেয়। এরপর পণ্য তৈরি করে ইউরোপের বাজারে বেশি দামে বিক্রি করছে, যা সরাসরি বাংলাদেশে করতে পারত, যদি সিইটিপি সঠিক ভাবে তৈরি করা হতো এবং তার মাধ্যমে ট্যানারিগুলো এলডাব্লিউজি সনদ পেত। মূলত এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় দেশের চামড়া শিল্পের অগ্রগতি হচ্ছে না।

দেশের চামড়াশিল্প কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে এত পিছিয়ে আছে যে, বাংলাদেশে এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত ট্যানারির সংখ্যা মাত্র ৬টি, অথচ এ সংখ্যা ভারতে ১৩৯, চীনে ১০৩, ইতালিতে ৬৮, ব্রাজিলে ৬০, তাইওয়ানে ২৪, স্পেনে ১৭, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্কে ১৬ ও ভিয়েতনামে রয়েছে ১৪টি। এলডব্লিউজি সনদ না থাকার কারণে চামড়ার বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। দেশীয় কাঁচা চামড়ার পর্যাপ্ত জোগান থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিমুখী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পকারখানাগুলোকে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত ফিনিশড চামড়া আমদানি করতে হয়, যা কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে।

চামড়া খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্প নগরের দূষণ বন্ধ না হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি বাংলাদেশী চামড়া কিনছে না। ফলে বাংলাদেশী চামড়ার বড় ক্রেতা বর্তমানে চীন। তারা কম দাম দেয়। সেটির প্রভাব কাঁচা চামড়ার দামেও পড়ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, হাজারীবাগ থেকে যখন ট্যানারিগুলো স্থানান্তর করা হয়, তখন একজন মালিকও এই সিদ্ধান্তের কোনো প্রতিবাদ করেনি। কারণ নতুন শিল্প এলাকায় পরিবেশবান্ধব উৎপাদনে যেতে পারবে, এটা আমাদের সবারই চাওয়া ছিল। এ কারণে স্থানান্তরিত হওয়ার পরে মোট ১২ ট্যানারির ‘গ্যাপ অ্যানালাইসিস’ করা হয়। এর মধ্যে ১০টি ট্যানারি সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে, আর দুটি ঢাকার বাইরে। বাইরের ওই দুই প্রতিষ্ঠানের ইটিপি থাকার কারণে এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে। কিন্তু চামড়া শিল্পনগরীতে থাকা প্রতিষ্ঠান ১০টির একটিও এখনো সনদ পায়নি। এটার একমাত্র কারণ হলো এখানকার কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) এখনো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পৌঁছাতে পারেনি। আর কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণেও ট্যানারিগুলো এলডব্লিউজি সনদ থেকে বঞ্চিত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ট্যানারির মালিক বলেন, বর্তমানে চামড়া বাজার বেশ খারাপ। চলতি বছরে কতটা খারাপ হবে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। কারণ চামড়াশিল্পের সঙ্গে যুক্ত দেশীয় কোম্পানিগুলো মারাত্মক লোকসানের মুখে পড়েছে। ১৫৫টি ট্যানারির মধ্যে ৮ থেকে ১০টি ভালোভাবে চলছে। বাকিগুলো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের সময় মালিকদের মধ্যে আশার সঞ্চার ঘটে। বিদেশি ক্রেতারা মনে করেছিল বাংলাদেশে উন্নত মানের চামড়া ও চামড়জাত পণ্য তৈরি করছে। সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরে ট্যানারিগুলো নেওয়ার পর আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। এ কারণে ইউরোপের ক্রেতারা এখন আর আমাদের কথা বিশ্বাস করে না। তারা চামড়া কেনে না। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চামড়ার রপ্তানিবাজার নিম্নমুখী। ইউক্রেন-রাশিয়া ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ চলমান। বিশ্ববাজারে মূল্যস্ফীতি হার অনেক বেশি। এ ছাড়া আমাদের কমপ্লায়েন্সের ঘাটতি আছে। সবকিছু মিলিয়ে রপ্তানি কমে গেছে।

সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ট্যানারি মালিকদের এই নেতা বলেন, স্থানান্তরের পরে আমরা অনেকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এ কারণে আমরা যে প্রণোদনা পেয়ে থাকি সেটা যেন ২০২৬ সাল পর্যন্ত চালু রাখা হয় সেটাই আমাদের সরকারের কাছে প্রথম চাওয়া। এ ছাড়া কমপ্লায়েন্সের সমস্যার সমাধান করা। সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া, সিইটিপির যে সমস্যা সেটা সমাধান করা, তারপর সলিড বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা। এগুলো করলে আমাদের চামড়া খাত এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান দিলজাহান ভূঁইয়া বলেন, ‘হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের কারণে অনেক ক্রেতা অন্য দেশ বেছে নিচ্ছেন। কিছু চ্যালেঞ্জের কারণে অনেক ট্যানারি চালু হচ্ছে না। ২০০৫ সালে এলডব্লিউজি সনদ প্রবর্তনের আগে ইতালির মতো কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ থেকে চামড়া আমদানি করত।’

জনপ্রিয় সংবাদ

হুঁমকির মুখে ট্যানারি শিল্প

আপডেট সময় : ০৭:৩১:২০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪

➤ সিন্ডিকেটের কারণে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে না গুরুত্বপূর্ণ এ শিল্পখাত
➤ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৯ লাখ মানুষ এই খাতে জড়িত
➤ সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও মান নিশ্চিতে যথেষ্ঠ অভাব দেখছেন বিশেষজ্ঞরা
➤ এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত ট্যানারির সংখ্যা মাত্র ৬টি
➤ দূষণ বন্ধ না হওয়ায় বিদেশি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের অনিহা
➤ সাভারের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার ২ বছরে অর্ধেক সক্ষমতা হারিয়েছে

❖ কমপ্লায়েন্সের সমস্যার সমাধান, সহজ শর্তে ঋণ দেওয়াসহ যে সমস্যা সেটা সমাধান করলে চামড়া খাত এগিয়ে যাবে- মো. শাহীন আহমেদ, চেয়ারম্যান, বিটিএ
❖ কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার এখনো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পৌঁছাতে পারেনি- সাখাওয়াত উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক- বিটিএ

চামড়া দেশের গুরুত্বপূর্ণ রফতানি পণ্য। পোশাক শিল্পের পরই চামড়ার স্থান। আশির দশক থেকেই এই শিল্পের নানা সমস্যার কথা বলা হলেও একে একটি সুষ্ঠু কাঠামোর মধ্যে আনা যায়নি। বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে চামড়া শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বাস্তব পরিকল্পনার অভাব এবং আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত না করার কারণে এ শিল্পের বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে আছে। চামড়ার ওপর নির্ভর করে দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় ৯ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে গড়ে উঠেছে ২৩০টিরও বেশি ট্যানারি। গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম কম। কোরবানির সময় পানির চেয়েও কম দামে চামড়া বিক্রি হচ্ছে। আবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করার কারণে ও উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় অতীতে চামড়া নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে, মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। এ ধরনের খবর খুবই উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

১৯৫০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত রাজধানীর হাজারীবাগ ছিল ট্যানারি শিল্পের বৃহৎ ঠিকানা। কিন্তু ট্যানারি শিল্প এলাকায় ছিল না আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। আবার লোকালয়ের কাছে হওয়ায় এর দূষণ বিপর্যস্ত করছিল স্থানীয়দের, দূষিত হচ্ছিল বুড়িগঙ্গা। ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সরাতে ২০০৩ সালে সাভার চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্প হাতে নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। মোট ১২ দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হয় নগরী। ২০১৭ সালে বিসিকের নেতৃত্বে হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্প সাভারে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে সাভারে ১৪১টি ট্যানারি রয়েছে। যেখানে ৭শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারটি (সিইটিপি)। নিমার্ণের মাত্র ২ বছরেই মাথায় সক্ষমতা নেমেছে অর্ধেকে। প্রতিদিন ২৫ হাজার ঘনমিটার দূষিত পানি পরিশোধন করার সক্ষমতা সিইটিপিটির। চামড়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর সক্ষমতা ৫০ হাজার ঘনমিটার হওয়া উচিত ছিল। এখন সিইটিপি যে অবস্থায় আছে তা দিয়ে এলডাব্লিউজি সনদ পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি লেদার কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে ট্যানারির মালিকদের। আর এই সুযোগ নিচ্ছে চীন। তারা কম দামে বাংলাদেশ থেকে ওয়েট ব্লু লেদার কিনে নেয়। এরপর পণ্য তৈরি করে ইউরোপের বাজারে বেশি দামে বিক্রি করছে, যা সরাসরি বাংলাদেশে করতে পারত, যদি সিইটিপি সঠিক ভাবে তৈরি করা হতো এবং তার মাধ্যমে ট্যানারিগুলো এলডাব্লিউজি সনদ পেত। মূলত এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় দেশের চামড়া শিল্পের অগ্রগতি হচ্ছে না।

দেশের চামড়াশিল্প কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে এত পিছিয়ে আছে যে, বাংলাদেশে এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত ট্যানারির সংখ্যা মাত্র ৬টি, অথচ এ সংখ্যা ভারতে ১৩৯, চীনে ১০৩, ইতালিতে ৬৮, ব্রাজিলে ৬০, তাইওয়ানে ২৪, স্পেনে ১৭, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্কে ১৬ ও ভিয়েতনামে রয়েছে ১৪টি। এলডব্লিউজি সনদ না থাকার কারণে চামড়ার বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। দেশীয় কাঁচা চামড়ার পর্যাপ্ত জোগান থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিমুখী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পকারখানাগুলোকে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত ফিনিশড চামড়া আমদানি করতে হয়, যা কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে।

চামড়া খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্প নগরের দূষণ বন্ধ না হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি বাংলাদেশী চামড়া কিনছে না। ফলে বাংলাদেশী চামড়ার বড় ক্রেতা বর্তমানে চীন। তারা কম দাম দেয়। সেটির প্রভাব কাঁচা চামড়ার দামেও পড়ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, হাজারীবাগ থেকে যখন ট্যানারিগুলো স্থানান্তর করা হয়, তখন একজন মালিকও এই সিদ্ধান্তের কোনো প্রতিবাদ করেনি। কারণ নতুন শিল্প এলাকায় পরিবেশবান্ধব উৎপাদনে যেতে পারবে, এটা আমাদের সবারই চাওয়া ছিল। এ কারণে স্থানান্তরিত হওয়ার পরে মোট ১২ ট্যানারির ‘গ্যাপ অ্যানালাইসিস’ করা হয়। এর মধ্যে ১০টি ট্যানারি সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে, আর দুটি ঢাকার বাইরে। বাইরের ওই দুই প্রতিষ্ঠানের ইটিপি থাকার কারণে এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে। কিন্তু চামড়া শিল্পনগরীতে থাকা প্রতিষ্ঠান ১০টির একটিও এখনো সনদ পায়নি। এটার একমাত্র কারণ হলো এখানকার কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) এখনো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পৌঁছাতে পারেনি। আর কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণেও ট্যানারিগুলো এলডব্লিউজি সনদ থেকে বঞ্চিত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ট্যানারির মালিক বলেন, বর্তমানে চামড়া বাজার বেশ খারাপ। চলতি বছরে কতটা খারাপ হবে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। কারণ চামড়াশিল্পের সঙ্গে যুক্ত দেশীয় কোম্পানিগুলো মারাত্মক লোকসানের মুখে পড়েছে। ১৫৫টি ট্যানারির মধ্যে ৮ থেকে ১০টি ভালোভাবে চলছে। বাকিগুলো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের সময় মালিকদের মধ্যে আশার সঞ্চার ঘটে। বিদেশি ক্রেতারা মনে করেছিল বাংলাদেশে উন্নত মানের চামড়া ও চামড়জাত পণ্য তৈরি করছে। সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরে ট্যানারিগুলো নেওয়ার পর আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। এ কারণে ইউরোপের ক্রেতারা এখন আর আমাদের কথা বিশ্বাস করে না। তারা চামড়া কেনে না। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চামড়ার রপ্তানিবাজার নিম্নমুখী। ইউক্রেন-রাশিয়া ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ চলমান। বিশ্ববাজারে মূল্যস্ফীতি হার অনেক বেশি। এ ছাড়া আমাদের কমপ্লায়েন্সের ঘাটতি আছে। সবকিছু মিলিয়ে রপ্তানি কমে গেছে।

সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ট্যানারি মালিকদের এই নেতা বলেন, স্থানান্তরের পরে আমরা অনেকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এ কারণে আমরা যে প্রণোদনা পেয়ে থাকি সেটা যেন ২০২৬ সাল পর্যন্ত চালু রাখা হয় সেটাই আমাদের সরকারের কাছে প্রথম চাওয়া। এ ছাড়া কমপ্লায়েন্সের সমস্যার সমাধান করা। সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া, সিইটিপির যে সমস্যা সেটা সমাধান করা, তারপর সলিড বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা। এগুলো করলে আমাদের চামড়া খাত এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান দিলজাহান ভূঁইয়া বলেন, ‘হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের কারণে অনেক ক্রেতা অন্য দেশ বেছে নিচ্ছেন। কিছু চ্যালেঞ্জের কারণে অনেক ট্যানারি চালু হচ্ছে না। ২০০৫ সালে এলডব্লিউজি সনদ প্রবর্তনের আগে ইতালির মতো কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ থেকে চামড়া আমদানি করত।’