সাইফ আশরাফ
- নির্বাচন ঘিরে চলছে নানা প্রস্তুতি
- তৃণমূলকে চাঙা করার উদ্যোগ
- প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করবেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা
ঘনিয়ে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা রয়েছে। এ নির্বাচন ঘিরে পুরোদমে মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ। বিদেশি চাপ ও বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলার পাশাপাশি তৃণমূলের কোন্দল নিরসনেও মনোযোগী দলটি। তৃণমূলকে চাঙা করতে সেপ্টেম্বরের শুরুতেই ঢাকায় বড় সমাবেশ করেছে দলটি। এর আগে আগস্টে তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে বিশেষ বর্ধিত সভা করেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনি প্রচারণার পাশাপাশি তৃণমূলের কোন্দল যাতে হিতে বিপরীত না হয়ে দাঁড়ায় সেজন্য সমান মনোযোগী দলটির শীর্ষমহল। কোন্দলে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট ও সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়লে নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। তাই আগামী নির্বাচনের আগে কোন্দল মিটিয়ে দলকে সুশৃঙ্খল করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বর্ধিত সভায় তৃণমূল নেতাদের কোন্দল মিটিয়ে দলের পক্ষে নির্বাচনে কাজ করতে বার্তা দিয়েছেন। তৃণমূলে বিরোধ নিরসন সম্ভব না হলে ঢাকায় তলব করে কোন্দল মেটানোর উদ্যোগ নেয়া হবে। প্রয়োজনে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাও হস্তক্ষেপ করবেন।
দলটির বিভাগীয় টিম, জেলা ও উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে মাঠের রিপোর্ট গ্রহণ ও নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। জেলা ও উপজেলা কমিটি ঘোষণার আগে কোন্দল নিরসনের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। তবে পদে পদে সম্মুখীন হতে হচ্ছে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গত সাড়ে ১৪ বছরে সৃষ্ট কোন্দল স্থায়ী ও প্রকট রূপ নিয়েছে। হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে মাঠের রিপোর্ট গ্রহণ ও নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন।

তৃণমূলের নেতারা বলছেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের ভেতরে নানা রকম গ্রুপিং বা কোন্দল তৈরি হয়েছে। গ্রুপিং, পাল্টাপাল্টি কমিটি ঘোষণা ও বহিষ্কার, মুখোমুখি সংঘর্ষ এবং হামলা-মামলা লেগেই আছে। আর এ দ্বন্দ্বে মূল নেতৃত্বে রয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা। বারবার নির্দেশনার পরও বিভেদের রাজনীতির কারণে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এসব ঘটনা। তৃণমূলে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি জোটের মোকাবিলার চেয়ে দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারা জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত ততই বাড়ছে। দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ছাড়াও প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম ও হত্যা, গুলি করে হত্যার মতো নৃশংস ঘটনাও ঘটছে অহরহ। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলেরই অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েকশ। নির্বাচনে প্রতিপক্ষ, স্থানীয় রাজনীতিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, নিজস্ব বলয় তৈরিসহ নানা কারণে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন নেতারা। রোববারের বর্ধিত সভায়ও দলীয় কোন্দলের বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেন তৃণমূলের নেতারা। নেতাদের বক্তব্যের সময় বেশ কয়েকবার মৃদু হট্টগোল হয়। দলীয় সভাপতির সামনে মঞ্চে বক্তব্য দেয়ার সময় বর্ধিত সভায় আসা নেতাদের ধমক দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। বর্ধিত সভায় তারা অভিযোগ করেন, অনেক এলাকায় মন্ত্রী এমপিরা দলের বাইরে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন। তারা দলীয় নেতাকর্মীদের খুব একটা মূল্যায়ন করেন না। এ ছাড়া সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও তারা নেতাকর্মীদের পরামর্শকে গুরুত্ব দেন না।
বিশেষ করে , স্থানীয় নির্বাচনের সময় এই বিরোধের বিষয়টি দলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় দলীয় কোন্দলের কারণে অনেক স্থানে সহিংসতা এবং হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। কোন্দলে জড়িত থাকার অভিযোগে সে সময় কয়েকজন সংসদ সদস্য বা কেন্দ্রীয় নেতাকে দল থেকে অব্যাহতিও দেয়া হয়েছিল। পরে অবশ্য তাদের আবার দলে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। দলীয় কোন্দলের সবচেয়ে বড় প্রভাব দেখা গেছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। বিদ্রোহের জের ধরে আওয়ামী লীগের টিকিটে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। নির্বাচনে তার প্রার্থিতা বাতিল হয়ে গেলেও সেখানে প্রার্থী করা হয় জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনকে। নিজের অনুসারীদের সমর্থনে জায়েদা খাতুন গাজীপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। গত ২৮ জুলাই বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগের তিন অঙ্গ সংগঠনের শান্তি সমাবেশ শেষে সরকারদলীয় এমপি কামরুল ইসলাম ও কেরানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন গ্রুপের দ্বন্দ্বে দুপক্ষের সংঘর্ষে একজনের মৃত্যু ঘটে। গত ৮ জুন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে। এ সময় নেতাকর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় চেয়ার ছোড়াছুড়ি ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সমাবেশস্থলে। যে যার মতো ছোটাছুটি শুরু করেন। এতে সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। সমাবেশে আওয়ামী লীগ ছাড়াও ছাত্রলীগ, যুবলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা যোগ দেন। গ্রুপিংয়ের কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
দলীয় নেতারা জানান, দীর্ঘদিন টানা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকায় তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটানো বড় চ্যালেঞ্জ। এরই মধ্যে নানা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। তাদের আন্দোলন মোকাবিলার পাশাপাশি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে ক্ষমতাসীনদের ওপর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমেরিকার নতুন ভিসা নীতি। নির্বাচনি বছরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভোটের আগে আসন ভাগাভাগিসহ কয়েকটি ইস্যুতে শরিকদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে হবে দলটিকে। এসব কারণেই কেন্দ্রীয় নেতাদের তৃণমূলে সফর বৃদ্ধি, ঢাকায় ডেকে মীমাংসা করাসহ নানা উদ্যোগ নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক নেতা জানান, বিএনপি নির্বাচনে আসুক বা না আসুক, সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। সামনে নির্বাচনি যাত্রার অংশ হিসেবে খুলনা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেটে বিভাগীয় সমাবেশ হবে। সমাবেশে অংশ নিয়ে বক্তব্য রাখবেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সফরে তৃণমূলে বিভেদ ভুলে ঐক্য তৈরি হবে আশা তাদের।
বিশেষ করে মনোনয়ন দেয়ার পর অভ্যন্তরীণ কোন্দল সামাল দেয়া যায় সেদিকেও নজর রাখছেন দলের নেতারা। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দলীয় মনোনয়ন নিয়ে প্রায় ২০০ আসনে কোন্দলে জর্জরিত দল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি প্রার্থী। এ বিপুলসংখ্যক প্রার্থী সারা দেশের প্রতিটি নির্বাচনি এলাকায় যে যার মতো করে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। কোনো কোনো এলাকায় প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় অভ্যন্তরীণ বিরোধও মাথাচাড়া দিচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে নজর রাখছেন খোদ দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। বিশেষ বর্ধিত সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যাকেই মনোনয়ন দিই, ভালো-মন্দ, কানা-খোঁড়া যাই হোক, আপনাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে তাকেই জয়ী করবেন।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ বড় দল। অনেক নেতাকর্মীর মধ্যে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকে। আবার অনেক জায়গায় যোগ্য নেতার সংখ্যাও বেশি থাকে। তাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা আছে। তবে সেখানে কোন্দলের পর্যায়ে যাওয়ার মতো সুযোগ নেই। বর্ধিত সভায় তৃণমূল থেকে অনেকে কোন্দলের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দলীয় সভাপতি সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। আমি মনে করি, ওই মিটিং থেকে বের হওয়ার পরে নতুন করে আর কোন্দল করার কোনো সুযোগ নেই।
























