০৪:১৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চরম অবহেলিত সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত

✦ যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও নিরাপত্তার ঘাটতি
✦ পর্যটনের আন্তর্জাতিক মানে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৫
✦ পর্যটক আকৃষ্টে প্রচারের উদ্যোগ পর্যটন করপোরেশনের
✦ এ পর্যন্ত ৬৫ হাজার কর্মীর কর্মসংস্থান পর্যটন খাতে
✦ ২০৫০ সাল নাগাদ ৫১টি দেশের পর্যটক আসার প্রত্যাশা

বাংলাদেশের এই অঞ্চলে সেই প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন সময়ে বিখ্যাত পর্যটকেরা ভ্রমণ করেছেন। বর্তমানে দুর্বল যাতায়াত ব্যবস্থা ও সুন্দর পরিবেশের অভাবে দেশের পর্যটন খাত কাঙ্খিত সাফল্য অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। চরম অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত। পর্যটনের আন্তর্জাতিক মানেও অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও নিরাপত্তার ঘাটতিকে প্রধান সমস্যা হিসেবে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে, পর্যটক আকৃষ্টে নানা উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন সরকারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এরই অংশ হিসেবে বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করতে প্রচার বাড়ানো ও অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। দেশের পর্যটন খাতের উন্নয়নে গত অর্থবছরে প্রায় ৮০০-১০০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে এ প্রতিষ্ঠানটি। এ পর্যন্ত দেশে ৬৫ হাজার কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে পর্যটন খাতে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশে^র ৫১টি দেশের পর্যটকেরা বাংলাদেশে ভ্রমণ করবেন বলে সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা।

সূত্র জানায়, চীনের ইতিহাসখ্যাত পর্যটক ফা হিয়েন আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৩৯৯ অব্দে পায়ে হেঁটে বাংলা ভ্রমণে আসেন। হিউয়েন সাং ৬৩০-৫৪০ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলে ভ্রমণে আসেন। ১১৫১ সালে আসেন আরব দেশের পর্যটক সোলায়মান। ১৩৪৬ খ্রিস্টাবে আসেন ইবনে বতুতা, ১৬৫৫ সালে ইতালির নিকোলা মানুচ্চি এই অঞ্চল ভ্রমণ করেছেন। বাংলাদেশের অপরুপ রূপ সৌন্দর্য্য খুব সহজেই আকৃষ্ট করে বিদেশী পর্যটকদের।

জাতিসংঘ ট্যুরিজমের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে বিশ^ব্যাপী ২৮৫ মিলিয়ন পর্যটক সারাবিশ^ ভ্রমণ করেছে। যা ২০২৩ সালের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। বিশ^ পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী, এবছর বিশে^র পর্যটন খাতের আয় ১১.১ ট্রিলিয়ন ডলার পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হয়। যা ২০২৩ সালে ছিল ৯.৯ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশে^র ৫১টি দেশের পর্যটকেরা বাংলাদেশে ভ্রমণ করবেন। যা মোট জিডিপির ১০ শতাংশ অবদান রাখবে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৯ শতাংশ হবে পর্যটন শিল্পের অবদান।

২০২৪ সালের মে মাসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম প্রকাশিত ‘ভ্রমণ ও পর্যটন উন্নয়ন সূচক ২০২৪’ এ বাংলাদেশেল অবস্থান ১০৯তম। ১১৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এই অবস্থানে রয়েছে। এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার ওপরে ভারত ৩৯। এরপর শ্রীলংকা, ৭৬তম। ১০১তম স্থানে আছে পাকিস্তান। নেপালের অবস্থান ১০৫তম। আর বাংলাদেশ সবার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার নিচে অবস্থান ১০৯তম।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন দেশে ১ হাজার ৫২৯টি পর্যটনকেন্দ্র বা আকর্ষণ চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৫০ টি কেন্দ্র মানুষের কাছে পরিচিত। দেশের পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারের আয়তন প্রায় ২৫০০ বর্গ কিলোমিটার হলেও প্রায় ৯০ শতাংশ স্থাপনা ২৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় সীমাবদ্ধ। কক্সবাজারের ১২০ কি. মি. দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত ও একটানা বালুকাময় সমুদ্র সৈকত থাকলেও তার ৯০ ভাগই অব্যবহৃত থাকে। কক্সবাজারের শেষ প্রান্তে সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের জন্য ১ ১৬৪ একর যায়গা পর্যটন কর্পোরেশনকে দেয়। কিন্তু তারা জনবলের অভাবে ব্যবহার করতে না পারায় তা পরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল বেজার হাতে হস্তান্তর করা হয়। ইউএনডাব্লিউটিএর তথ্যানুযায়ী, করোনার আগে বিশে^র প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ এক দেশ থেকে অন্যদেশে ভ্রমণ করেন। ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত বিশ^ব্যাপী পর্যটক আগমনের সংখ্যা ছিল ১৪০১ মিলিয়ন। এর মধ্যে ২০১৯ পর্যন্ত এশিয়া ও প্যাসিফিক মহাসাগরীয় দেশে পর্যটক আগমনের সংখ্যা ছিল ৩৪৮ মিলিয়ন।

পর্যটন বিশেষজ্ঞ মো. আব্দুল মালিকের মতে, দেশের পর্যটন খাতের সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, অনিরাপদ ও অস্বাস্থ্যকর (বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে) পরিবেশ, শৌচাগারের অভাব, পানীয় জল ও থাকা-খাওয়ার মানসম্মত সুলভ ব্যবস্থা না থাকা, দক্ষ গাইডের অভাব, যথাযথ প্রচারের অভাব।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক মো: জিয়াউল হক হাওলাদার নতুন বছরের কর্মপরিকল্পনা প্রসঙ্গে দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে শেখ হাসিনা সেতুর পাশে ৪৪ একর জমির উপরে চলমান প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এই প্রকল্পের আওতায় মাল্টিস্টোরেজ বিল্ডিং, পিকনিক স্পট, বিভিন্ন রাইডার্স তৈরি, আমবাগান, এমপি থিয়েটার, সুইমিং পুল, ওয়াটার বোট চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৬ কোটি টাকা। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এলাকাগুলো যেমন ভাগিয়াকূল ঘাট যেখানে তিনি নদী থেকে নামতেন এমন স্থান সংরক্ষণ, টুঙ্গীপাড়ায় মোটেল মধুমতীর সম্প্রসারণ কার্যক্রম চলবে। এছাড়া এটিপি সবুজ পাতায় অন্তর্ভূক্ত ৬টা প্রকল্প রংপুরের পীরগঞ্জে পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ আলী মিয়ার জন্মভিটায় লাইব্রেরী, স্মৃৃতিকেন্দ্র ও গেট স্থাপন, রংপুরে মোটেলের সংস্কার কার্যক্রম চলবে। বিদ্যমান ১০টি স্থাপনা সংস্কার ও আধুনিকায়নের কার্যক্রম চলবে। রাজশাহী, রংপুর, খুলনায় মংলা, যশোর বেনাপোল, কক্সবাজার জেলা ও টেকনাফ উপজেলা, দিনাজপুর, বগুড়া, থাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান এই জেলাগুলোতে এই কার্যক্রম চলছে। এই প্রকল্পগুলোর মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১০০ কোটি টাকার উপরে। কক্সবাজারে ৫ তলা হোটেল নির্মাণ করা হবে। ঢাকার মহাখালীস্থ পর্যটন ভবনে মালিস্টোরেজ বিল্ডিংয়ের পর্যটন সুবিধা বাড়ানোর প্রকল্প চলবে। কুয়াকাটায় ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। ভোলায় বঙ্গবন্ধু চিন্তা নিবাস নির্মাণ করা হবে পাশাপাশি আমরা সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণ করব। তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড় ও গোপালগঞ্জের এই প্রকল্পগুলো চলমান প্রকল্প। এই চলমান প্রকল্পগুলোর মোট বাজেট ৩০৪ কোটি টাকা। বাকিগুলো মধ্যমেয়াদী প্রকল্প। সবগুলো প্রকল্পের জন্য গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল প্রায় ১০০০ কোটি টাকা।

তিনি বলেন, এবছর আমরা প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম এগিয়ে নিতে ৪০ কোটি টাক চাইব। বিদ্যমান যে কার্যক্রমগুলো আছে সেগুলো সম্প্রসারণের জন্য আমরা কাজ করব। পর্যটক সুবিধাদি বৃদ্ধি করা, আধুনিকায়নের দিকে দৃষ্টি দেয়ার বিষয়টি থাকবে। বিদেশী ট্যুরিস্টকে ফোকাস করে রুমের মধ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা করা, পর্যটক অফিসগুলো সুন্দর করে সাজানো, সুভ্যিনির করা, দেশীয় খাবার পরিবেশনের সুবিধাদি বাড়ানো, বয়স্ক, শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নব্যক্তিদের জন্য তাদের উপযোগী পর্যটন স্থাপনা ও সুবিধাদি বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ম্যানেজার (সেলস প্রমোশন এন্ড পিআর) আকতার আহমেদ দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, আমরা দেশের পর্যটনখাতের উন্নয়নের জন্য প্রচার চালাচ্ছি। পর্যটন করপোরেশনের অধীনে যে হোটেল, মোটেলগুলো আছে সেগুলোতে পর্যটক আকর্ষণের জন্য প্রচার চালাচ্ছি। আবার বিভিন্ন পর্যটন স্পট ভ্রমণের ব্যাপারে প্রচার চালাচ্ছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক ও ওয়েবপেজে এ সংক্রান্ত প্রচার চলছে। এছাড়া, ব্রুশিয়ার, ক্যালেন্ডার, বিভিন্ন পর্যটনস্পটগুলোর পোস্টার, হ্যান্ডবুক তৈরির চিন্তাভাবনা আছে। পর্যটন হোটেল, স্থাপনাগুলো নিয়ে ৩০ সেকেণ্ড বা এক মিনিটের ভিডিও ডকুমেন্টারি তৈরির চিন্তাভাবনা করছি।

তিনি বলেন, আমাদের দেশের ট্যুরিজম সেক্টরে দক্ষ জনবলের ঘাটতি রয়েছে। এই অবস্থার পরিবর্তনে সেই ১৯৭২ সাল থেকে জাতীয় হোটেল ও পর্যটন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (এনএইচটিটিআই) কাজ করছে। এ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৬৫ হাজার শিক্ষার্থী বের হয়েছে যারা দেশে বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারা দেশের ট্যুরিজম সেক্টরের উন্নয়নে অবদান রাখছে। শিক্ষার্থীরা এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শর্ট কোর্স ও লং কোর্সে অংশ নিচ্ছে। গাইড, হাউজ কিপিং, ফুড এন্ড বেভারেজ, প্রডাকশন, ট্রাভেল টিকেটিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হচ্ছে। আমাদের কিছু রেন্টে কার সার্ভিস আছে। যা দিয়ে দেশী-বিদেশী ট্যুরিস্টদের যাতায়াত সুবিধা দিচ্ছি। ৪টি বড় কোচ ও ৪টি মাইক্রোবাস রয়েছে।

এদিকে, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন বিষয়ক মন্ত্রী ফারুক খান বলেছেন, ফারুক খান বলেন, বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের অবদান প্রায় ৪ শতাংশ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রায় ১.৭৮ শতাংশ। এ হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বময় করোনাভাইরাস সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পর্যটন খাত। করোনা অতিমারি সময়কালীন সময়েও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি ও আনুতোষিক পরিশোধ করেছে। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন বর্তমানেও তার লাভের ধারা অব্যাহত রেখেছে। সংস্থাটি নিজস্ব আয়ে পরিচালিত সরকারের একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান।

জনপ্রিয় সংবাদ

চরম অবহেলিত সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত

আপডেট সময় : ০৬:৪৩:৪৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ জুলাই ২০২৪

✦ যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও নিরাপত্তার ঘাটতি
✦ পর্যটনের আন্তর্জাতিক মানে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৫
✦ পর্যটক আকৃষ্টে প্রচারের উদ্যোগ পর্যটন করপোরেশনের
✦ এ পর্যন্ত ৬৫ হাজার কর্মীর কর্মসংস্থান পর্যটন খাতে
✦ ২০৫০ সাল নাগাদ ৫১টি দেশের পর্যটক আসার প্রত্যাশা

বাংলাদেশের এই অঞ্চলে সেই প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন সময়ে বিখ্যাত পর্যটকেরা ভ্রমণ করেছেন। বর্তমানে দুর্বল যাতায়াত ব্যবস্থা ও সুন্দর পরিবেশের অভাবে দেশের পর্যটন খাত কাঙ্খিত সাফল্য অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। চরম অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত। পর্যটনের আন্তর্জাতিক মানেও অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও নিরাপত্তার ঘাটতিকে প্রধান সমস্যা হিসেবে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে, পর্যটক আকৃষ্টে নানা উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন সরকারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এরই অংশ হিসেবে বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করতে প্রচার বাড়ানো ও অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। দেশের পর্যটন খাতের উন্নয়নে গত অর্থবছরে প্রায় ৮০০-১০০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে এ প্রতিষ্ঠানটি। এ পর্যন্ত দেশে ৬৫ হাজার কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে পর্যটন খাতে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশে^র ৫১টি দেশের পর্যটকেরা বাংলাদেশে ভ্রমণ করবেন বলে সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা।

সূত্র জানায়, চীনের ইতিহাসখ্যাত পর্যটক ফা হিয়েন আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৩৯৯ অব্দে পায়ে হেঁটে বাংলা ভ্রমণে আসেন। হিউয়েন সাং ৬৩০-৫৪০ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলে ভ্রমণে আসেন। ১১৫১ সালে আসেন আরব দেশের পর্যটক সোলায়মান। ১৩৪৬ খ্রিস্টাবে আসেন ইবনে বতুতা, ১৬৫৫ সালে ইতালির নিকোলা মানুচ্চি এই অঞ্চল ভ্রমণ করেছেন। বাংলাদেশের অপরুপ রূপ সৌন্দর্য্য খুব সহজেই আকৃষ্ট করে বিদেশী পর্যটকদের।

জাতিসংঘ ট্যুরিজমের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে বিশ^ব্যাপী ২৮৫ মিলিয়ন পর্যটক সারাবিশ^ ভ্রমণ করেছে। যা ২০২৩ সালের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। বিশ^ পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী, এবছর বিশে^র পর্যটন খাতের আয় ১১.১ ট্রিলিয়ন ডলার পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হয়। যা ২০২৩ সালে ছিল ৯.৯ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশে^র ৫১টি দেশের পর্যটকেরা বাংলাদেশে ভ্রমণ করবেন। যা মোট জিডিপির ১০ শতাংশ অবদান রাখবে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৯ শতাংশ হবে পর্যটন শিল্পের অবদান।

২০২৪ সালের মে মাসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম প্রকাশিত ‘ভ্রমণ ও পর্যটন উন্নয়ন সূচক ২০২৪’ এ বাংলাদেশেল অবস্থান ১০৯তম। ১১৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এই অবস্থানে রয়েছে। এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার ওপরে ভারত ৩৯। এরপর শ্রীলংকা, ৭৬তম। ১০১তম স্থানে আছে পাকিস্তান। নেপালের অবস্থান ১০৫তম। আর বাংলাদেশ সবার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার নিচে অবস্থান ১০৯তম।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন দেশে ১ হাজার ৫২৯টি পর্যটনকেন্দ্র বা আকর্ষণ চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৫০ টি কেন্দ্র মানুষের কাছে পরিচিত। দেশের পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারের আয়তন প্রায় ২৫০০ বর্গ কিলোমিটার হলেও প্রায় ৯০ শতাংশ স্থাপনা ২৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় সীমাবদ্ধ। কক্সবাজারের ১২০ কি. মি. দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত ও একটানা বালুকাময় সমুদ্র সৈকত থাকলেও তার ৯০ ভাগই অব্যবহৃত থাকে। কক্সবাজারের শেষ প্রান্তে সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের জন্য ১ ১৬৪ একর যায়গা পর্যটন কর্পোরেশনকে দেয়। কিন্তু তারা জনবলের অভাবে ব্যবহার করতে না পারায় তা পরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল বেজার হাতে হস্তান্তর করা হয়। ইউএনডাব্লিউটিএর তথ্যানুযায়ী, করোনার আগে বিশে^র প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ এক দেশ থেকে অন্যদেশে ভ্রমণ করেন। ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত বিশ^ব্যাপী পর্যটক আগমনের সংখ্যা ছিল ১৪০১ মিলিয়ন। এর মধ্যে ২০১৯ পর্যন্ত এশিয়া ও প্যাসিফিক মহাসাগরীয় দেশে পর্যটক আগমনের সংখ্যা ছিল ৩৪৮ মিলিয়ন।

পর্যটন বিশেষজ্ঞ মো. আব্দুল মালিকের মতে, দেশের পর্যটন খাতের সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, অনিরাপদ ও অস্বাস্থ্যকর (বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে) পরিবেশ, শৌচাগারের অভাব, পানীয় জল ও থাকা-খাওয়ার মানসম্মত সুলভ ব্যবস্থা না থাকা, দক্ষ গাইডের অভাব, যথাযথ প্রচারের অভাব।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক মো: জিয়াউল হক হাওলাদার নতুন বছরের কর্মপরিকল্পনা প্রসঙ্গে দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে শেখ হাসিনা সেতুর পাশে ৪৪ একর জমির উপরে চলমান প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এই প্রকল্পের আওতায় মাল্টিস্টোরেজ বিল্ডিং, পিকনিক স্পট, বিভিন্ন রাইডার্স তৈরি, আমবাগান, এমপি থিয়েটার, সুইমিং পুল, ওয়াটার বোট চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৬ কোটি টাকা। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এলাকাগুলো যেমন ভাগিয়াকূল ঘাট যেখানে তিনি নদী থেকে নামতেন এমন স্থান সংরক্ষণ, টুঙ্গীপাড়ায় মোটেল মধুমতীর সম্প্রসারণ কার্যক্রম চলবে। এছাড়া এটিপি সবুজ পাতায় অন্তর্ভূক্ত ৬টা প্রকল্প রংপুরের পীরগঞ্জে পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ আলী মিয়ার জন্মভিটায় লাইব্রেরী, স্মৃৃতিকেন্দ্র ও গেট স্থাপন, রংপুরে মোটেলের সংস্কার কার্যক্রম চলবে। বিদ্যমান ১০টি স্থাপনা সংস্কার ও আধুনিকায়নের কার্যক্রম চলবে। রাজশাহী, রংপুর, খুলনায় মংলা, যশোর বেনাপোল, কক্সবাজার জেলা ও টেকনাফ উপজেলা, দিনাজপুর, বগুড়া, থাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান এই জেলাগুলোতে এই কার্যক্রম চলছে। এই প্রকল্পগুলোর মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১০০ কোটি টাকার উপরে। কক্সবাজারে ৫ তলা হোটেল নির্মাণ করা হবে। ঢাকার মহাখালীস্থ পর্যটন ভবনে মালিস্টোরেজ বিল্ডিংয়ের পর্যটন সুবিধা বাড়ানোর প্রকল্প চলবে। কুয়াকাটায় ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। ভোলায় বঙ্গবন্ধু চিন্তা নিবাস নির্মাণ করা হবে পাশাপাশি আমরা সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণ করব। তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড় ও গোপালগঞ্জের এই প্রকল্পগুলো চলমান প্রকল্প। এই চলমান প্রকল্পগুলোর মোট বাজেট ৩০৪ কোটি টাকা। বাকিগুলো মধ্যমেয়াদী প্রকল্প। সবগুলো প্রকল্পের জন্য গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল প্রায় ১০০০ কোটি টাকা।

তিনি বলেন, এবছর আমরা প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম এগিয়ে নিতে ৪০ কোটি টাক চাইব। বিদ্যমান যে কার্যক্রমগুলো আছে সেগুলো সম্প্রসারণের জন্য আমরা কাজ করব। পর্যটক সুবিধাদি বৃদ্ধি করা, আধুনিকায়নের দিকে দৃষ্টি দেয়ার বিষয়টি থাকবে। বিদেশী ট্যুরিস্টকে ফোকাস করে রুমের মধ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা করা, পর্যটক অফিসগুলো সুন্দর করে সাজানো, সুভ্যিনির করা, দেশীয় খাবার পরিবেশনের সুবিধাদি বাড়ানো, বয়স্ক, শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নব্যক্তিদের জন্য তাদের উপযোগী পর্যটন স্থাপনা ও সুবিধাদি বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ম্যানেজার (সেলস প্রমোশন এন্ড পিআর) আকতার আহমেদ দৈনিক সবুজ বাংলাকে বলেন, আমরা দেশের পর্যটনখাতের উন্নয়নের জন্য প্রচার চালাচ্ছি। পর্যটন করপোরেশনের অধীনে যে হোটেল, মোটেলগুলো আছে সেগুলোতে পর্যটক আকর্ষণের জন্য প্রচার চালাচ্ছি। আবার বিভিন্ন পর্যটন স্পট ভ্রমণের ব্যাপারে প্রচার চালাচ্ছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক ও ওয়েবপেজে এ সংক্রান্ত প্রচার চলছে। এছাড়া, ব্রুশিয়ার, ক্যালেন্ডার, বিভিন্ন পর্যটনস্পটগুলোর পোস্টার, হ্যান্ডবুক তৈরির চিন্তাভাবনা আছে। পর্যটন হোটেল, স্থাপনাগুলো নিয়ে ৩০ সেকেণ্ড বা এক মিনিটের ভিডিও ডকুমেন্টারি তৈরির চিন্তাভাবনা করছি।

তিনি বলেন, আমাদের দেশের ট্যুরিজম সেক্টরে দক্ষ জনবলের ঘাটতি রয়েছে। এই অবস্থার পরিবর্তনে সেই ১৯৭২ সাল থেকে জাতীয় হোটেল ও পর্যটন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (এনএইচটিটিআই) কাজ করছে। এ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৬৫ হাজার শিক্ষার্থী বের হয়েছে যারা দেশে বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারা দেশের ট্যুরিজম সেক্টরের উন্নয়নে অবদান রাখছে। শিক্ষার্থীরা এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শর্ট কোর্স ও লং কোর্সে অংশ নিচ্ছে। গাইড, হাউজ কিপিং, ফুড এন্ড বেভারেজ, প্রডাকশন, ট্রাভেল টিকেটিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হচ্ছে। আমাদের কিছু রেন্টে কার সার্ভিস আছে। যা দিয়ে দেশী-বিদেশী ট্যুরিস্টদের যাতায়াত সুবিধা দিচ্ছি। ৪টি বড় কোচ ও ৪টি মাইক্রোবাস রয়েছে।

এদিকে, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন বিষয়ক মন্ত্রী ফারুক খান বলেছেন, ফারুক খান বলেন, বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের অবদান প্রায় ৪ শতাংশ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রায় ১.৭৮ শতাংশ। এ হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বময় করোনাভাইরাস সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পর্যটন খাত। করোনা অতিমারি সময়কালীন সময়েও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি ও আনুতোষিক পরিশোধ করেছে। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন বর্তমানেও তার লাভের ধারা অব্যাহত রেখেছে। সংস্থাটি নিজস্ব আয়ে পরিচালিত সরকারের একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান।