০২:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সোনারগাঁয়ে সুলতান গিয়াস-উদ্দিন আজম শাহ

  • সবুজ বাংলা
  • আপডেট সময় : ০৫:০১:৩৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩
  • 114

হারুন-অর-রশিদ, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ 

পাঠ্য পুস্তকের ইতিহাসের সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ এর নাম পাওয়া যায়। পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিনি ১৩৮৯ সালে সিংহাসন দখল করেছিলেন। গিয়াস-উদ্দিন আজম শাহ (শাসনকাল ১৩৮৯-১৪১০) ছিলেন ইলিয়াস শাহী রাজবংশের তৃতীয় সুলতান। তিনি তৎকালীন বাংলার সুপরিচিত সুলতানদের অন্যতম ছিলেন। তার প্রকৃত নাম আজম শাহ, সিংহাসন আরোহণের পর তিনি গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ নাম ধারণ করেন। এরপর বাইশ বছরের রাজত্ব শেষে গোপন ঘাতক তাঁর প্রাণ কেড়ে নেয়। রাজত্বকালে তিনি ছিলেন খ্যাতির শীর্ষে। তাঁর রাজত্বকালে শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য, চারু ও কারুকলার প্রভূত উন্নতি হয়। তিনি চরিত্রবান, ন্যায় বিচারক ও বিচক্ষণ শাসক ছিলেন। গিয়াস-উদ্দিন আজম শাহ পÐিত ও কবিদের সমাদর করতেন। পারস্যের কবি হাফিজের সাথে তার পত্র বিনিময় হত। বাঙালি মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগীর তার বিখ্যাত রচনা ইউসুফ জুলেখা এ সময়ে সম্পন্ন করেন। এসময় কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করা হয়। আজম শাহের রাজত্বকালেই বিখ্যাত সূফী সাধক নূর কুতুব-উল-আলম পান্ডুয়ায় আস্তানা গাড়েন। এ স্থান হতেই তিনি বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ইসলাম ধর্মের প্রচার করে বেড়াতেন। ফলে পান্ডুয়া ইসলাম শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে ভারতবর্ষে সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। সুলতান মক্কা ও মদিনাতেও মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য অর্থ ব্যয় করতেন। বিদ্রোহ দমন, দূত বিনিময়, সামাজিক অবস্থার উন্নতি, জ্ঞান বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা; সব কিছুতেই ছিল সুলতানের সাফল্য এবং সুরুচির ছাপ।

তাকে নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে, তার মাঝে একটা এরকম; সুলতান একবার শিকারে বের হলেন। চলতে চলতে হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটি হরিণ, নির্ভয়ে ঘাস চিবুচ্ছে। বাতাসের বেগে তীর উড়ে গেল। হরিণের বদলে বিঁধে গেল এক বিধবা বুড়ির একমাত্র ছেলের দেহে। ভাঙা মনে সুলতান ফিরে এলেন প্রাসাদে।
পরদিন সুলতান বসেছেন দরবারে। ডাক এলো কাজীর দরবার থেকে। তিনি সুলতানকে তাঁর দরবারে ডেকে পাঠিয়েছেন। সুলতান বুঝলেন কেন তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে, তিনি মৃদু হাসলেন। নিজের দরবার ছেড়ে কাজীর দরবারে উপস্থিত হলেন, সাথে নিলেন নিজের তরবারি।
বিচার হল সুলতানের বিপক্ষে। বিধবা বুড়ির ভরণ পোষণ এর দায়িত্ব পড়ল সুলতানের উপর। ক্ষমা প্রার্থনা করতে হল সুলতানকে।

সুলতান খালি তরবারি বের করে কাজীকে দেখিয়ে বললেন ‘বেঁচে গেলেন কাজী, বিচার ভুল হলে আমি ক্ষমা করতাম না আপনাকে।’
এমন অনেক গল্প ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। এমনই সেই সুলতান। সুলতান গিয়াস-উদ্দিন আজম শাহ।

কবর: সাচিলপুরের সেই কবর কালো পাথরে তৈরি। এটি ৩মিঃ লম্বা, ১.৫০ মি. চওড়া এবং ৯০ সে.মি. উঁচু। এর তিনটি ধাপ। নিচের ধাপটি সাদামাটা পাথুরে পাটাতন। মাঝের অংশের আকার বাক্সের মতো। আর উপরের অংশটি যেন একটি নৌকার ছৈ। কেবল মাঝের অংশে চমৎকার কারুকাজ করা আছে। কারুকাজগুলো এক সারি খোপে আবদ্ধ। প্রতিটি খোপে রয়েছে একটি করে ভাঁজওয়ালা খিলান। সেই খিলানের মাথা থেকে ঝুলে পড়া শিকলের মাথায় শোভা পাচ্ছে পদ্ম-দোলক। ঐতিহাসিক জেমস ওয়াইজের মতে, এক সময় এখানে বিশালাকৃতির এক সৌধ ছিল, তার তেমন কিছুই বাকি নেই এখন। তবে যা আছে প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তরের সহায়তায় সমাধিটি সংস্কার করা হয়। মূল সমাধিটির কার্নিশে রয়েছে সূ² কারুকাজ খচিত অলঙ্করণ। দু’পাশে রয়েছে তিনটি করে তিন খাঁজবিশিষ্ট খিলান। খাঁজের মধ্যে রয়েছে প্রলম্বিত শিকল ও ঝুলন্ত ঘণ্টার নকশা, যা পাÐুয়ায় অবস্থিত সিকান্দার শাহের মাজারেও লক্ষ্য করা যায়। পাথরের গায়ে এমন কারুকাজ আমাদের দেশের আর কোন কবরে নাকি দেখা যায় না।
১৪১০ খ্রিষ্টাব্দে আজম শাহের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে ইলিয়াস শাহী বংশের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।

জনপ্রিয় সংবাদ

স্মৃতিসৌধে তারেক রহমান

সোনারগাঁয়ে সুলতান গিয়াস-উদ্দিন আজম শাহ

আপডেট সময় : ০৫:০১:৩৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩

হারুন-অর-রশিদ, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ 

পাঠ্য পুস্তকের ইতিহাসের সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ এর নাম পাওয়া যায়। পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিনি ১৩৮৯ সালে সিংহাসন দখল করেছিলেন। গিয়াস-উদ্দিন আজম শাহ (শাসনকাল ১৩৮৯-১৪১০) ছিলেন ইলিয়াস শাহী রাজবংশের তৃতীয় সুলতান। তিনি তৎকালীন বাংলার সুপরিচিত সুলতানদের অন্যতম ছিলেন। তার প্রকৃত নাম আজম শাহ, সিংহাসন আরোহণের পর তিনি গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ নাম ধারণ করেন। এরপর বাইশ বছরের রাজত্ব শেষে গোপন ঘাতক তাঁর প্রাণ কেড়ে নেয়। রাজত্বকালে তিনি ছিলেন খ্যাতির শীর্ষে। তাঁর রাজত্বকালে শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য, চারু ও কারুকলার প্রভূত উন্নতি হয়। তিনি চরিত্রবান, ন্যায় বিচারক ও বিচক্ষণ শাসক ছিলেন। গিয়াস-উদ্দিন আজম শাহ পÐিত ও কবিদের সমাদর করতেন। পারস্যের কবি হাফিজের সাথে তার পত্র বিনিময় হত। বাঙালি মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগীর তার বিখ্যাত রচনা ইউসুফ জুলেখা এ সময়ে সম্পন্ন করেন। এসময় কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করা হয়। আজম শাহের রাজত্বকালেই বিখ্যাত সূফী সাধক নূর কুতুব-উল-আলম পান্ডুয়ায় আস্তানা গাড়েন। এ স্থান হতেই তিনি বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ইসলাম ধর্মের প্রচার করে বেড়াতেন। ফলে পান্ডুয়া ইসলাম শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে ভারতবর্ষে সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। সুলতান মক্কা ও মদিনাতেও মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য অর্থ ব্যয় করতেন। বিদ্রোহ দমন, দূত বিনিময়, সামাজিক অবস্থার উন্নতি, জ্ঞান বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা; সব কিছুতেই ছিল সুলতানের সাফল্য এবং সুরুচির ছাপ।

তাকে নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে, তার মাঝে একটা এরকম; সুলতান একবার শিকারে বের হলেন। চলতে চলতে হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটি হরিণ, নির্ভয়ে ঘাস চিবুচ্ছে। বাতাসের বেগে তীর উড়ে গেল। হরিণের বদলে বিঁধে গেল এক বিধবা বুড়ির একমাত্র ছেলের দেহে। ভাঙা মনে সুলতান ফিরে এলেন প্রাসাদে।
পরদিন সুলতান বসেছেন দরবারে। ডাক এলো কাজীর দরবার থেকে। তিনি সুলতানকে তাঁর দরবারে ডেকে পাঠিয়েছেন। সুলতান বুঝলেন কেন তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে, তিনি মৃদু হাসলেন। নিজের দরবার ছেড়ে কাজীর দরবারে উপস্থিত হলেন, সাথে নিলেন নিজের তরবারি।
বিচার হল সুলতানের বিপক্ষে। বিধবা বুড়ির ভরণ পোষণ এর দায়িত্ব পড়ল সুলতানের উপর। ক্ষমা প্রার্থনা করতে হল সুলতানকে।

সুলতান খালি তরবারি বের করে কাজীকে দেখিয়ে বললেন ‘বেঁচে গেলেন কাজী, বিচার ভুল হলে আমি ক্ষমা করতাম না আপনাকে।’
এমন অনেক গল্প ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। এমনই সেই সুলতান। সুলতান গিয়াস-উদ্দিন আজম শাহ।

কবর: সাচিলপুরের সেই কবর কালো পাথরে তৈরি। এটি ৩মিঃ লম্বা, ১.৫০ মি. চওড়া এবং ৯০ সে.মি. উঁচু। এর তিনটি ধাপ। নিচের ধাপটি সাদামাটা পাথুরে পাটাতন। মাঝের অংশের আকার বাক্সের মতো। আর উপরের অংশটি যেন একটি নৌকার ছৈ। কেবল মাঝের অংশে চমৎকার কারুকাজ করা আছে। কারুকাজগুলো এক সারি খোপে আবদ্ধ। প্রতিটি খোপে রয়েছে একটি করে ভাঁজওয়ালা খিলান। সেই খিলানের মাথা থেকে ঝুলে পড়া শিকলের মাথায় শোভা পাচ্ছে পদ্ম-দোলক। ঐতিহাসিক জেমস ওয়াইজের মতে, এক সময় এখানে বিশালাকৃতির এক সৌধ ছিল, তার তেমন কিছুই বাকি নেই এখন। তবে যা আছে প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তরের সহায়তায় সমাধিটি সংস্কার করা হয়। মূল সমাধিটির কার্নিশে রয়েছে সূ² কারুকাজ খচিত অলঙ্করণ। দু’পাশে রয়েছে তিনটি করে তিন খাঁজবিশিষ্ট খিলান। খাঁজের মধ্যে রয়েছে প্রলম্বিত শিকল ও ঝুলন্ত ঘণ্টার নকশা, যা পাÐুয়ায় অবস্থিত সিকান্দার শাহের মাজারেও লক্ষ্য করা যায়। পাথরের গায়ে এমন কারুকাজ আমাদের দেশের আর কোন কবরে নাকি দেখা যায় না।
১৪১০ খ্রিষ্টাব্দে আজম শাহের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে ইলিয়াস শাহী বংশের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।