০৯:৫৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দালাল-সিন্ডিকেটে মিরপুর বিআরটিএ

► টাকা ছাড়া মেলে না রেজিস্ট্রেশন, লাইসেন্স, ফিটনেস সনদ
► স্মার্টকার্ড তুলতেও গুনতে হয় টাকা
► দুর্ভোগে সেবাগ্রহীতারা

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) মিরপুর কার্যালয়টি এখন ঘুষবাণিজ্য ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে। টাকা ছাড়া মেলে না নতুন বা পুরাতন গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, রুট পারমিট, মালিকানা বদল, নাম-ঠিকানা পরিবর্তন এমনকি ফিটনেস সনদ। মূলত দালাল-সিন্ডিকেটের কব্জায় ঘিরে রয়েছে বিআরটিএ’র মিরপুর কার্যালয়। অভিযোগ রয়েছে, দালাল ছাড়া সেবা পেতে হলে ঘুরতে হয় বছরের পর বছর। অফিসের কর্তাবাবুরা নিজেদের ভেজালমুক্ত রাখতে কাজ করেন দালাল-সিন্ডিকেটের ইশারায়। এভাবেই প্রতিদিন গ্রাহক সেবার নামে অবৈধ উপায়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বিআরটিএ’র মিরপুর কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা। ইতোমধ্যেই কয়েকজন কর্মকর্তার নামে দুদকে অভিযোগও দিয়েছেন। গ্রাহকসেবা নিশ্চিতে মাঝেমধ্যেই সাঁড়াশি অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা। এরপরও প্রতিনিয়ত চরম দুর্ভোগে পড়ছেন সেবাগ্রহীতারা। তবে বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, এখন সবকিছুই অনলাইনে সেবা দেয়া হয়। সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে বাড়তি টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। এমন অভিযোগ পেলে অবশ্যই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গতকাল বুধবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর মিরপুর-১৩ নম্বর সেকশনে অবস্থিত বাংলাদেশ সড়ক পবিরবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) গেট দিয়ে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়ে ‘দালাল, টাউট ও প্রতারক হতে সাবধান’। এমন সতর্কবার্তা সংবলিত সাইনবোর্ড শুধু প্রবেশ ফটকেই নয়, এ ধরনের আরও অনেকগুলো সাইনবোর্ড সাঁটানো আছে মিরপুর বিআরটিএ’র বিভিন্ন ভবনের দেয়ালে দেয়ালে। কিন্তু এই সতর্ক বার্তাকে ছাপিয়ে বলা যায়, বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দালালদের দৌরাত্ম্যই পুরো বিআরটিএ ঘিরে। রয়েছে দালাল-সিন্ডিকেটের রামরাজত্ব। প্রবেশের মুহূর্তেই সাদা পোশাকের একাধিক ব্যক্তি সামনে এসে ঘিরে ধরলেন। জানতে চাইলেন ‘কী কাজ ভাই। কেন এসেছেন। কী করতে হবে। এরপর কাজের কথা বললেই অনেকটা প্রকাশ্যেই শুরু হয় দরকষাকষি। মোটরসাইকেলসহ যে কোনো গাড়ির লাইসেন্স, মালিকানা বদলি কিংবা ফিটনেস সার্টিফিকেট কি চান। সব করে দিতে রাজি এসব দালাল চক্রের সদস্যরা। দালাল-আনসার আর কিছু কর্মকর্তা মিলে গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। যা থেকে তাদের প্রতি মাসে বাড়তি আয় কোটি কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, আনসার সদস্য নাজমুল চাকরি ছেড়ে মালিকানা শাখার দালালি করেন। সহকারী পরিচালক আব্দুল করিমের ব্যক্তিগত লোক বলে পরিচয় দিয়ে নাজমুল প্রতিটি ফাইল থেকে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। পরিচয় গোপন রেখে জানতে চাইলে এই প্রতিবেদককে নাজমুল বলেন, জীবিকার তাগিদে আনসার সদস্যের চাকরি ছেড়ে যাওয়ার পরও প্রায় ১৫-২০ জন আনসার সদস্য এই অফিসে দালালির কাজ করেন। সাবেক আনসার সদস্য মহাসিন নিজেকে বিআরটিএ’র কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে দালাল হিসেবে উপ-পরিচালকের রুমে কাজ করেন। মালিকানা শাখায় দালাল হিসেবে রয়েছেন নয়ন-১, নয়ন-২, খোরশেদ, খলিলসহ একডজন সাবেক আনসার সদস্য। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরা টাকার বিনিময় দালালদের সহযোগিতা করে আসছেন এর বিনিময় দালালদের কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে ৫০০-৫০০০ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। দালালদের কাছ থেকে সপ্তাহে ২-৩ লাখ টাকা নিয়ে থাকেন আনসার কমান্ডার পিসি কাঞ্চন ও এপিসি মিলন। মিরপুর বিআরটিএ ঘিরে বিভিন্ন শাখায় মনিরসহ প্রায় ১০০ জন দালাল রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন দালাল বলেন, আমরা লেখাপড়া জানি না, তাই একমাত্র অবলম্বন দালালি। এখানে কাজ করতে হলে, আনসার কমান্ডারকে টাকা দিয়েই কাজ করতে হয়। টাকা দিলে আমাদের অফিসের ভেতরে ঢুকতে এবং কাজ করতে দেয়া হয়। টাকা না দিলে হয়রানি ও ম্যাজিস্ট্রেটের ভয় দেখায়। আনসার কমান্ডারকে টাকা না দিয়ে এখানে কাজ করা অসম্ভব। আমাদের কাজের পাশাপাশি আনসার সদস্যরাও দালালের কাজে জড়িত। বিআরটিএ নিরাপত্তার দায়িত্বে প্রায় ৩০ জন আনসার সদস্য রয়েছে। এদের মধ্যে প্রতিদিন কাজ করেন অন্তর, জাকিরুল, মো. আনিছ, শাহিন, আরিফ, শহিদুল, মো. রাজ্জাক, রবিউল ইসলাম, পবন, ইসমাইলসহ অনেকের বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। তবে এদের জন্য আমরা বেশি একটা কাজ করতে পারি না। সেবাগ্রহীতারা সেবা পেতে হলে দালাল বা আনসারদের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। নতুবা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। মোটরসাইকেল মালিকানা ও মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন শাখায় সহকারী পরিচালক হিসেবে কিছুদিন আগে যোগদান করেছে শামসুল কবির। এর আগেও সে মিরপুর বিআরটিএ রেজিস্ট্রেশন শাখায় কর্মরত ছিলেন। এবং পর্যায়ক্রমে ইকুরিয়া-নারায়ণগঞ্জসহ বিআরটিএ’র অন্যান্য শাখায় কর্মরত ছিলেন। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আবারো মিরপুর বিআরটিএ যোগদান করেন সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) শামসুল কবির। তিনি মিরপুরে থাকাকালীন বিভিন্ন রকম সিএনজি অবৈধভাবে মালিকানা ও রেজিস্ট্রেশন করে দেন। যা বর্তমানে দুদকের তদন্ত চলমান রয়েছে। শামসুল কবিরের মোটরযান পরিদর্শক মোট দুইজন, মোটরসাইকেল মালিকানায় মো. তাজুল। যিনি শামসুল কবিরের ভাগিনা, যার মাধ্যমে তিনি আবারো দুর্নীতির পাখা মেলে ধরছেন। মোটরযান পরিদর্শক তাজুলের অফিস সহকারি মনির, নিগার সুলতানা, জিয়া এদের প্রত্যেকের রুমে রয়েছে এক ডজন করে পালিত দালাল। যাদের মাধ্যমে দিনের পর দিন গ্রাহকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন করে এই অসাধু কর্মকর্তারা। অফিস সহকারী মনির রুম নাম্বার ১১৮ তার প্রধান সহযোগী দালাল জিকু, গ্রাহকদের বলে সরকারি কর্মচারী বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, এই জিকু সরকারি নিয়ম তোয়াক্কা না করেই মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে গাড়ির মালিকানা করে দেন। এ চক্রে আরো রয়েছে সজীব, হালিমসহ আরো অনেকে। গ্রাহকরা মালিকানা সিøপের জন্য গেলে শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন রকম টালবাহানা, টাকা না দিলে কোনো সিøপ তাদের কম্পিউটারে নড়ে না, প্রতিটি মালিকানায় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে এই অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অফিস সহকারী নিগার সুলতানা তার রুম ৩১২, একই অভিযোগে টাকা না দিলে ধরে না কোনো ফাইল। নিগার সুলতানার প্রধান সহযোগী সোলায়মান যিনি কম্পিউটার অপারেটর তার মাধ্যমে সে দিনের পর দিন অসৎভাবে সরকারি টেবিল চেয়ার ব্যবহার করে জনগণের সেবার নামে করছে কারচুপি। অভিনব প্রতিটা মালিকানা সিøপে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। রুম নাম্বার ৩১৪ অফিস সহকারী জিয়া। তিনিও অভিনব কায়দায় করছেন কারচুপি। এ রুমেও ডজন খানেক দালাল রয়েছেন। এরা হলেনÑ আজাদ, রাসেল, আরিফ, অপিসহ আরো অনেকে। একই রকম নাম্বার অনুযায়ী বিভক্ত হচ্ছে রুম, গ্রাহকরা ফাইল নিয়ে গেলে হয়রানি হতে হয় পদে পদে, সরকারি ফির বাইরে টাকা দিলে এদের কাছে সবই সম্ভব। সরকারি অফিসে যেন ঘুষের নৈরাজ্য। সহকারী পরিচালক শামসুল কবিরের মোটরযান পরিদর্শক রেজিস্ট্রেশন শাখায় রয়েছে কর্মরত ফয়েজ। যার মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা নিচ্ছে বিআরটিএ’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। মোটরযান পরিদর্শক ফয়েজের একাধিক সম্পর্ক বিভিন্ন মোটরসাইকেলের শোরুমগুলোতে যার মাধ্যমে দিনের পর দিন দুর্নীতি করে আসছে এই মোটরযান পরিদর্শক ফয়েজ। ইয়ামাহা, র‌্যাংস, হুন্ডা, সুজুকিসহ সব শোরুমের লোক আছে ফয়েজের রুমে। রায়হান, নাঈম, সুমন ও সজীবসহ আরো অনেকে প্রতিনিয়ত ১৫ থেকে ২০টা গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের ফাইল নিয়ে আসে। এই সব গাড়ি সীন করা ছাড়াই হয়ে যায় রেজিস্ট্রেশন শুধু টাকার বিনিময়ে। এই ঘুষ দুর্নীতির সঙ্গে সহকারী পরিচালক শামসুল কবির বহু আগে থেকেই পরিচিত। তাই সে এখানে আসার পরে তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তোয়াক্কা করে না কাউকে। মিরপুর বিআরটিএ’র প্রতিটি শাখায় যে কোনো গ্রাহকের প্রতিটি ফাইল দ্রুত পাস করাতে হলে শ্রেণিভেদে ন্যূনতম ১ হাজার থেকে গুনতে হয় লক্ষাধিক টাকা পর্যন্ত। আর এভাবে সেবাগ্রহীতারা দিনের পর দিন সেব পেতে গিয়ে দুর্ভোগে পড়ছেন।

এদিকে র‌্যাব জানায়, সম্প্রতি অনিয়ম রোধে দালাল নির্মূলে র‌্যাব-৪ এর একটি দল মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে চক্রের মূলহোতা মো. অন্তর খানসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে থানায় সোপর্দ করা হয়। অপর সদস্যরা হলেনÑ মো. সাজ্জাতুল ইসলাম তুষার, মো. রিয়াদ খান, মো. পিন্টু ব্যাপারী, মো. দুলু মিয়া, মো. জহির মোল্লা ও মো. রফিকুল ইসলাম ওরফে রুবেল। তারা দীর্ঘদিন ধরে পরস্পর যোগসাজশে বিআরটিএ এলাকায় চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলা থেকে আগত লোকজনের কাছ থেকে গাড়ির মালিকানা পরিবর্তন, ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ফি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ফি’র কথা বলে বিভিন্ন কৌশলে প্রতারণার মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে আসছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিরপুর শাখার পরিচালক মো. শহীদুল্লাহকে তার কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি। তবে উপ-পরিচালক মো. মাসুদ আলমসহ অন্যান্য শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে সবকিছুই অনলাইনে সেবা দেয়া হয়। সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে বাড়তি টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। এমন অভিযোগ পেলে অবশ্যই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

সোনারগাঁয়ে অবৈধ গ্যাস ব্যবহার করায় গুড়িয়ে দেয়া হয় দু’টি প্রতিষ্ঠান, একটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা

দালাল-সিন্ডিকেটে মিরপুর বিআরটিএ

আপডেট সময় : ০৬:৩৩:৩৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই ২০২৪

► টাকা ছাড়া মেলে না রেজিস্ট্রেশন, লাইসেন্স, ফিটনেস সনদ
► স্মার্টকার্ড তুলতেও গুনতে হয় টাকা
► দুর্ভোগে সেবাগ্রহীতারা

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) মিরপুর কার্যালয়টি এখন ঘুষবাণিজ্য ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে। টাকা ছাড়া মেলে না নতুন বা পুরাতন গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, রুট পারমিট, মালিকানা বদল, নাম-ঠিকানা পরিবর্তন এমনকি ফিটনেস সনদ। মূলত দালাল-সিন্ডিকেটের কব্জায় ঘিরে রয়েছে বিআরটিএ’র মিরপুর কার্যালয়। অভিযোগ রয়েছে, দালাল ছাড়া সেবা পেতে হলে ঘুরতে হয় বছরের পর বছর। অফিসের কর্তাবাবুরা নিজেদের ভেজালমুক্ত রাখতে কাজ করেন দালাল-সিন্ডিকেটের ইশারায়। এভাবেই প্রতিদিন গ্রাহক সেবার নামে অবৈধ উপায়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বিআরটিএ’র মিরপুর কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা। ইতোমধ্যেই কয়েকজন কর্মকর্তার নামে দুদকে অভিযোগও দিয়েছেন। গ্রাহকসেবা নিশ্চিতে মাঝেমধ্যেই সাঁড়াশি অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা। এরপরও প্রতিনিয়ত চরম দুর্ভোগে পড়ছেন সেবাগ্রহীতারা। তবে বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, এখন সবকিছুই অনলাইনে সেবা দেয়া হয়। সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে বাড়তি টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। এমন অভিযোগ পেলে অবশ্যই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গতকাল বুধবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর মিরপুর-১৩ নম্বর সেকশনে অবস্থিত বাংলাদেশ সড়ক পবিরবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) গেট দিয়ে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়ে ‘দালাল, টাউট ও প্রতারক হতে সাবধান’। এমন সতর্কবার্তা সংবলিত সাইনবোর্ড শুধু প্রবেশ ফটকেই নয়, এ ধরনের আরও অনেকগুলো সাইনবোর্ড সাঁটানো আছে মিরপুর বিআরটিএ’র বিভিন্ন ভবনের দেয়ালে দেয়ালে। কিন্তু এই সতর্ক বার্তাকে ছাপিয়ে বলা যায়, বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দালালদের দৌরাত্ম্যই পুরো বিআরটিএ ঘিরে। রয়েছে দালাল-সিন্ডিকেটের রামরাজত্ব। প্রবেশের মুহূর্তেই সাদা পোশাকের একাধিক ব্যক্তি সামনে এসে ঘিরে ধরলেন। জানতে চাইলেন ‘কী কাজ ভাই। কেন এসেছেন। কী করতে হবে। এরপর কাজের কথা বললেই অনেকটা প্রকাশ্যেই শুরু হয় দরকষাকষি। মোটরসাইকেলসহ যে কোনো গাড়ির লাইসেন্স, মালিকানা বদলি কিংবা ফিটনেস সার্টিফিকেট কি চান। সব করে দিতে রাজি এসব দালাল চক্রের সদস্যরা। দালাল-আনসার আর কিছু কর্মকর্তা মিলে গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। যা থেকে তাদের প্রতি মাসে বাড়তি আয় কোটি কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, আনসার সদস্য নাজমুল চাকরি ছেড়ে মালিকানা শাখার দালালি করেন। সহকারী পরিচালক আব্দুল করিমের ব্যক্তিগত লোক বলে পরিচয় দিয়ে নাজমুল প্রতিটি ফাইল থেকে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। পরিচয় গোপন রেখে জানতে চাইলে এই প্রতিবেদককে নাজমুল বলেন, জীবিকার তাগিদে আনসার সদস্যের চাকরি ছেড়ে যাওয়ার পরও প্রায় ১৫-২০ জন আনসার সদস্য এই অফিসে দালালির কাজ করেন। সাবেক আনসার সদস্য মহাসিন নিজেকে বিআরটিএ’র কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে দালাল হিসেবে উপ-পরিচালকের রুমে কাজ করেন। মালিকানা শাখায় দালাল হিসেবে রয়েছেন নয়ন-১, নয়ন-২, খোরশেদ, খলিলসহ একডজন সাবেক আনসার সদস্য। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরা টাকার বিনিময় দালালদের সহযোগিতা করে আসছেন এর বিনিময় দালালদের কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে ৫০০-৫০০০ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। দালালদের কাছ থেকে সপ্তাহে ২-৩ লাখ টাকা নিয়ে থাকেন আনসার কমান্ডার পিসি কাঞ্চন ও এপিসি মিলন। মিরপুর বিআরটিএ ঘিরে বিভিন্ন শাখায় মনিরসহ প্রায় ১০০ জন দালাল রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন দালাল বলেন, আমরা লেখাপড়া জানি না, তাই একমাত্র অবলম্বন দালালি। এখানে কাজ করতে হলে, আনসার কমান্ডারকে টাকা দিয়েই কাজ করতে হয়। টাকা দিলে আমাদের অফিসের ভেতরে ঢুকতে এবং কাজ করতে দেয়া হয়। টাকা না দিলে হয়রানি ও ম্যাজিস্ট্রেটের ভয় দেখায়। আনসার কমান্ডারকে টাকা না দিয়ে এখানে কাজ করা অসম্ভব। আমাদের কাজের পাশাপাশি আনসার সদস্যরাও দালালের কাজে জড়িত। বিআরটিএ নিরাপত্তার দায়িত্বে প্রায় ৩০ জন আনসার সদস্য রয়েছে। এদের মধ্যে প্রতিদিন কাজ করেন অন্তর, জাকিরুল, মো. আনিছ, শাহিন, আরিফ, শহিদুল, মো. রাজ্জাক, রবিউল ইসলাম, পবন, ইসমাইলসহ অনেকের বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। তবে এদের জন্য আমরা বেশি একটা কাজ করতে পারি না। সেবাগ্রহীতারা সেবা পেতে হলে দালাল বা আনসারদের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। নতুবা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। মোটরসাইকেল মালিকানা ও মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন শাখায় সহকারী পরিচালক হিসেবে কিছুদিন আগে যোগদান করেছে শামসুল কবির। এর আগেও সে মিরপুর বিআরটিএ রেজিস্ট্রেশন শাখায় কর্মরত ছিলেন। এবং পর্যায়ক্রমে ইকুরিয়া-নারায়ণগঞ্জসহ বিআরটিএ’র অন্যান্য শাখায় কর্মরত ছিলেন। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আবারো মিরপুর বিআরটিএ যোগদান করেন সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) শামসুল কবির। তিনি মিরপুরে থাকাকালীন বিভিন্ন রকম সিএনজি অবৈধভাবে মালিকানা ও রেজিস্ট্রেশন করে দেন। যা বর্তমানে দুদকের তদন্ত চলমান রয়েছে। শামসুল কবিরের মোটরযান পরিদর্শক মোট দুইজন, মোটরসাইকেল মালিকানায় মো. তাজুল। যিনি শামসুল কবিরের ভাগিনা, যার মাধ্যমে তিনি আবারো দুর্নীতির পাখা মেলে ধরছেন। মোটরযান পরিদর্শক তাজুলের অফিস সহকারি মনির, নিগার সুলতানা, জিয়া এদের প্রত্যেকের রুমে রয়েছে এক ডজন করে পালিত দালাল। যাদের মাধ্যমে দিনের পর দিন গ্রাহকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন করে এই অসাধু কর্মকর্তারা। অফিস সহকারী মনির রুম নাম্বার ১১৮ তার প্রধান সহযোগী দালাল জিকু, গ্রাহকদের বলে সরকারি কর্মচারী বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, এই জিকু সরকারি নিয়ম তোয়াক্কা না করেই মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে গাড়ির মালিকানা করে দেন। এ চক্রে আরো রয়েছে সজীব, হালিমসহ আরো অনেকে। গ্রাহকরা মালিকানা সিøপের জন্য গেলে শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন রকম টালবাহানা, টাকা না দিলে কোনো সিøপ তাদের কম্পিউটারে নড়ে না, প্রতিটি মালিকানায় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে এই অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অফিস সহকারী নিগার সুলতানা তার রুম ৩১২, একই অভিযোগে টাকা না দিলে ধরে না কোনো ফাইল। নিগার সুলতানার প্রধান সহযোগী সোলায়মান যিনি কম্পিউটার অপারেটর তার মাধ্যমে সে দিনের পর দিন অসৎভাবে সরকারি টেবিল চেয়ার ব্যবহার করে জনগণের সেবার নামে করছে কারচুপি। অভিনব প্রতিটা মালিকানা সিøপে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। রুম নাম্বার ৩১৪ অফিস সহকারী জিয়া। তিনিও অভিনব কায়দায় করছেন কারচুপি। এ রুমেও ডজন খানেক দালাল রয়েছেন। এরা হলেনÑ আজাদ, রাসেল, আরিফ, অপিসহ আরো অনেকে। একই রকম নাম্বার অনুযায়ী বিভক্ত হচ্ছে রুম, গ্রাহকরা ফাইল নিয়ে গেলে হয়রানি হতে হয় পদে পদে, সরকারি ফির বাইরে টাকা দিলে এদের কাছে সবই সম্ভব। সরকারি অফিসে যেন ঘুষের নৈরাজ্য। সহকারী পরিচালক শামসুল কবিরের মোটরযান পরিদর্শক রেজিস্ট্রেশন শাখায় রয়েছে কর্মরত ফয়েজ। যার মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা নিচ্ছে বিআরটিএ’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। মোটরযান পরিদর্শক ফয়েজের একাধিক সম্পর্ক বিভিন্ন মোটরসাইকেলের শোরুমগুলোতে যার মাধ্যমে দিনের পর দিন দুর্নীতি করে আসছে এই মোটরযান পরিদর্শক ফয়েজ। ইয়ামাহা, র‌্যাংস, হুন্ডা, সুজুকিসহ সব শোরুমের লোক আছে ফয়েজের রুমে। রায়হান, নাঈম, সুমন ও সজীবসহ আরো অনেকে প্রতিনিয়ত ১৫ থেকে ২০টা গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের ফাইল নিয়ে আসে। এই সব গাড়ি সীন করা ছাড়াই হয়ে যায় রেজিস্ট্রেশন শুধু টাকার বিনিময়ে। এই ঘুষ দুর্নীতির সঙ্গে সহকারী পরিচালক শামসুল কবির বহু আগে থেকেই পরিচিত। তাই সে এখানে আসার পরে তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তোয়াক্কা করে না কাউকে। মিরপুর বিআরটিএ’র প্রতিটি শাখায় যে কোনো গ্রাহকের প্রতিটি ফাইল দ্রুত পাস করাতে হলে শ্রেণিভেদে ন্যূনতম ১ হাজার থেকে গুনতে হয় লক্ষাধিক টাকা পর্যন্ত। আর এভাবে সেবাগ্রহীতারা দিনের পর দিন সেব পেতে গিয়ে দুর্ভোগে পড়ছেন।

এদিকে র‌্যাব জানায়, সম্প্রতি অনিয়ম রোধে দালাল নির্মূলে র‌্যাব-৪ এর একটি দল মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে চক্রের মূলহোতা মো. অন্তর খানসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে থানায় সোপর্দ করা হয়। অপর সদস্যরা হলেনÑ মো. সাজ্জাতুল ইসলাম তুষার, মো. রিয়াদ খান, মো. পিন্টু ব্যাপারী, মো. দুলু মিয়া, মো. জহির মোল্লা ও মো. রফিকুল ইসলাম ওরফে রুবেল। তারা দীর্ঘদিন ধরে পরস্পর যোগসাজশে বিআরটিএ এলাকায় চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলা থেকে আগত লোকজনের কাছ থেকে গাড়ির মালিকানা পরিবর্তন, ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ফি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ফি’র কথা বলে বিভিন্ন কৌশলে প্রতারণার মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে আসছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিরপুর শাখার পরিচালক মো. শহীদুল্লাহকে তার কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি। তবে উপ-পরিচালক মো. মাসুদ আলমসহ অন্যান্য শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে সবকিছুই অনলাইনে সেবা দেয়া হয়। সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে বাড়তি টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। এমন অভিযোগ পেলে অবশ্যই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।