➤ টাকা ছাড়া টেবিলে ঘোরে না ফাইলপত্র
➤ সক্রিয় স্থানীয় দালালচক্র
➤ পিছিয়ে নেই নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যরা
➤ ফেলের গ্যাঁড়াকলে কোটি টাকার মচ্ছব
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ঢাকা জেলা ও ঢাকা মেট্রো-২ কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া বিআরটিএ যেন স্বঘোষিত অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়া। বিস্তির্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা এ অফিসের প্রবেশপথ থেকে শুরু করে প্রতিটি স্থানে সারিবদ্ধ সিসি ক্যামেরা বসানো হলেও অফিস কক্ষের ভেতর অন্ধরমহলে প্রতি দিনই চলছে কোটি টাকার ঘুষ-বাণিজ্য। অভিযোগ রয়েছে, টাকা ছাড়া টেবিলে টেবিলে ঘোরে না ড্রাইভিং লাইসেন্স, নতুন-পুরাতন গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, রুট পারমিট, নবায়ন ও মালিকানা বদলসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ ফাইলপত্র। এসব কাজ বাগিয়ে আনতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে স্থানীয় সংঘবদ্ধ দালালচক্র। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিআরটিএ’র বিভিন্ন শাখায় কর্তব্যরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে অবৈধ অর্থ আদায়ে পিছিয়ে নেই নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যরাও। মূলত ড্রাইভিং লাইসেন্সপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাকে ফেলের গ্যাঁড়াকলে রেখে প্রতিদিন কোটি টাকার মচ্ছব চলছে। মাঝেমধ্যে র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য সংস্থা অভিযান চালিয়ে দালালচক্র ধরলেও থামছে না অনিয়ম-দুর্নীতি। এরই মধ্যে দুদকের অনুসন্ধানেও সংস্থাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসে। এরপরও সতর্ক হয়নি কেউই। গতকাল বৃহস্পতিবার ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া বিআরটিএ অফিসের প্রবেশ গেটসহ ভবনের চারপাশে সিসি ক্যামেরায় সার্বিক বিয়ষ মনিটরিং করছেন দপ্তরের প্রধান কর্মকর্তা। কিন্তু প্রতিটি শাখার মূলকক্ষের অন্ধরমহলে চলছে রমরমা ঘুষবাণিজ্য। প্রতিষ্ঠানটির বাইরে ছোট ছোট চায়ের স্টলে বসে থাকেন স্থানীয় দালালচক্র। তাদের হাত ধরেই চলে ঘুষ-বাণিজ্যের মচ্ছব। আর এ টাকার ভাগ পৌঁছে যাচ্ছে উপরমহলের বড় কর্তার টেবিলে। ভুক্তভোগীরা জানান, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তিতে চলছে প্রহসনমূলক পরীক্ষার বোর্ডের নেপথ্যে ঘুষ-বাণিজ্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংস্থাটির কয়েকজন কর্মচারী জানান, পরীক্ষার বোর্ড থেকে প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকা ঘুষ আদায় করা হচ্ছে। এর নেপথ্যের কারিগর মোটরযান পরিদর্শক জমির হোসেনের নিযুক্ত বহিরাগত মনির ও তার ভাগিনা কম্পিউটার অপারেটর (স্টাফ) মাসুদ। সংস্থাটির উপ-পরিচালক (ডিডি), সহকারী পরিচালক (এডি) রক্ষাকবজের ভূমিকায় থেকে বসান রাজভাগ। প্রতি মাসে ও বিভিন্ন খচরবাবদ মোট টাকার অংশ বিশেষভাবে পৌঁছে সদরের সহকারী পরিচালকের (প্রশাসন) কাছে। ঘটনা ফাঁস হলেই দেখা দেয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া, চলে সেবাগ্রহীতার আবেদন ফাইলপত্র থমকে দেয়ার নানান কৌশলী টালবাহানাসহ হুমকি-ধমকি। দুর্নীতির তদন্তে তোপের মুখে থাকা প্রায় এক যুগের পুরোনো হোতা সহকারী পরিচালক প্রশাসন (এডি এডমিন) রিয়াজুর ওরফে রেজাউর রহমান শাহিন চক্রের দেখভালে গড়া ইকুরিয়ার ওই সিন্ডিকেটটি। ওই এডি এডমিন পদটিতে একজন বিসিএস ক্যাডার থাকার কথা থাকলেও অদৃশ্য ক্ষমতাবলে তা দখলে রেখে সার্কেলের হোতা গিরি করে আসছেন প্রায় এক যুগের অধিক সময় ধরে। ইকুরিয়ার অবাধ ঘুষবাজির অসংখ্য গ্যাঁড়াকলের মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্সের (নতুন-পুরনো) পরীক্ষার বোর্ডের নামে প্রহসনের যন্ত্রণা। যেখানে রয়েছে-ঢাকা জেলা ও মেট্রো-২’র মোটরযান পরিদর্শক জমির উদ্দিনকে ‘সদস্য সচিব’ করে গঠিত নিয়ম মাফিক রেগুলেশন বোর্ড সমেত নজরকাড়া নানা আয়োজন। ঘুষ ছাড়া এখানে কারোই মেলে না ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তিসহ অন্যান্য সেবা। ঘুষ না দেওয়ায় ভোগান্তিময় ফেলের গ্যাঁড়াকলে আটকে আছে অসংখ্য পরীক্ষার্থীর আবেদনকৃত ফাইলপত্র। অর্থাৎ- ঘুষের টাকা না দিলে, সেখানে পাসের কোনো সুযোগ নেই। আছে দিনের পর দিন মনির, মাসুদের পিছে ঘুরে জুতা ক্ষয়সহ ভোগান্তির সময়ক্ষেপণের সুযোগ। আর সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন চলা পরীক্ষার বোর্ডটা নিতান্তই লোক দেখানো এবং ওই সব প্রার্থীদের গ্যাঁড়াকলে আটকের কৌশল মাত্র। যা নতুনও নয়, চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে আগে টাকার পরিমাণ কম ছিল। এখন সব কিছুর সাথে ঘুষের টাকাও বেড়েছে কয়েকগুণ, পরীক্ষার্থী প্রতি পাসের ঘুষ ১৫০০ থেকে দুই হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। আর এ টাকা আদায়ের গুরুদায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে মনির হোসেন। তারই ভাগিনা কম্পিউটার অপারেটর মাসুদ (স্টাফ) ওই ঘুষের টাকার নিশ্চয়তা না পেয়ে ডাটা এন্ট্রিসহ অন্যান্য কাজ আটকে রাখেন। মনির হোসেন বহিরাগত হলেও ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষার বোর্ডের ‘ক্যাশিয়ার’ বলে উপর থেকে নিচ (ডিডি থেকে গ্যাঁটিজ) পর্যন্ত সবার কাছে সমাদৃত। তিনিই ঢাকা জেলা ও মেট্রা-২’র ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষায় প্রতি বোর্ডে প্রায় ৩০০-৪০০ জন প্রার্থীর পরীক্ষা নেন। পাস করানো হয় ঘুষের বিনিময়ে। গড়ে সপ্তাহে চার-পাঁচটি বোর্ডে প্রায় ১৫০০-১৬০০ জন ও মাসে ১৬-২০টি বোর্ডের প্রায় ৪৫০০-৫০০০ জনের অধিক প্রার্থীর পরীক্ষা নেওয়া হয়। এরপর ফেলের গ্যাঁড়াকলে আটকে সুযোগমতো আদায় করা হয় ওই ঘুষের টাকা। যা বোর্ড প্রতি গড়ে চার-পাঁচ লাখ হিসাবে সপ্তাহে ১৬-২০ লাখ ও মাসে গিয়ে দাঁড়ায় ৮০ লাখ- এক কোটি টাকায়। এসব টাকা দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক হিসেবে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত আনুপাতিক হারে ভাগাভাগি হয়। ভুক্তভোগী জাহাঙ্গীর আলম, সোলেমান শেখ, রফিকুল ইসলাম, শাহিন মিয়া, তৌফিকুর রহমান জানান, পরীক্ষার খাতায় কিছু না লিখলেও টাকার বিনিময়ে পাস করেছেন তারাসহ আরো অনেক পরীক্ষার্থী। এছাড়া মোখলেছুর রহমান, হারুনুর রশিদ, আলমগীর হোসেনসহ কয়েকজন পাস করলেও তাদের ফেল দেখানো হয়। ফেলের গ্যাঁড়াকলে আটকে রেখে ঘুষ নিয়ে অবশেষে পাস দেখানো হয় বলে জানান তারা। প্রতিটি পরীক্ষার্থীকে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা করে ঘুষ দিতে হয়েছে। আবার অনেকে জানান, ড্রাইভিং লাইসেন্স এর জন্য সরকারি ফি শ্রেণিভেদে আড়াইহাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার হলেও দালালের মাধ্যমে প্রতি লাইসেন্স বাবদ ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা করে গুণতে হয়েছে। অপরদিকে গাড়ির টেস্ট পরীক্ষায় ২০০ টাকা দিতে হয়। এছাড়া গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ফি শ্রেণিভেদে গ্রাহকদের কাছ থেকে ১৫ হাজার থেকে প্রায় ২ লাখ টাকা আদায় করেন সংস্থার দালাল ও কর্মকর্তারা। একইভাবে নানান অজুহাত দেখিয়ে গাড়ির ফিটনেস, রুট পারমিট, ফিটনেস সনদ পেতে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে গুণতে হয় কয়েকগুণ বাড়তি টাকা। তা না হলে সহজেই মেলেনা সনদ।
এ রিষয়ে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মামুনুর রশীদ জানান, সম্প্রতি তার নেতৃত্বে সংস্থাটিতে অভিযান চালায় থানা পুলিশের একটি দল। এ সময় সেখান থেকে হুমায়ুন কবির, হাবিবুর রহমান, আব্বাস আলী, ফারুক হোসেন, বাহাদুর ও বেল্লাল, মামুন ও রফিক নামের ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।
কথিত ক্যাশিয়ার মনির হোসেনের সাথে মোবাইলে এ ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন। আর ঢাকা জেলা ও মেট্রো-২’র মোটরযান পরিদর্শক জমির উদ্দিনের মোবাইলে ফোন করলে তিনি ফোন ধরেননি। ইকুরিয়া সার্কেলের সর্বেসর্বা উপ-পরিচালক (ডিডি) সানাউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।























