◉ রিমালে বন বিভাগের ৬ কোটি ২৭ লাখ টাকার ক্ষতি
◉ বনজীবীদের উদ্বেগ কাটেনি
◉ পর্যটকদের জন্যও রাখা হয়েছে ভ্রমণ ও বিনোদনের ব্যবস্থা
সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতিসহ বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজনন নিশ্চিত করতে জেলে-বনজীবীসহ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের তিন মাসের প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেটি শেষ হচ্ছে আজ শনিবার। বন বিভাগের কাছ থেকে বৈধ পাস-পারমিট নিয়ে আগামীকাল রোববার থেকে সুন্দরবনে যেতে পারবেন জেলে-বনজীবীসহ পর্যটকরা।
৯০ দিন পর সুন্দরবনের দুয়ার খোলার সময় হওয়ায় খুশি আশপাশ এলাকার মানুষ। তবে অল্প স্থানে একসঙ্গে হাজার হাজার বনজীবীর উপস্থিতিতে প্রত্যাশামতো মাছ ও কাঁকড়া শিকার করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন তারা। তাছাড়া বড় কোম্পানিগুলোর আধিপাত্যের কারণে পছন্দের জায়গায় জাল ফেলা নিয়েও তারা উদ্বেগে রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে বনকর্মীদের টহল জোরদারসহ অভয়ারণ্যের আয়তন হ্রাসের দাবি জানিয়েছেন তারা। উপকূলজুড়ে বিকল্প কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলারও দাবি জেলেদের।
সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ও মৎস্যসম্পদ রক্ষায় ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানসের (আইআরএমপি) সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৯ সাল থেকে প্রতি বছরের ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এই তিন মাস বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইড) ম্যানগ্রোভ এই বনে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা জারি করে থাকে বন বিভাগ।
বংশপরম্পরায় সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল উপজেলার কদমতলা গ্রামের চল্লিশোর্ধ্ব গৃহবধূ জাহানারা বেগম বলছিলেন, পরিবারের সদস্যদের খাওয়া-পরা থেকে শুরু করে চিকিৎসা ও শিক্ষা খরচ আসে সুন্দরবন থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে বছরে একাধিকবার বনে প্রবেশ বন্ধের কারণে তাদের ঋণের বোঝা ভারী হচ্ছে। এ জন্য বিকল্প কর্মক্ষেত্র গড়ার পাশাপাশি সহজ শর্তে জেলে পরিবারের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করার দাবি জানান তিনি।
লম্বা বিরতির পর সুন্দরবনের বিভিন্ন খাল ও নদীতে মাছ-কাঁকড়া ধরতে যাওয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি সেরে নিয়েছেন জেলেরা। নৌকা মেরামত, নতুন করে রং করার পাশাপাশি বাজার-সদাইও করে নিয়েছেন তারা। সহযোগী জেলেদের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্নের পাশাপাশি শিকার করা মাছ ও কাঁকড়া বিক্রির জন্য দর-দাম ঠিক করে নিয়েছেন মহাজনসহ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। পর্যটকবাহী নৌযান মেরামতের পাশাপাশি নতুনভাবে সাজিয়ে প্রস্তুত করেছেন ট্রলার চালকরা।
তিন মাস বসে থাকায় অনেক ট্রলারের নিচ লবণাক্ততায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে পর্যটকবাহী ট্রলার মালিক আব্দুল হালিম বলেন, পর্যটক পরিবহনের জন্য ধারদেনা করে স্বল্প সংখ্যক ট্রলার প্রস্তুত করা গেছে। বছরের পুরো সময় পর্যটকদের জন্য সুন্দরবন উন্মুক্ত থাকলে ক্ষতি হবে না।
জেলেরা জানান, বন্ধের সময়ে সংসার চালাতে স্থানীয় বিভিন্ন সমিতি, এনজিওসহ মহাজনদের থেকে তারা ঋণ নিয়েছেন। আবার জাল ও নৌকা প্রস্তুতের জন্য শরণাপন্ন হয়েছেন দাদন ব্যবসায়ীসহ মহাজনদের। এ অবস্থায় সিন্ডিকেটকে বন বিভাগ সহায়তা করলে তাদের না খেয়ে মরার উপক্রম হবে। সুন্দরবনে ঢুকে পছন্দের জায়গায় মাছ ও কাঁকড়া শিকারে কর্তৃপক্ষের সহায়তা চান তারা।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বলেন, জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস হচ্ছে মৎস্য প্রজননের জন্য উপযুক্ত মৌসুম। এই সময় সাধারণত সব মাছ ডিম ছাড়ে। তাই ২০১৯ সাল থেকে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ও মৎস্যসম্পদ রক্ষায় ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানসের (আইআরএমপি) সুপারিশ অনুযায়ী প্রতি বছর ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস সব প্রকার মৎস্য আহরণ বন্ধ থাকে।
তিনি আরও বলেন, এ ছাড়াও এই সময়টিতে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীদেরও প্রজনন মৌসুম। সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি ঘুরে দাঁড়াতে জেলে বনজীবীসহ দেশ-বিদেশের সব পর্যটকদের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানসহ (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইড) ২৫ ফুটের কম প্রশস্ত সব খালে সারা বছর মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। সারা বছর ২৫ ফুট প্রশস্তের ঊর্ধ্বের নদী-খালে উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার জেলে-বনজীবীরা বন বিভাগের কাছ থেকে পাস-পারমিট নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে। এই তিন মাস ছাড়া সারা বছরই দেশি-বিদেশি পর্যটকরা (ইকো ট্যুরিস্ট) সুন্দরবন ভ্রমণ করে থাকেন। নিষেধাজ্ঞা শেষ ১ সেপ্টেম্বর থেকে বৈধ পাস-পারমিট নিয়ে জেলে-বনজীবীসহ দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আবারও সুন্দরবনে যেতে পারবেন।
পূর্ব সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন ও পর্যটনকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, মাছ, বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজননের জন্য জুন, জুলাই ও আগস্ট এই তিন মাস সুন্দরবনে জেলে ও পর্যটকদের প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়। এ সময় বনের বিভিন্ন প্রান্তে ময়লা-আবর্জনা জমেছে। সেগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সুন্দরবনকে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। এর মধ্যে ছবি কর্নার, উঁচু ওয়াচ টাওয়ার, ঝুলন্ত ব্রিজসহ নানা স্থাপনা নতুনভাবে সংস্কার করে সাজানো হয়েছে।
তিনি বলেন, পর্যটকরা আগামীকাল থেকে সুন্দরবনে আসলে যেন ভ্রমণ ও বিনোদন সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারে তার সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে বন এবং পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেন এই বন কর্মকর্তা।
চলতি বছরের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে পুরো সুন্দরবন ডুবে ছিল ৩৮ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে। এতো দীর্ঘ সময় জোয়ারের পানি থাকায় বন্যপ্রাণীদের ব্যাপক ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটেছে। মারা যায় ৪০টি হরিণ এবং ১টি বন্য শূকর। সাগরের নোনাপানি ঢুকে তলিয়ে যায় বন্যপ্রাণীর জন্য তৈরি করা মিঠাপানির পুকুরসহ শতাধিক জলাশয়। সে সময় জীবিত উদ্ধারের পর ১৭টি হরিণকে অবমুক্ত করা হয়।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের (খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলা) বিভাগীয় বন কর্মকর্তারা জানান, এই এলাকায় জলোচ্ছ্বাসে ১৪টি পুকুরের পাড় ভেঙে গেছে। ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ গোলপাতার বাগান প্লাবিত হয়ে গেছে। ১৮টি জেটি, ২৬৩০ ফুট রাস্তা ও বাঁধ, ৯টি সড়ক ও বনরক্ষীদের ৩টি ব্যারাক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুটি ওয়াচ টাওয়ার। একটি পন্টুন ভেসে গেছে। এতে ২ কোটি ৬১ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো গণমাধ্যমকে বলেন, প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী সুন্দরবনে বন বিভাগের ৬ কোটি ২৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
























