◉ বন্দির সাথে নিয়মিত সাক্ষাৎ ও ফোনকলে কথা বলছেন স্বজনরা
◉ ঢাকা বিভাগের ১৭ কারাগারে স্বস্তিতে বন্দিরা
◉ ঝুঁকিপূর্ণ কারাগারে এখনো টহলে সেনাবাহিনী
কোটা সংস্কার ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট দুপুরের দিকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে গোপনে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। সেদিনই পতন ঘটে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনার সরকারের । এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পরই বিজয়োল্লাসে মেতে উঠে ছাত্র-জনতাসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। একই সঙ্গে বিশেষ একটি গোষ্ঠী দেশজুড়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় পুলিশের থানা ভবনগুলোতে ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগে মেতে ওঠে। এসময় দেশের কয়েকটি কারাগারে বন্দিদের মধ্যেও বিদ্রোহ দেখা দেয়। সে সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ কয়েকটি কারাগারে অস্থিরতা বিরাজ করে। নরসিংদী ও গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারেও ব্যাপক বিদ্রোহে হতাহতের ঘটনা ঘটে। নরসিংদী কারাগার থেকে পালিয়ে যায় ফাঁসির আসামিসহ ৮২৬ বন্দি। পর্যায়ক্রমে বেশকিছু বন্দিকে গ্রেপ্তারও করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আবার অনেকে আত্মসমর্পণও করেন। সেসব কারাগারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাংলাদেশ জেল ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা যৌথভাবে কাজ করে। পরে আস্তে আস্তে সেসব কারাগারের সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে আসে। এখনো কিছু ঝুঁকিপূর্ণ কারাগারের বাইরে সেনা সদস্যদের টহল চলমান রয়েছে। বর্তমানে ঢাকা বিভাগের ১৭টি কারাগারে বন্দিরা নিয়ম মাফিক আগের মতোই কাজকর্ম করে যাচ্ছে। কারাবিধি অনুযায়ী স্বজনরা বন্দিদের সঙ্গে সরাসরি কারাগারে এসে সাক্ষাৎ করছেন। পাশাপাশি নিয়ম অনুযায়ী টেলিফোনে কথা বলতে পারছেন। গতকাল কারা কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। ওইদিনই রাজধানীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন গণভবন, সংসদ ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে বিক্ষুব্ধ জনতা। চালায় হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট। এরপর ওইদিন বিকেল থেকেই বিজয়োল্লাস করে ছাত্র-জনতাসহ দেশের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। ৫ আগস্ট সন্ধ্যার পরই বিশেষ একটি গোষ্ঠী সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাসহ পুলিশের থানা ভবনে ঢুকে ব্যাপক হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে মেতে ওঠে। লুট করে নেওয়া হয় থানার সব আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ। লুণ্ঠিত এসব অস্ত্র-গুলি হাত বদল হয়ে চলে যায় চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের হাতে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন হঠাৎ করেই গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের মধ্যে বিদ্রোহ শুরু হয়। একপর্যায়ে বিভিন্ন মামলায় কারাবন্দি ভয়ঙ্কর আসামিরা কারারক্ষীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে কারাগার থেকে ফাঁসির আসামিসহ ২০৯ জন বন্দি পালিয়ে যান। পরে খবর পেয়ে সেনাবাহিনী ও কারারক্ষীদের যৌথ অভিযানে বন্দিদের সাথে গুলি বিনিময়ে ৬ জন বন্দি নিহত হন। কারাগারটিতে জঙ্গিসহ প্রায় এক হাজার ২০০ বন্দি রয়েছে। তার মধ্যে আট শতাধিক ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি ছিলেন। গত ৮ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে গাজীপুর জেলা ও জামালপুর কারাগারেও বন্দিরা মুক্তির জন্য বিদ্রোহ শুরু করে। এ সময় কারারক্ষীদের ছোড়া রাবার বুলেটে ১৩ বন্দি ও ৩ কারারক্ষী আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কারাগারে অবস্থান করে সেনাবাহিনী।
জামালপুর কারাগারের সুপার (ভারপ্রাপ্ত) মাজহারুল ইসলাম বলেন, কারাগার থেকে কোনো বন্দি বের হতে পারেনি। সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অবস্থান করছে।
জেলা প্রশাসক শফিউর রহমান জানান, ঘটনার দিন জেলখানাটিতে ১০ জন কারারক্ষী ছিলেন। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী পৌঁছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। জেলখানা এখন সেনাবাহিনী ও পুলিশের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গত ৯ আগস্ট চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে কয়েদিরা বিদ্রোহ করেছেন। কারারক্ষীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন তারা। এ সময় গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। কারাগারের ভেতর বন্দিদের বিদ্রোহ দেখা দেওয়ায় কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের ঝুঁকিপূর্ণ কারাগারগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে যৌথ বাহিনী। এর আগে শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই বিকেল সোয়া চারটার দিকে আন্দোলনকারীরা মুহুর্মুহু ইটপাটকেল ছুড়তে ছুড়তে নরসিংদী জেলা কারাগারের দুই দিকের ফটক ভেঙে ভেতরে ঢোকেন। এ সময় পেট্রলবোমা মারা হয়। এতে কারাগারের ভেতরে নানা জায়গায় আগুন ধরে যায়। আন্দোলনকারীরা ছিনিয়ে নেওয়া চাবি দিয়ে বন্দিদের বেশ কয়েকটি কক্ষের তালা খুলে দেন। কিছু কক্ষের তালা ভেঙে ফেলা হয়। চারপাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। এ সময় আন্দোলনকারীরা আসামি ছিনিয়ে নিয়ে যান। এছাড়া অস্ত্রাগার ও কারারক্ষীদের থেকে ৮৫টি অস্ত্র ও ৮ হাজার ১৫০টি গুলি লুট করা হয়।হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় কারাগারে থাকা ৮২৬ জন বন্দি পালিয়ে যান। এর মধ্যে ১৩১ জন আত্মসমর্পণ করেছেন। ৫ জন থানায় ও ১২৬ জন আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এছাড়া পুলিশের অভিযানে গ্রেফতার হয়েছেন চারজন। লুণ্ঠিত বেশকিছু অস্ত্র ও গোরাবারুদ্ধ উদ্ধারসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
এদিকে গত ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ জেলায় অভিযান চালিয়ে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামিকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১১ এর একটি দল। গতকাল রোববার দুপুরে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন র্যাব-১১ এর মিডিয়া অফিসার এএসপি সনদ বড়ুয়া।
এদিকে ঢাকার কয়েকটি কারাগারের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে কারাগারে বন্দিদের অবস্থা স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তিনবেলা বন্দিরা খাবার-দাবারের পাশাপাশি স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পাচ্ছেন। এ ছাড়া কারা নিয়ম অনুযায়ী টেলিফোনে স্বজনদের সঙ্গে বন্দিরা কথা বলছেন।
এদিকে নতুন দায়িত্ব নেওয়া ঢাকা বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন্স) মো. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ঢাকা বিভাগস্থ কারাগারগুলোর কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। বন্দিরা বর্তমানে নিরাপদ ও স্বস্তিতে আছেন। এ বিভাগে দায়িত্বরত কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্ব স্ব কারাগারের নিরাপত্তা নিশ্চিতপূর্বক বন্দিদের নিরাপদ আটক নিশ্চিতে নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া বন্দিদের থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা, পরিবারের সদস্য ও আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, সরকারি টেলিফোন মারফত কথা বলা সবকিছুই সরকারি বিধিবিধানের আলোকে স্বাভাবিক আছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে কারাগারগুলোকে আরও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।
কারাগার কর্তৃপক্ষ জানায়, ঢাকা বিভাগের আওতাভুক্ত কারাগারগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কাশিমপুরস্থ ৪টি কেন্দ্রীয় কারাগার, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার। ঢাকা বিভাগের ১৭টিসহ দেশের প্রতিটি কারাগারেই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। কারাগারের ভেতর যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ও বন্দিদের বিদ্রোহ দমনে প্রতিটি সেলে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্রোহের শঙ্কা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ অধিকাংশ কারাগারের ভেতর ও বাইরে সেনাবাহিনীর টহল অব্যাহত রয়েছে।

























