◉ দেশজুড়ে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা
◉ এবারও বেশিরভাগ ডেঙ্গুরোগী ডেন-২ ধরনে আক্রান্ত
◉ ঢাকার দুই সিটিতে নষ্ট অধিকাংশ মশকনিধন সরঞ্জাম
◉ মশকনিধনে চলছে চিরুনি অভিযান, কাজের গতিবিধি অনুসরণ হচ্ছে ডিভাইসে
➥‘শুধু বর্ষকালেই নয়, বছরের অন্য সময়ের দিনে বা রাতেও এই মশা কামড়াতে পারে। ডেঙ্গুর চারটি ধরন রয়েছে, চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা করে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে হবে। এছাড়া প্রচুর পরিমাণ তরল খাবার খেতে হবে’
সহকারী অধ্যাপক ডা. কাকলী হালদার, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, ঢামেক হাসপাতাল
➥‘আমরা গবেষণা করে ডেঙ্গু নির্মূলে সুপারিশ ও পরামর্শ দিয়ে থাকি। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা কেউ তা আমলে নেয় না। মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক কীটনাশক বাছাই করে তা সরবরাহ করা গুরুত্বপূর্ণ। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে সঠিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে থাকবে’
অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার, কীটতত্ত্ববিদ ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
দেশজুড়ে ক্রমেই বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। দিন যত গড়াচ্ছে, ততই ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে ডেঙ্গু। প্রাণঘাতী ডেঙ্গুর চোখ রাঙানিতে সর্বত্র বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে ১ হাজার ১৫২ জন নতুন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি মাসে ডেঙ্গুতে ৮০ জনের মৃত্যু হলো। চলতি বছর কোনো মাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু এটি। এর মধ্যে আটটি শিশু রয়েছে। এ বছর মশাবাহিত এ রোগে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৩ জনে। এছাড়া এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩০ হাজার ৯৩৮ জন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাকলী হালদার বলছেন, শুধু বর্ষাকালেই নয়, বছরের অন্য সময়ের দিন ও রাতেও এই মশা কামড়াতে পারে। ডেঙ্গুর চারটি ধরন রয়েছে। এবারও বেশিরভাগ ডেঙ্গুরোগী ডেন-২ ধরনে আক্রান্ত। চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা করে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে হবে। এছাড়া প্রচুর পরিমাণ তরল খাবার খেতে হবে। এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, আমরা গবেষণা করে ডেঙ্গু নির্মূলে সুপারিশ ও পরামর্শ দিয়ে থাকি। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা কেউ তা আমলে নেন না। মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক কীটনাশক বাছাই করে তা সরবরাহ করা গুরুত্বপূর্ণ। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে সঠিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে থাকবে। অপরদিকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গেল জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলন চলাকালে অধিকাংশ মশকনিধন সরঞ্জামাদি চুরি ও নষ্ট হয়ে গেছে। এরপরও ডেঙ্গু নির্মূলে মশকনিধনে চিরুনি অভিযান চলছে। পাশাপাশি মশকনিধনে কর্মরত ব্যক্তিদের দৈনন্দিন কার্যক্রমের গতিবিধি অনুসরণে ডিভাইস ব্যবহার করা হচ্ছে। গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও দুই সিটিসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা যায়, বর্ষ মৌসুম শুরু হলেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। প্রাণঘাতী ডেঙ্গু দিনের পর দিন ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ রোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরও নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু জনসচেতনতার অভাবে ডেঙ্গু মশার বিস্তার ক্রমেই বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে ১ হাজার ১৫২ জন নতুন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি মাসে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে ৮ জনই শিশু। এ বছর মশাবাহিত এ রোগে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৩ জনে। এছাড়া এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩০ হাজার ৯৩৮ জন। গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে এক হাজার ১৫২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায়ই ৪৭১ জন রয়েছেন। এছাড়া ঢাকা বিভাগে ২১৯ জন, বরিশালে ৭০ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ২৩৩ জন, খুলনায় ৮৬ জন, ময়মনসিংহে ২৭ জন ও রাজশাহী বিভাগে ৪০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৩০ হাজার ৯৩৮ জন। যাদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৭ শতাংশ নারী। ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ১৬৩ জনের মধ্যে ৫০ দশমিক ৯ শতাংশ নারী এবং ৪৯ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অক্টোবরে ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে ডেঙ্গুর প্রকোপ। বিশেষ করে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ১৮টি জেলার পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এবার ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি বিষয়কে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হলো স্থানীয় পর্যায়ে ঠিকমতো মশকনিধন না করা, গণ-আন্দোলনে সময় সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিসে হামলায় মশা মারার মেশিন নষ্ট হওয়া, পরিবর্তিত অবস্থায় প্রশাসনের ঠিকমতো গুছিয়ে না উঠতে পারা। এদিকে মেয়র না থাকায় নতুন করে দায়িত্ব নিয়েছেন প্রশাসকরা। অল্প সময়ের মধ্যে তাদের প্রস্তুতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পক্ষ হতে মশকনিধন কার্যক্রম তদারকি করার জন্য কমিটি করা হয়েছে। তদারকির জন্য বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ১০টি অঞ্চলে ১০টি দল গঠন করা হয়েছে। অপরদিকে দক্ষিণ সিটি (ডিএসসিসি) থেকে মশকনিধন কার্যক্রমের জন্য সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে অনলাইনের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণের কথা বলা হয়েছে। যারা বিভিন্ন এলাকায় মশা মারার কাজ করছেন, তাদের শরীরে ডিভাইস যুক্ত করা আছে। এর মাধ্যমে এসব কর্মীর গতিবিধি লক্ষ করা যাচ্ছে। দুই সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, জুলাই-আগস্ট মাসের সহিংসতায় ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২৫টি ওয়ার্ডের মশকনিধনের যন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত বা চুরি হয়েছে। উত্তর সিটিতে ১৫টি ওয়ার্ডের মশকনিধনের সরঞ্জাম কমবেশি নষ্ট হয়েছে। তারপরও নগর কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তাদের কাজ চলছে। ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, ডেঙ্গু বিষয়ে যে সব পরিকল্পনা করা ছিল, সেই অনুযায়ী কাজ করছেন তারা। তবে কাউন্সিলর না থাকার কারণে একটু সমস্যা হচ্ছে স্বীকার করে তিনি জানান, এ জন্য বিশেষ টিম করা হয়েছে।
আর ডিএসসিসির প্রশাসক ড. মহা. শের আলী বলেন, দক্ষিণ সিটির আওতায় হাসপাতালে যেসব রোগী মারা যাচ্ছেন, এগুলো এই করপোরেশনের বলা হচ্ছে। তবে হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, এসব রোগীদের অনেকে ঢাকারে বাইরে থেকে এসেছেন। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তিনি বলেন, মশা নিধনসহ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তিনি আশা করছেন, ডেঙ্গুর যে ভয়াবহতার কথা বলা হচ্ছে, তেমনটি নয়।
এ ব্যাপারে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, দুই মাস আগে থেকেই তিনি ফরকাস্টিং মডেল করে জানিয়েছেন যে সেপ্টেম্বর মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে। তবে গবেষকদের কথা কেউ আমলে নেয় না বলেও জানান তিনি। ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়বে জানিয়ে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, চলতি মাসের অক্টোবরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক কীটনাশক বাছাই করে তা সরবরাহ করা গুরুত্বপূর্ণ। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে সঠিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তবে এ জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও গুরুত্ব দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে বলেও জানান এই কীটতত্ত্ববিদ।
এদিকে এবারও ডেঙ্গুরোগীর বেশিরভাগ ডেন-২ ধরনে আক্রান্ত হচ্ছে জানিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাকলী হালদার বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ (ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩, ডেন-৪) আছে। যেকোনো একটি সেরোটাইপ দিয়ে প্রথমবার সংক্রমণ হলে ডেঙ্গু ক্লাসিক্যাল ফিভার হয় এবং সেই নির্দিষ্ট সেরোটাইপের বিরুদ্ধে রোগী আজীবন অ্যান্টিবডি/প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে। কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপগুলোর বিরুদ্ধে সাময়িক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে। তিনি বলেন, ডেঙ্গুর চারটি ধরণ রয়েছে, চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা করে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে হবে। এছাড়া প্রচুর পরিমাণ তরল খাবার খেতে হবে।
আইইডিসিআরের সায়েন্টিফিক অফিসার (ভাইরোলজি বিভাগ) ডা. আব্দুল্লাহ ওমর নাসিফ বলেন, সাধারণত ডেঙ্গুর একটি সেরোটাইপের প্রাধান্য থাকে তিন থেকে চার বছর। এ সময় বড় একটি সংখ্যক মানুষ এই সেরোটাইপে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের মধ্যে ইমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি) হয়। গত বছরও সেরোপটাইপ-২ এর প্রাধান্য দেখা গেছে। যেহেতু এবার সেরোটাইপ (ডেন-২) রয়েছে, সুতরাং আগের সেরোটাইপটার জন্য মানুষের মধ্যে ইমিউনিটি আছে। সে হিসেবে বলা যায় ডেন-২ ঘায়েল করতে পারবে এমন সুযোগ কম। তবে ঢাকার বাইরে বড় সংখ্যক মানুষ যারা ডেন-২ আক্রান্ত হয়নি এখনো, তাদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।























