জোয়ার ভাটায় প্রবাহমান বাঁকখালী নদী এখন মৃত প্রায়। দূষণ দখলের কবলে পড়ে কক্সবাজারের বাকঁখালী নদী হারিয়েছে তার ঐতিহ্য। গড়ে উঠেছে কক্সবাজার পৌরসভার ময়লা ফেলার ডাম্পিং স্টেশন। শত-শত ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্টান।জাল খতিয়ান তৈরি করে প্লট বানিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে নদীর জমি।
সরজমিনে দেখা যায়, বাঁকখালী নদীর দুই পাশের প্রায় ১৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শত শত স্থাপনা করেছে অবৈধ দখলদাররা। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নদীর জমিতে নির্মাণ করেছে খুরুশকুল কস্তুরাঘাট ব্রীজ। নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে পেশকার পাড়া নামে বিশাল পাড়া। নতুন করে নদী ভরাট করে তৈরি করা হচ্ছে কস্তুরাঘাট পয়েন্টে নতুন নতুন স্থাপনা। ৬ নম্বর ঘাট থেকে উত্তর নুনিয়াছড়া পর্যন্ত প্রায় ২৮টি অবৈধ জেটি রয়েছে বর্তমানে। সবকটিই অনুমোদনহীন। নদী থেকে বালু তুলে রাখার পাশাপাশি সিলেট থেকে পাথর ও বালু এনে বিক্রির জন্য মোট ৫টি সেল সেন্টার করা হয়েছে অবৈধভাবে। কয়েকটি তেলের বার্জও রয়েছে। এছাড়া রয়েছে বরফকল, কোল্ড স্টোরেজ, ফিশিং অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, ডকইয়ার্ড, মাছের আড়ত, শুঁটকির আড়তসহ শত শত বসতঘর।
পরিবেশবিদ, সাংবাদিক এইচ এম নজরুল ইসলাম জানান, ২০১০ সালে সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিআইডব্লিউটিএ-কে বাঁকখালী নদী বন্দরের সংরক্ষক নিযুক্ত করেছিল। নদী তীরবর্তী প্রায় ২৭০ একর ভূমি সংস্থাটিকে দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু নদীতীরের জমিগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে কোন কাজ করেনি জেলা প্রশাসন। অভিযোগ আছে, নদীতীরের দখল, ইজারাসহ নানা কার্যক্রমকে ঘিরে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক লেনদেন সংঘটিত হয়। এজন্য নদী বন্দর প্রক্রিয়াকে ঝুলিয়ে রেখেছে সংশ্লিষ্টরা। আর এই সুযোগে দখলদাররা জেলা প্রশাসনের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে দখল কার্যক্রম চালিয়েছে। অবৈধ দখলের পাশাপাশি নদী খেকোরা অনেকে নদীর জমিকে নিজের বলে দাবি করছেন। শুধু তাই নয়, জেলা প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের একটি চক্রের মাধ্যমে কস্তুরিঘাট এলাকার নদীর বেশকিছু জমি ১৯৯০ সালের বাংলাদেশ জরিপে (বিএস) রেকর্ডভুক্ত করা হয়েছে বলে জানাযায়।
শহরের কস্তুরা ঘাট পয়েন্টে ২০১৩ সালে কক্সবাজার পৌরসভা ময়লা ফেলা শুরুর মাধ্যমে নদী দখলের যাত্রা শুরু করে। ২০১৬ সালে এখানে থাকা খালটির দু’পাশ বন্ধ করে মেরে ফেলা হয়। বন্ধ হয় পানির প্রবাহ। ২০১৫ সালের পর থেকে দখল শুরু হয় বড় এলাকাজুড়ে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে পুরো কস্তুরিঘাট এলাকায় বালু ফেলে নদীর চিহ্ন পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করা হয়।
২০২০ সালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) কর্তৃক প্রকাশিত তালিকায় নদী দখলদার হিসেবে জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, ব্যবসায়ী, ১৩১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়।
প্রায় ৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁকখালী নদীর একসময় প্রশস্ততা ছিল ৯৬ থেকে ১২০ মিটার পযন্ত। কিন্তু দখলের কারণে প্রশস্ততা কমে কক্সবাজার শহরের কোথাও ৫০ মিটার, কোথাও ৬০-৭০ মিটার হয়ে গেছে।
মহেশখালীর নাগরিক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. রায়হানুল মোস্তফা স্বপ্রণোদিত হয়ে ২০১৩ সালে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন। রিটের পূর্ণাঙ্গ শুনানি শেষে ২০১৬ সালে রায় ঘোষণার ৬০ দিনের মধ্যে নদী তীরভূমি বিআইডব্লিউটিএ-কে বুঝিয়ে দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়। সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা কস্তুরাঘাটের প্রবীণ ব্যবসায়ী সালেহ আহমদ জানিয়েছেন, বদর মোকাম জামে মসজিদের পাশে নদীর সীমানা ঘেঁসে আমার গোলপাতার দোকান ছিলো, একটু পূর্বদিকে বিআইডব্লিউটিএ টার্মিনাল ঘাট এখানে জাহাজ এসে ভিড়তো। এখান চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াতের একমাত্র সহজ মাধ্যম এই নদী পথ। এখন তার ছিটেপুটে চিহ্ন ও নেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন -বাপা কক্সবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক করিম উল্লাহ কলিম বলেন, উপকূল রক্ষার জন্য এক দশক আগে লাগানো প্যারাবনও নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। এসব বনের মাঝখানে বালু বিক্রয় কেন্দ্র বা ব্যক্তিগত স্থাপনা করা হয়েছে। প্যারাবনের অন্তত ৪০ হাজার বাইন ও কেওড়াগাছ উজাড় হওয়ায় ২০০ প্রজাতির পাখির আবাসস্থলসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। উজাড় করা হয়েছে কয়েকশ একর প্যারাবন।
লেখক গবেষক সাংবাদিক মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম জানান , বঙ্গোপসাগরের ৪ শতাধিক সামুদ্রিক প্রাণির অধিকাংশই এ নদীর মোহনায় এসে ডিম ছাড়ার অভয়াশ্রম ছিলো। এই বাঁকখালী নদী এক সময় কক্সবাজারের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতো। অবদান ছিলো কক্সবাজারের জীববৈচিত্র্য রক্ষায়। বর্তমানে কক্সবাজার শহর ও খুরুশকুলের বাঁকখালী নদী তীরে বাইনসহ নানাজাতের ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ হারিয়ে গেছে। একসময় বাঁকখালী নদী তীর গোলপাতা ও কেওড়ার জন্য বিখ্যাত ছিল।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, বিলুপ্তি হয়ে গেছে বাকঁখালী নদীর প্যারাবনে ১২ হাজারের বেশি প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজাতি। এর মধ্যে উদ্ভিদ রয়েছে ৫৬৭ প্রজাতির। শামুক-ঝিনুক রয়েছে ১৬২ প্রজাতির, কাঁকড়া ২১, চিংড়ি ১৯, লবস্টার দুই, মাছ ২০৭, উভচর ১২ ও ১৯ প্রজাতির সরীসৃপ।
বাঁকখালী নদী বাংলাদেশের পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ৬৯ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৯৫ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক বাঁকখালী নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর পূর্ব -পাহাড়ি অঞ্চলের নদী নং ৯। বান্দরবানের নাক্ষ্যংছড়ি হয়ে রামু বুক চিরে কক্সবাজারের নাজিরারটেক, বঙ্গোপসাগরের মোহনায় যুক্ত হয়েছে বাঁকখালী নদী এখন মৃত প্রায়।
আমরা কক্সবাজারবাসীর সাধারণ সম্পাদক, নাজিম উদ্দীন বলেন, কক্সবাজার বাসীর প্রাণের দাবী বাঁকখালী নদী দখল মুক্ত করে পূণরায় ড্রেসিং করতঃ মহেশখালী কস্তুরাঘাট চালু করা হোক। প্রাণ ফিরে পাক বাঁকখালী।


























