◉ রাজধানীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ
◉ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা
◉ ছাত্রদের রক্তের ওপর আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন হচ্ছে-হাসনাত
অর্ন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা দুইজনকে নিয়ে বির্তক তৈরি হয়েছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন এই উপদেষ্টাদের নিয়োগ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং বিক্ষোভ করেছে। এছাড়া সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমেও বিভিন্ন মহলের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। আবার কেউ কেউ উপদেষ্টা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অঞ্চল প্রীতিরও অভিযোগ তুলেছেন।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বঙ্গভবনের দরবার হলে নতুন তিন উপদেষ্টাকে শপথ পাঠ করান। তারা হলেন- ব্যবসায়ী শেখ বশির উদ্দিন, চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. মাহফুজ আলম। এরপরই আলোচনা উঠে আসে উপদেষ্টা পরিষদ। সামাজিক মাধ্যমে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতরা ছাড়াও বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের কর্মী সমর্থকরাও শেখ বশিরউদ্দীন ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
শিল্পগোষ্ঠী আকিজ-বশির গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ বশির উদ্দিন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি শেখ আফিল উদ্দীনের ভাই ও একটি মামলার আসামি এমন তথ্যও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে। তার নাম সম্বলিত মামলার কাগজের ছবি ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হচ্ছে। তিনি জানিয়েছেন যে এটি সঠিক কি না তা যাচাই করা হচ্ছে। সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, যারা আন্দোলন করেছেন, তাদের আবেগের সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই। তবে আমার ধারণা, ওনারা মিস ইনফরমড (ভুল তথ্য পাওয়া)। ওনাদের তথ্যের ভিত্তি সঠিক নয়।
আর ফারুকী বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতন না হলে তিনিও জেলে থাকতেন। তিনি দাবি করেছেন ২০১৮ সাল থেকেই বিভিন্ন সময়ে সরকারের পতনের জন্য সক্রিয় ছিলেন তিনি। ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান ছিল কি না, তার পুরস্কার হিসেবে এখানে দায়িত্ব পালন করতে এসেছি কি না, এসব বিষয় বড় নয়, আমার কাজ দিয়ে আমার অবস্থান বিবেচনা করতে হবে।
এদিকে রোববার রাতেই রাতে ছাত্র-জনতা পরিচয় দিয়ে একদল মানুষ বঙ্গভবনের সামনে মশাল মিছিল করে প্রতিবাদ করেছেন। তারা বলছেন, নতুন উপদেষ্টা বশির উদ্দিন শেখ হাসিনার উপদেষ্টা। বাংলার মাটিতে হাসিনার কোনো উপদেষ্টাকে মেনে নেওয়া হবে না। প্রতিবাদকারীদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমরা এই উপদেষ্টা চাই না। আকিজ গ্রুপের মালিককে আমরা মানি না। উনি হাসিনার উপদেষ্টা।
আর রাতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা উপদেষ্টা চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভকারীদের দাবি, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পতিত আওয়ামীলীগ সরকারের দোসর। বিভিন্ন সময়ে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা উপায়ে শেখ হাসিনা সরকারের প্রশংসা করেছেন, সমর্থন যুগিয়েছেন। এছাড়া সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘনিষ্ট সাবেক তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকসহ ফ্যাসিস্ট সরকারের একাধিক নেতার ঘনিষ্ট ছিলেন ফারুকী।
এদিকে রাতেই ‘খুনি হাসিনার তেলবাজরাও উপদেষ্টা হচ্ছে’- বলে অভিযোগ করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। আর উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনের ঘোষণা দেন হাসনাত আব্দুল্লাহ।
শপথ পাঠের সময় পেছনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি থাকার বিষয়ে সোমবার ভোররাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আমরা সারাদিন লীগ তাড়াবো আর বলবো, ‘মুজিববাদ, মুর্দাবাদ।’ আর তারা মুজিবের ছবি পিছনে টানিয়ে করে শপথ পাঠ। এর আগে মধ্যরাতে আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম তার ফেসবুক পেজে উপদেষ্টা ইস্যুতে লিখেছেন, শুধু ১টা বিভাগ থেকে ১৩জন উপদেষ্টা! অথচ উত্তরবঙ্গের রংপুর, রাজশাহী বিভাগের ১৬টা জেলা থেকে কোনো উপদেষ্টা নাই! তার উপর খুনী হাসিনার তেলবাজরাও উপদেষ্টা হচ্ছে! আর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদ লিখেছেন, যে কারো বিরোধিতা করতে আমি দ্বিধা করবো না এবং এ বিরোধিতা ন্যায্য ও দায়িত্বও বটে।
গতকাল সোমবার বিকেলে সাড়ে ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। পরে সন্ধ্যায় সেখান থেকে একটি মিছিল বের হয়ে ভিসি চত্বরে গিয়ে সমাপ্ত হয়। বিক্ষোভে বিতর্কিত ব্যক্তিদের উপদেষ্টা পদ থেকে অনতিবিলম্বে অপসারণের দাবি জানানো হয়। এরআগে বিক্ষোভ সমাবেশে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আমার চাই আপনারা অতি দ্রততম সময়ে তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন এবং ছাত্র নাগরিকদের অংশীদারিত্বের বাইরে গিয়ে আপনারা যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেন তাহলে তা মেনে নেয়া হবে না। অতিদ্রুত এই সিদ্ধান্তের নিরসন চাই।
সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, যারা বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে ধারণ করে না, ধানমন্ডি ৩২-কে কাবা মনে করে তাদের আমরা লাল কার্ড দেখাই। এমন কাউকে আমরা উপদেষ্টা প্যানেলে চাই না। উপদেষ্টা নিয়োগে আঞ্চলিকতাকে ইস্যু করা হচ্ছে। উত্তরবঙ্গ থেকে কোনো উপদেষ্টা নেই, অথচ আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ উত্তরবঙ্গের। এই সরকারের যারা ফ্যাসিবাদের দোসর তাদের অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে।
এদিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী বিপ্লবী ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে অন্তর্র্বতী সরকারে আওয়ামী সুবিধাভোগীদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুনর্বাসনের প্রতিবাদে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও সেখ বশির উদ্দিনকে উপদেষ্টা বানিয়ে শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন এবং তাদের অপসারণের দাবি জানান।
রংপুর প্রেসক্লাবের সামনে সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। এ সময় ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক, জুলাই বিপ্লবের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড আখতার হোসেন ও সারজিস আলমসহ উত্তরবঙ্গ থেকে অন্তত ১০ জনকে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে নিয়োগ দেওয়ার দাবিও জানান তারা। অন্তর্র্বতী সরকারে রংপুর বিভাগ থেকে উপদেষ্টা না রাখাকে ‘চরম বৈষম্য’ বলে মনে করছেন তারা।
এর আগে প্রথম দফায় উপদেষ্টা পরিষদ শপথ নেয়ার পরেই আলোচনায় আসে যে উপদেষ্টা পরিষদের বেশিরভাগই চট্টগ্রাম অঞ্চলের। এছাড়া এ সরকারে ‘এনজিও ব্যাকগ্রাউন্ড’- এর লোকজন বেশি এমন মন্তব্যও ব্যাপক প্রচার পায়। এ আলোচনা বাড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গত আটই নভেম্বর তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে এনজিও শাসিত আখ্যায়িত করে অবিরাম প্রচারণা চলছে। কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির মন্তব্যও আছে। তারা এই ধারণাটি প্রচার করছেন যে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) ব্যাকগ্রাউন্ডের ব্যক্তির আধিক্য রয়েছে। ২১ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের আনুষ্ঠানিক রেকর্ডে দেখা যায়, মাত্র চারজন উপদেষ্টার এনজিও ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে, যাদের মধ্যে দুজন শীর্ষ আইনজীবী।

























