০৭:৫৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে অস্থিরতা

◉ সশস্ত্র গ্রুপে চলছে আধিপত্যের লড়াই
◉ খুন-চাঁদাবাজি নির্যাতন রোহিঙ্গাদের নিত্যসঙ্গী
◉ দশ মাসে সংঘর্ষ-গোলাগুলিতে নিহত ৭৪

মিয়ানমারে সামরিক জান্তা বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতনে প্রাণভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিলেও সাধারণ রোহিঙ্গারা এখনও নিরাপত্তাহীনতা দিনাতিপাত করছেন। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিলেও এখনে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে সশস্ত্র গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। মিয়ানমার সামরিক জান্তা বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই চালিয়ে যাওয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। দুটি গ্রুপের সশস্ত্র যোদ্ধারা রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণে এবং নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে খুন-দখল-চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জুলুম-নিপীড়ন যেন সাধারণ রোহিঙ্গাদের জন্য নিত্যসঙ্গী হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে। দুটি গ্রুপের ধারাবাহিক খুনোখুনি, জুলুম-নিপীড়ন আর চাঁদাবাজিতে অতিষ্ট হয়ে উঠছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা। অনেকেই প্রাণভয়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছেন না। ক্যাম্পের বিভিন্ন পয়েন্টে রয়েছে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর গোপন আস্তানা ও টর্চার সেল। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রসহ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করলেও উত্তেজনা থামেনি। অব্যাহত গোলাগুলি ও সংঘর্ষে গত ১০ মাসে নিহত হয়েছেন ৭৪ জন রোহিঙ্গা। পুলিশ বলছে, অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বে প্রায়ই খুনোখুনি ও মারধর-চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। ক্যাম্পের ভেতর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গতকাল রোববার রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেকনাফ-উখিয়া ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গারা জানান, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। তারা চাঁদাবাজি, খুন, নির্যাতনসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। ক্যাম্পের ভেতর দোকান বা ভালো কিছু করলে সেগুলো থেকে নিয়মিত নির্দিষ্ট অংকের চাঁদা তোলেন তারা। চাঁদা না দিলে এমনকি তাদের কথামতো না চললে, সাধারণ রোহিঙ্গাদের ধরে টর্চার সেলের গোপন আস্তানায় নিয়ে নির্যাতন করা হয়। ভয় ও আতঙ্কে তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পান না।
উখিয়ার ক্যাম্প-১৭ এর বাসিন্দা আব্দুল হালিম আক্ষেপ করে বলেন, মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে পালিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্পে আশ্রয় নিলাম। এখন আমাদের জাতি-গোষ্ঠীর কিছু খারাপ মানুষ বিভিন্ন গ্রুপের নাম দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। গত ২১ অক্টোবর এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যরা ক্যাম্পে বসবাসরত একই পরিবারের তিন সদস্য আহমেদ হোসেন, তার ছেলে সৈয়দুল আমিন ও মেয়ে আসমা বেগমকে গুলি করে হত্যা করে বলেও জানান আব্দুল হালিম। টেকনাফ নয়াপাড়া রেজিস্ট্রার ক্যাম্পের মাঝি (নেতা) ইকবাল জানান, গত ১০ নভেম্বর রেজিস্ট্রার ক্যাম্প সি-৫ ব্লকে রাতে মো. জুবায়ের নামের এক রোহিঙ্গা যুবককে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গুলি করে হত্যা করে। তিনি বলেন, এসব ঘটনায় আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকি। এপিবিএন, পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তৎপর রয়েছেন। তারপরও এসব সন্ত্রাসীরা তাদের অপরাধমূলক কাজ করে যাচ্ছেন।

রোহিঙ্গা নেতা ও আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএইচপিএস) সভাপতি ডা. মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, ক্যাম্পগুলোতে আধিপত্য বিস্তারের জেরে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। ক্যাম্পে বেশকিছু গ্রুপ মাদক কারবার, চাঁদাবাজি ও অপহরণসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব ঘটনায় সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে।
উখিয়া ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) খন্দকার ফজলে রাব্বি জানান, গত এক সপ্তাহে ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে দেশি-বিদেশি অস্ত্র-গুলি ও গ্রেনেডসহ কয়েকজন আরসা সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ক্যাম্পের ভেতর যে কোন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নির্মূলে ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা। এরই ধারাবাহিকতায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

জনপ্রিয় সংবাদ

নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গেল তিন বছরে ১৫ হাজার টন ই-বর্জ্য আমদানি

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে অস্থিরতা

আপডেট সময় : ০৭:৩০:৪৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

◉ সশস্ত্র গ্রুপে চলছে আধিপত্যের লড়াই
◉ খুন-চাঁদাবাজি নির্যাতন রোহিঙ্গাদের নিত্যসঙ্গী
◉ দশ মাসে সংঘর্ষ-গোলাগুলিতে নিহত ৭৪

মিয়ানমারে সামরিক জান্তা বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতনে প্রাণভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিলেও সাধারণ রোহিঙ্গারা এখনও নিরাপত্তাহীনতা দিনাতিপাত করছেন। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিলেও এখনে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে সশস্ত্র গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। মিয়ানমার সামরিক জান্তা বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই চালিয়ে যাওয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। দুটি গ্রুপের সশস্ত্র যোদ্ধারা রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণে এবং নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে খুন-দখল-চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জুলুম-নিপীড়ন যেন সাধারণ রোহিঙ্গাদের জন্য নিত্যসঙ্গী হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে। দুটি গ্রুপের ধারাবাহিক খুনোখুনি, জুলুম-নিপীড়ন আর চাঁদাবাজিতে অতিষ্ট হয়ে উঠছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা। অনেকেই প্রাণভয়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছেন না। ক্যাম্পের বিভিন্ন পয়েন্টে রয়েছে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর গোপন আস্তানা ও টর্চার সেল। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রসহ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করলেও উত্তেজনা থামেনি। অব্যাহত গোলাগুলি ও সংঘর্ষে গত ১০ মাসে নিহত হয়েছেন ৭৪ জন রোহিঙ্গা। পুলিশ বলছে, অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বে প্রায়ই খুনোখুনি ও মারধর-চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। ক্যাম্পের ভেতর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গতকাল রোববার রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেকনাফ-উখিয়া ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গারা জানান, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। তারা চাঁদাবাজি, খুন, নির্যাতনসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। ক্যাম্পের ভেতর দোকান বা ভালো কিছু করলে সেগুলো থেকে নিয়মিত নির্দিষ্ট অংকের চাঁদা তোলেন তারা। চাঁদা না দিলে এমনকি তাদের কথামতো না চললে, সাধারণ রোহিঙ্গাদের ধরে টর্চার সেলের গোপন আস্তানায় নিয়ে নির্যাতন করা হয়। ভয় ও আতঙ্কে তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পান না।
উখিয়ার ক্যাম্প-১৭ এর বাসিন্দা আব্দুল হালিম আক্ষেপ করে বলেন, মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে পালিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্পে আশ্রয় নিলাম। এখন আমাদের জাতি-গোষ্ঠীর কিছু খারাপ মানুষ বিভিন্ন গ্রুপের নাম দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। গত ২১ অক্টোবর এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যরা ক্যাম্পে বসবাসরত একই পরিবারের তিন সদস্য আহমেদ হোসেন, তার ছেলে সৈয়দুল আমিন ও মেয়ে আসমা বেগমকে গুলি করে হত্যা করে বলেও জানান আব্দুল হালিম। টেকনাফ নয়াপাড়া রেজিস্ট্রার ক্যাম্পের মাঝি (নেতা) ইকবাল জানান, গত ১০ নভেম্বর রেজিস্ট্রার ক্যাম্প সি-৫ ব্লকে রাতে মো. জুবায়ের নামের এক রোহিঙ্গা যুবককে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গুলি করে হত্যা করে। তিনি বলেন, এসব ঘটনায় আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকি। এপিবিএন, পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তৎপর রয়েছেন। তারপরও এসব সন্ত্রাসীরা তাদের অপরাধমূলক কাজ করে যাচ্ছেন।

রোহিঙ্গা নেতা ও আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএইচপিএস) সভাপতি ডা. মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, ক্যাম্পগুলোতে আধিপত্য বিস্তারের জেরে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। ক্যাম্পে বেশকিছু গ্রুপ মাদক কারবার, চাঁদাবাজি ও অপহরণসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব ঘটনায় সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে।
উখিয়া ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) খন্দকার ফজলে রাব্বি জানান, গত এক সপ্তাহে ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে দেশি-বিদেশি অস্ত্র-গুলি ও গ্রেনেডসহ কয়েকজন আরসা সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ক্যাম্পের ভেতর যে কোন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নির্মূলে ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা। এরই ধারাবাহিকতায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।