০৬:৪৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তায় চার লাখ শিক্ষার্থী

◉ গুচ্ছ ভর্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা, সম্ভাবনা নেই একক ভর্তি পরীক্ষার
◉ গুচ্ছের বাইরে যেতে চায় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়
◉ নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করেছে জবি
◉ অনিশ্চয়তায় ৪ লাখ ভর্তি পরীক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ

শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি লাঘবের উদ্দেশ্যে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে দেশের ১৯টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে শুরু হয়েছিল গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা। পরে একে একে যুক্ত হয়েছিল আরো ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে নানামুখী অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়ের অভাব আর দীর্ঘসূত্রিতার ফলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই এতে আগ্রহ হারিয়েছে। গত তিন বছর ধরেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এই পদ্ধতি থেকে বের হয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছিল। এবার গুচ্ছ থেকে বের হয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। আরো চার থেকে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ও এই পথেই হাঁটছে। এতে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। গত শিক্ষাবর্ষ থেকে সরকার একক ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিলেও তা এবার সম্ভাবনা নেই। এতে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে প্রায় চার লাখ ভর্তি পরীক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ।

এদিকে, রাষ্ট্রপতির অভিপ্রায়ে এবং সরকারের ইচ্ছায় গত শিক্ষাবর্ষ থেকে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের কথা থাকলেও সময় স্বল্পতার কথা বলে গত শিক্ষাবর্ষেও একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করতে পারেনি সরকার। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এবারও একক ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষেও তাই গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করতে চাচ্ছে ইউজিসি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনীহায় তা এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে।
আগে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। এ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের দূরদূরান্তে গিয়ে একাধিক ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো। এতে একদিকে যেমন ভোগান্তিতে পড়তে হতো। তেমন খরচ করতে হতো অনেক বেশি। এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল। এই সমস্যার সমাধানে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথম গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়। এতে অংশ নেয় কৃষি ও কৃষি শিক্ষাপ্রধান সাত বিশ্ববিদ্যালয়। এ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা পরীক্ষা দিতে হয় না। একটি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী তাঁর যোগ্যতা ও পছন্দ অনুযায়ী গুচ্ছে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন।

পরে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে একইভাবে ৩ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ২৪টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা নেয়। কিন্তু রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই আর গুচ্ছ পদ্ধতিতে থাকতে রাজি নয়। গত শিক্ষাবর্ষগুলোতে গুচ্ছ পদ্ধতির নানামুখী অব্যবস্থাপনা, ভোগান্তি ও দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগ তুলে এরই মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়ে তারিখও ঘোষণা করেছে। এই পথে রয়েছে আরো চার থেকে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়। এতে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা।

গত ২১ অক্টোবর উপাচার্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একাডেমিক কাউন্সিলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ভর্তি কমিটি গঠনসহ এরই মধ্যে ভর্তি প্রক্রিয়া ও ভর্তি পরীক্ষার তারিখও ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। গুচ্ছ পদ্ধতিতে নেতৃত্ব দেওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়টি গুচ্ছ পদ্ধতি থেকে সরে যাওয়ায় অনিশ্চয়তা আরো বেড়েছে।
ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও এরই মধ্যে আরো চার থেকে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা থেকে বের হয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের কথা ইউজিসিকে মৌখিকভাবে জানিয়েছে। গত ২৭ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে বৈঠকে বসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা গুচ্ছ পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা তুলে ধরেছেনে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় অসুবিধা তুলে ধরে গুচ্ছ থেকে বের হয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের কথা জানিয়েছে। এতে অনিশ্চয়তা আরো বেড়েছে। গুচ্ছ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনীহা থাকায় এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি মন্ত্রণালয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সভায় উপস্থিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, সভায় গুচ্ছ পদ্ধতি নিয়ে কথা হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নিজেরা ভর্তি পরীক্ষা নিবে সেটা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বের হয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার কথা জানিয়েছে। সভায় কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আরো আলোচনা চলবে। পরীক্ষা হবে কি না অনিশ্চয়তাই রয়ে গেছে।
জানা গেছে, শুধু গুচ্ছভুক্ত ২৪ বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এরই মধ্যে প্রকৌশল গুচ্ছও ভেঙে যাচ্ছে। এ গুচ্ছের তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।
এ ছাড়া কৃষি গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে এককভাবে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিষয়ে এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক কাউন্সিলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

২৭ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভায় উপস্থিত এক উপাচার্য জানান, চলতি শিক্ষাবর্ষেও সরকার গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিতে আগ্রহী। কারণ দেশের চলমান এই পরিবেশে গুচ্ছ থেকে বের হয়ে আলাদাভাবে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব নয়। তাই সরকারের তরফ থেকে এই বিষয়ে ইউজিসি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এটি নিয়েও সভায় আলোচনা হয়েছে।
বৈঠক শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা সিরাজ উদ-দৌলা খান এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, বৈঠকে গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় ভর্তির বিষয়ে বিভিন্ন সুবিধা এবং অসুবিধা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যদের মতামত গ্রহণ করা হয়। সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সর্বজনগ্রাহ্য ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এদিকে গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ায় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে প্রায় চার লাখ ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছে। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা না কাটায় শিক্ষার্থীরা দ্বিধা-দ্বন্দের মধ্যে পড়েছেন। গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হলেও দেরীতে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আবারও দীর্ঘসূত্রিতার আশঙ্কা করছেন তারা। এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না আসায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এককভাবে পরীক্ষা নিবে কিনা সে বিষয়েও দীর্ঘসূত্রিতা ও ভোগান্তির আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম বলেন, এই শিক্ষাবর্ষ থেকে নিজস্ব, স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করাবো। আমাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্নের কাজ এখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে। গুচ্ছ পদ্ধতি স্থায়ী কোনো পদ্ধতি না। সেখানে আমাদের থাকার কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। আমরা আমাদের পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। অংশীজন যেসব বিশ্ববিদ্যালয় আছেন, তাদের সাথে আলোচনা চলছে। মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রণালয়ে উপাচার্যদের নিয়ে একটা সভাও হয়েছে। সেখানে আলোচনা হয়েছে। এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
গুচ্ছ পদ্ধতি থেকে বের হয়ে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি বলেন, এখনও যেহেতু এই পদ্ধতি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তাই এব্যাপারে কিছু বলতে পারছিনা। আলোচনা শেষে যখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে, তখন এবিষয়ে বলা যাবে।
একক ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে ইউজিসির এই সদস্য বলেন, বিগত সরকারের আমলে কি সিদ্ধান্ত হয়েছে না হয়েছে সেটা আমরা ভাবছিনা। আমরা বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভাবছি। এটা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। সরকার থেকেও আমাদের কিছু জানানো হয়নি।

জনপ্রিয় সংবাদ

পরশুরামে টিসিবির পণ্যে নিম্নমানের চাল নিয়ে ভোক্তাদের ক্ষোভ

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তায় চার লাখ শিক্ষার্থী

আপডেট সময় : ০৭:১৮:১০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪

◉ গুচ্ছ ভর্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা, সম্ভাবনা নেই একক ভর্তি পরীক্ষার
◉ গুচ্ছের বাইরে যেতে চায় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়
◉ নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করেছে জবি
◉ অনিশ্চয়তায় ৪ লাখ ভর্তি পরীক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ

শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি লাঘবের উদ্দেশ্যে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে দেশের ১৯টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে শুরু হয়েছিল গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা। পরে একে একে যুক্ত হয়েছিল আরো ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে নানামুখী অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়ের অভাব আর দীর্ঘসূত্রিতার ফলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই এতে আগ্রহ হারিয়েছে। গত তিন বছর ধরেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এই পদ্ধতি থেকে বের হয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছিল। এবার গুচ্ছ থেকে বের হয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। আরো চার থেকে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ও এই পথেই হাঁটছে। এতে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। গত শিক্ষাবর্ষ থেকে সরকার একক ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিলেও তা এবার সম্ভাবনা নেই। এতে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে প্রায় চার লাখ ভর্তি পরীক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ।

এদিকে, রাষ্ট্রপতির অভিপ্রায়ে এবং সরকারের ইচ্ছায় গত শিক্ষাবর্ষ থেকে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের কথা থাকলেও সময় স্বল্পতার কথা বলে গত শিক্ষাবর্ষেও একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করতে পারেনি সরকার। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এবারও একক ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষেও তাই গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করতে চাচ্ছে ইউজিসি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনীহায় তা এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে।
আগে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। এ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের দূরদূরান্তে গিয়ে একাধিক ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো। এতে একদিকে যেমন ভোগান্তিতে পড়তে হতো। তেমন খরচ করতে হতো অনেক বেশি। এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল। এই সমস্যার সমাধানে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথম গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়। এতে অংশ নেয় কৃষি ও কৃষি শিক্ষাপ্রধান সাত বিশ্ববিদ্যালয়। এ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা পরীক্ষা দিতে হয় না। একটি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী তাঁর যোগ্যতা ও পছন্দ অনুযায়ী গুচ্ছে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন।

পরে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে একইভাবে ৩ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ২৪টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা নেয়। কিন্তু রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই আর গুচ্ছ পদ্ধতিতে থাকতে রাজি নয়। গত শিক্ষাবর্ষগুলোতে গুচ্ছ পদ্ধতির নানামুখী অব্যবস্থাপনা, ভোগান্তি ও দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগ তুলে এরই মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়ে তারিখও ঘোষণা করেছে। এই পথে রয়েছে আরো চার থেকে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়। এতে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা।

গত ২১ অক্টোবর উপাচার্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একাডেমিক কাউন্সিলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ভর্তি কমিটি গঠনসহ এরই মধ্যে ভর্তি প্রক্রিয়া ও ভর্তি পরীক্ষার তারিখও ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। গুচ্ছ পদ্ধতিতে নেতৃত্ব দেওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়টি গুচ্ছ পদ্ধতি থেকে সরে যাওয়ায় অনিশ্চয়তা আরো বেড়েছে।
ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও এরই মধ্যে আরো চার থেকে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা থেকে বের হয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের কথা ইউজিসিকে মৌখিকভাবে জানিয়েছে। গত ২৭ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে বৈঠকে বসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা গুচ্ছ পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা তুলে ধরেছেনে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় অসুবিধা তুলে ধরে গুচ্ছ থেকে বের হয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের কথা জানিয়েছে। এতে অনিশ্চয়তা আরো বেড়েছে। গুচ্ছ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনীহা থাকায় এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি মন্ত্রণালয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সভায় উপস্থিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, সভায় গুচ্ছ পদ্ধতি নিয়ে কথা হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নিজেরা ভর্তি পরীক্ষা নিবে সেটা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বের হয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার কথা জানিয়েছে। সভায় কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আরো আলোচনা চলবে। পরীক্ষা হবে কি না অনিশ্চয়তাই রয়ে গেছে।
জানা গেছে, শুধু গুচ্ছভুক্ত ২৪ বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এরই মধ্যে প্রকৌশল গুচ্ছও ভেঙে যাচ্ছে। এ গুচ্ছের তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।
এ ছাড়া কৃষি গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে এককভাবে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিষয়ে এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক কাউন্সিলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

২৭ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভায় উপস্থিত এক উপাচার্য জানান, চলতি শিক্ষাবর্ষেও সরকার গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিতে আগ্রহী। কারণ দেশের চলমান এই পরিবেশে গুচ্ছ থেকে বের হয়ে আলাদাভাবে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব নয়। তাই সরকারের তরফ থেকে এই বিষয়ে ইউজিসি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এটি নিয়েও সভায় আলোচনা হয়েছে।
বৈঠক শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা সিরাজ উদ-দৌলা খান এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, বৈঠকে গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় ভর্তির বিষয়ে বিভিন্ন সুবিধা এবং অসুবিধা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যদের মতামত গ্রহণ করা হয়। সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সর্বজনগ্রাহ্য ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এদিকে গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ায় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে প্রায় চার লাখ ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছে। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা না কাটায় শিক্ষার্থীরা দ্বিধা-দ্বন্দের মধ্যে পড়েছেন। গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হলেও দেরীতে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আবারও দীর্ঘসূত্রিতার আশঙ্কা করছেন তারা। এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না আসায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এককভাবে পরীক্ষা নিবে কিনা সে বিষয়েও দীর্ঘসূত্রিতা ও ভোগান্তির আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম বলেন, এই শিক্ষাবর্ষ থেকে নিজস্ব, স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করাবো। আমাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্নের কাজ এখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে। গুচ্ছ পদ্ধতি স্থায়ী কোনো পদ্ধতি না। সেখানে আমাদের থাকার কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। আমরা আমাদের পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। অংশীজন যেসব বিশ্ববিদ্যালয় আছেন, তাদের সাথে আলোচনা চলছে। মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রণালয়ে উপাচার্যদের নিয়ে একটা সভাও হয়েছে। সেখানে আলোচনা হয়েছে। এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
গুচ্ছ পদ্ধতি থেকে বের হয়ে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি বলেন, এখনও যেহেতু এই পদ্ধতি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তাই এব্যাপারে কিছু বলতে পারছিনা। আলোচনা শেষে যখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে, তখন এবিষয়ে বলা যাবে।
একক ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে ইউজিসির এই সদস্য বলেন, বিগত সরকারের আমলে কি সিদ্ধান্ত হয়েছে না হয়েছে সেটা আমরা ভাবছিনা। আমরা বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভাবছি। এটা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। সরকার থেকেও আমাদের কিছু জানানো হয়নি।