# ভাড়াটে চক্রে কয়েকশ’ ব্যক্তি, স্বর্ণের চালান পাচার হচ্ছে দেশের বাইরে
# ব্যাগেজ রুলসে বছরে দেশে আসছে চার সহস্রাধিক কেজি স্বর্ণ
# চোরাচালান রোধে এয়ারলাইন্সগুলোকে এনবিআরের কঠোর বার্তা
# ব্যাগেজ রুলসের অপব্যবহারে পরিবর্তন হচ্ছে নীতিমালা
# তিনবারের বেশি স্বর্ণ আনলেই অটোমেশনে আটকে যাবে যাত্রী
# আইনটি কার্যকরে বন্ধ হবে ট্যাক্স দিয়ে অবাধে স্বর্ণ আনার প্রবণতা
“কোনও অপরাধে আইনে কঠোর শাস্তির বিধান সেই অপরাধকে দমনে অনেক সহায়ক হবে”
– নাসির উদ্দিন সম্রাট, আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
“চোরাচালানের সিন্ডিকেট ভাঙতে ও অপব্যবহার রোধে ব্যাগেজ রুলসে পরিবর্তন আনা হচ্ছে”
– আব্দুর রহমান খান, চেয়ারম্যান, এনবিআর
এক শ্রেণির যাত্রীরা প্রতিনিয়তই ‘ব্যাগেজ রুলস’ ব্যবহার করে বিদেশ থেকে নিয়মিতই স্বর্ণ নিয়ে দেশে আসছেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্বর্ণ বহন করে আনতে নানা কৌশলও অবলম্বন করেন যাত্রীরা। ব্যাগেজ রুলসের মাধ্যমে দেশে বছরে ৪ সহস্রাধিক কেজি স্বর্ণ আনা হচ্ছে। ট্যাক্স দিয়েই নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ দেশে আনা হলেও সেগুলো বিমানবন্দর থেকেই হাতবদল হয়ে নির্দিষ্ট চক্রের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এভাবে দেশে স্বর্ণ আনতে চক্রটি কোনও কোনও সময় প্রবাসীদেরও ব্যবহার করছে বলে খবর পাওয়া গেছে। মূলত বাংলাদেশকে স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে চক্রটি। দেশের বিমানবন্দর ঘিরে গড়ে উঠেছে স্বর্ণ চোরাচালানের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই চক্রের সদস্যরা প্রতিনিয়তই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে বিমানের কেবিন ক্রু ও বিমানবন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারিকে ব্যবহার করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই চক্রের হোতারা সেই স্বর্ণগুলো পরবর্তী সময়ে চোরাচালানের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশে পাচার করে দিচ্ছেন। ব্যাগেজ রুলসের এই অপব্যবহার ঠেকাতে এতে পরিবর্তন আনার কথা জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আর এটি নিয়ে কাজও শুরু করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। আইনজ্ঞরা বলছেন, কোনও অপরাধে আইনে কঠোর শাস্তির বিধান থাকলে ও কার্যকর করা হলে সেই অপরাধকে দমন করতে অনেক সহায়ক হবে। আইনটি হলে প্রয়োগের পর বোঝা যাবে, এটা চোরাচালান রোধে কতটা সহায়ক হচ্ছে। গতকাল শনিবার কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ও এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিমানবন্দর দিয়ে ব্যাগেজ রুলস ব্যবহার করে দেশে বছরে প্রায় ৪ হাজার কেজির ওপরে স্বর্ণ আসে। সেই হিসাবে গত ৫ বছরে দেশে ২০ হাজার কেজির ওপরে স্বর্ণ এসেছে। তবে এসব স্বর্ণের বড় অংশই হাত বদল হয়ে স্বর্ণ চোরাচালানী চক্রের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ অন্যান্য দেশে। স্বর্ণ আনায়নের ক্ষেত্রে ভাড়া করা লোক ও প্রবাসীদের টার্গেট করে বিমানবন্দর এলাকায় স্বর্ণ চোরাচালানীর শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে। এই চক্রের সদস্য মুনাফারসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার লোভ দেখিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানীতে অন্তর্ভুক্ত করছেন বিমানের কেবিন ক্রুসহ বিমানবন্দরের বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তারা মূলত বাংলাদেশকে স্বর্ণ চোরাচালানীর নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানান, বছরে যে পরিমাণ স্বর্ণ বিমানবন্দর দিয়ে দেশে আনা হচ্ছে, তা কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে নেই। কোনও না কোনোভাবে প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ দেশের বাইরে অন্যান্য দেশে পাচার হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে এবারের এই রুলসের ফলে চোরাচালানে ভাটা পড়বে এটা আশা করা যায়।
জানা যায়, বর্তমান রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই স্বর্ণ চোরাচালানের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ইতোমধ্যে তার নির্দেশ অনুযায়ী এয়ারলাইন্সগুলোকে কঠোর বার্তাও দেওয়া হয়েছে। উড়োজাহাজের ভেতরে মালিকবিহীন স্বর্ণ পাওয়া গেলে বাজেয়াপ্ত করার পাশাপাশি এয়ারলাইন্সের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে। যা নিয়ে আলোচনারও সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি রাজস্ব বোর্ডের এক অনুষ্ঠানে ব্যাগেজ রুলসের বিষয়টি তিনি বলেন, এই আইনও যুগোপোযুগী করা হচ্ছে। কাস্টমসের কাজকর্ম অটোমেশন করা হবে। একই সঙ্গে স্বর্ণ আনার ক্ষেত্রে ব্যাগেজ রুলসও পরিবর্তন করবো। যাতে করে কেউ এই রুলসের অপব্যবহার করতে না পারে। অন্যদিকে ব্যাগেজ রুলসের অপব্যবহার করে দেশে চোরাচালানের শক্ত সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার বিশাল এই সিন্ডিকেটের খোঁজ মেলে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের বৃহৎ এই বিমানবন্দর-কেন্দ্রিক কয়েকশ’ ব্যক্তি যারা নিয়মিত দুবাই ও সৌদি গিয়ে স্বর্ণ নিয়ে আসেন। ব্যাগেজ রুলসের অপব্যাবহার করে সিন্ডিকেটের সদস্যরাও স্বর্ণগুলো তাদের মহাজনের হাতে তুলে দেন। ট্যাক্স, বিমানভাড়া বাদেও একটি স্বর্ণের বারের জন্য তারা ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পান। বিশেষ করে ঢাকার অদূরে মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুর-কেন্দ্রিক এদের অবস্থান সবচেয়ে বেশি। এমন পন্থায় বাহক ব্যবহার করে অনেকেই স্বর্ণ পাচার করে শত শত কোটি টাকার মালিকও হয়েছেন।
শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মিনহাজ উদ্দিন বলেন, এনবিআরের পক্ষ থেকে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তা অত্যান্ত যুগোপোযুগী। এতে করে দেশে স্বর্ণের চোরাচালান অনেকটাই বন্ধ হয়ে যাবে। গত কয়েক বছরে দেশে যে পরিমাণ স্বর্ণ এসেছে, তার বিশাল অংশই দেশের বাইরে চলে গেছে বলে আমরা মনে করি। এই রুলসের ফলে দেশে অবাধ স্বর্ণ আসা বন্ধ হয়ে যাবে।
ঢাকা কাস্টমস হাউসের যুগ্ম কমিশনার মো. আল-আমিন বলেন, বর্তমান ব্যাগেজ রুলসে একজন ব্যক্তি একটি করে স্বর্ণের বার আনার বিধান রয়েছে। তাতে একটি বারের ১১৬/১১৭ গ্রাম ওজনের বারে ৪০ হাজার টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। এই রুলসে একটি করে স্বর্ণের বার আনার বিধান থাকলেও একজন যাত্রী কতবার কিংবা বছরে কতবার আনতে পারবেন, তা নির্দিষ্ট করে উলে¬খ নেই। আর এ কারণে বন্দর-কেন্দ্রিক এক শ্রেণির ফ্রিকোয়েন্ট যাত্রী হয়ে গেছেন, যাদের কাজই হলো দুবাই বা সৌদি গিয়ে স্বর্ণের বার আনা। তিনি বলেন, ‘আমাদের জানা মতে, এই স্বর্ণগুলো দেশে থাকছেই না। এক শ্রেণির মহাজন আড়ালে থেকে ভাড়া করা লোকদের দিয়ে স্বর্ণ আনার কাজ করে থাকেন। পরবর্তী সময়ে সেই স্বর্ণগুলো নানা কৌশলে দেশের বাইরে পাচার করে দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকেও এ ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। আর এ কারণে ব্যাগেজ রুলসে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা আরও বলেন, এবার ব্যাগেজ রুলসে নিয়ম করে দেওয়া হচ্ছে, এই নিয়ম ব্যবহার করে একজন যাত্রী বছরে কতবার স্বর্ণ আনতে পারবেন। এছাড়াও আমরা একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করা হচ্ছে, যেখানে এই স্বর্ণ আনা যাত্রীদের তথ্য থাকবে। অর্থাৎ ওই যাত্রী শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়াও যে কোনও বন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করলেও তার তথ্য অটোমেটিক আমাদের সফটওয়্যারে জমা হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একজন যাত্রী কতবার স্বর্ণ আনতে পারবেন, এখনও তা নির্দিষ্ট হয়নি। তবে এটি নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। এরকম হতে পারে, একজন যাত্রী বছরে সর্বোচ্চ তিন বার ব্যাগেজ রুলসের আওতায় স্বর্ণ আনতে পারবেন। এর বেশি হলেই ওই যাত্রী অটোমেটিক আটক হয়ে যাবে। কেননা তার তথ্য আগে থেকেই সংরক্ষিত থাকছে। এ রকম কয়েকবার ঘটলে তার বিদেশ যাওয়াও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
ব্যাগেজ রুলস পরিবর্তনে স্বর্ণ চোরাচালানে কতটা প্রভাব পড়বে, এমন প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাসির উদ্দিন সম্রাট বলেন, যে কোনও অপরাধে আইনে কঠোর শাস্তির বিধান সেই অপরাধকে দমনে অনেক সহায়ক হয়। কাস্টমসের এই আইন তারা করছেন নিশ্চয় এর পেছনে অনেক যুক্তি রয়েছে। একজন যাত্রী বর্তমান রুলসকে কাজে লাগিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ছেন। সব জেনে-শুনেও তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না, এটা একটা কেমন ব্যাপার। এবার যেহেতু নতুন রুলস হচ্ছে, সেহেতু জবাবদিহির একটা জায়গা তৈরি হলো। জবাবদিহি থাকলে সেখানে আইন মানার বিষয় থাকে। তিনি বলেন, ‘আইনটি হলে প্রয়োগের পর বোঝা যাবে, এটা চোরাচালান রোধে কতটা সহায়ক।






















