- জনসংখ্যায় অর্ধেক হলেও ভূমি অংশীদারিত্ব নারীদের সীমিত
- প্রচলিত আইনে সম্পত্তির অধিকার থেকেও বঞ্চিত নারীরা
- ৯৬ শতাংশ ভূমি কেনা-বেচা বা তালিকাভুক্তিতে নাম থাকে না নারীদের
দেশে জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হলেও ভূমির মালিকানায় তাদের অংশীদারিত্ব অত্যন্ত সীমিত। ভূমি শুধু আর্থিক বা বাসস্থানের বিষয় নয় এটি ক্ষমতার প্রতীক, নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদার উৎস হিসেবে দেখা হয়। নারীদের ভূমি অধিকারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা তাদের সামগ্রিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের অন্যতম উপাদান। দেশে প্রচলিত আইনে নারীরা যে সম্পত্তি প্রাপ্তির অধিকার রাখেন তা থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হন। দেশে ৯৬ শতাংশ ভূমি কেনা-বেচা বা তালিকাভুক্তিতে নাম থাকে না নারীদের। বিশে¬ষকরা বলছেন, ভাইয়ের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য দেশের অধিকাংশ নারীই পিতার মৃত্যুর পর ভাইয়ের কাছে উত্তরাধিকার সম্পত্তির দাবিই করেন না। তবে নির্দিষ্ট সময় পর প্রাপ্য সম্পত্তির দাবি করলে তা পেতেও ভোগান্তি পোহাতে হয়। আবার যারা দাবি করেন, তাদের অনেকেই নিজের ভাই এবং তার পরিবারের সদস্যদের দ্বারা অপমান, লাঞ্ছনা ও শারীরিক নির্যাতনের শিকারও হন। অর্থের টানের সম্পর্কও নষ্ট হয়ে যায়।
সংশি¬ষ্ট বিভিন্ন তথ্য বিশ¬ষণ করে দেখা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নারী-পুরুষ আইনের চোখে সমান হলেও, অনেক নারী ভূমি মালিকানা বা দখলে যুক্ত হতে পারেন না। মুসলিম ব্যক্তিস্বত্ব আইনে এক মেয়ে ছেলে থেকে অর্ধেক পায়; বিধবা স্বামীর ভাগ থেকে ১-এর ৪ ভাগ অথবা ১-এর ৮ ভাগ পায়। এ ছাড়া সংখ্যালঘু (হিন্দু) কুমারী নারীদের সম্পত্তি উত্তরাধিকার জীবন্ত অবস্থায় প্রাপ্য নয়। এদিকে ৯৬ শতাংশ ভূমি কেনা-বেচা বা তালিকাভুক্তিতে নারীর নাম থাকে না। গ্রামীণ নারীর মালিকানা মাত্র ২ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ জমির প্রকৃত মালিকানা না পাওয়ার বঞ্চনার পাশাপাশি নারী জমিসংক্রান্ত যেকোনো সহিংসতার শিকারও হচ্ছেন। জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রাণহানি, বাড়িঘরে আগুন দেওয়া, হামলা, গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, আহত মানুষের সংখ্যা এবং মামলার সংখ্যা আমাদের দেশে আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অহরহ সংঘটিত ভূমিসংক্রান্ত জটিলতা নারীর নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলছে। ভূমি বিরোধের জেরে নারীরা শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সব ধরনের নিপীড়ন ও সহিংস নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে জমি নিয়ে বিরোধে সহিংসতা, প্রাণহানি, আহত মানুষের সংখ্যা ও মামলা বাড়ছে। দেশের প্রায় ৫০ লাখ পরিবার সরাসরি জমিসংক্রান্ত বিরোধের মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া ৬ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার ভবিষ্যতে জমি নিয়ে বিরোধের আশঙ্কায় রয়েছে। আদালতে জমিসংক্রান্ত প্রায় ১৪ লাখ মামলা অমীমাংসিত। মামলা চালাতে গিয়ে পরিবারগুলো সর্বস্বান্ত হয়। মামলাগুলো মীমাংসা হতে কয়েক প্রজন্ম চলে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ প্রকাশিত ‘জেন্ডার স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ ২০১৮’ রিপোর্ট থেকে জানা যায়, শহরের চেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন গ্রামের নারীরা, আর তারা আক্রান্ত হচ্ছেন মানসিক রোগে। নির্যাতিত নারীদের মধ্যে মধ্যবয়সী নারীই বেশি। জীবনে অন্তত একবার মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, দেশে এমন নারী ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি গ্রামে ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ। শহরে এ হার ২৫ দশমিক ৪।
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক এস এম মাসুম বিল¬াহ বলেন, জমি নিয়ে সহিংসতার জেরে বলি হচ্ছেন নারীরা। এর বিশেষ কিছু লক্ষণীয় দিক হলো আইন ও বাস্তবতার মধ্যে ফারাক। ইসলামি উত্তরাধিকার আইন বা পারিবারিক আইন নারীকে কিছু অংশ জমির মালিকানা দিলেও বাস্তবে ভাইদের, স্বামী পক্ষের বা স্থানীয় প্রভাবশালীদের বাধার মুখে নারী অনেক সময় সেই মালিকানা আদায় করতে পারেন না। চলমান সমস্যা সমাধানের জন্য যে বিষয়গুলো গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন তার মধ্যে আইন প্রয়োগে জোর; উত্তরাধিকার ও পারিবারিক সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন, ভূমি অফিস ও ইউনিয়ন পরিষদকে নারী-সহায়ক নীতি অনুসরণ করতে হবে। আইনি সহায়তা প্রসার; লিগ্যাল এইড, ক্লিনিক্যাল লিগ্যাল এডুকেশন (সিএলই) এবং এনজিওগুলোর মাধ্যমে নারীকে সহায়তা দেওয়া দরকার। সচেতনতামূলক প্রচার; ধর্মীয়, সামাজিক ও জনপ্রিয় মাধ্যম ব্যবহার করে নারী সম্পত্তির অধিকার বিষয়ে জনমত তৈরি করা।
এ বিষয়ে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মোমিনুর রশীদ বলেন, জমি এবং জমির ওয়ারিশসংক্রান্ত যে জটিলতা বিদ্যমান তার জন্য ভূমি আইন আধুনিকীকরণ ও ডিজিটালাইজেশনের কোনো বিকল্প নেই। জমির মালিকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তার ওয়ারিশদের মধ্যে ন্যায্যতার ভিত্তিতে অটোমেটিক পদ্ধতিতে জমি বণ্টন হলে জমি নিয়ে জটিলতা অনেকাংশে সমাধান সম্ভব হবে। মামলা বা বিরোধ যেমন কমে যাবে, একই সঙ্গে ছেলে-মেয়ে বা নারী-পুরুষ সদস্যরা প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের অংশ তৎক্ষণাৎ বুঝে পাবেন। অনেকে তো একাই নানা কৌশল এবং বল প্রয়োগ করে পুরো সম্পত্তি দখলে নিতে চায়। তারা দেশের প্রচলিত ভূমি আইন বা আইন কোনোটার তোয়াক্কা করে না।






















