- বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির দুটিতে দ্বিধাবিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলো
- প্রধানমন্ত্রী নিয়ে সিদ্ধান্তে একমত বিএনপি, এনসিসিতে দ্বিমত
- গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার উপস্থাপন করতে বুকলেট প্রকাশ
জাতীয় সনদ তৈরিতে সব পক্ষকে ছাড় দিতে হবে : ড. আলী রীয়াজ
সংস্কার ইস্যুতে দ্বিতীয় পর্যায়ে দফায় দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের করা সুপারিশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি রাজানৈতিক দলগুলো। বিভিন্ন ইস্যুতে এখনো আছে দ্বিধা-বিভক্তি। বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির মধ্যে দুটির সংশোধনীতে দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। বিদ্যমান চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র নিয়ে তেমন বিরোধ না থাকলেও অপর দুটি সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে ডান ও বাম দলগুলোর। এদিকে, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন সংবিধানে এমন বিধান যুক্ত করার বিষয়ে একমত হয়েছে বিএনপি। তবে সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনে দলটির আপত্তি রয়েছে। এদিকে, অন্তর্র্বর্তী সরকারের বিভিন্ন খাতে গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক উদ্যোগসমূহ উপস্থাপন করতে বুকলেট প্রকাশ করেছে সরকার। এদিকে, জাতীয় সনদ তৈরিতে সবার পক্ষ থেকে ছাড় দিতে হবে। এমনটি হলে জুলাই আন্দোলনের মতো সনদ তৈরিতেও ঐকমত্যে পৌঁছা সম্ভব বলে আশা করা যায় বলে জানিয়েছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ।
জানা গেছে, গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ষষ্ঠ দিনের আলোচনায় অংশ নেয় বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। মধ্যাহ্নে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এদিকে, বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির মধ্যে দুটির সংশোধনীতে দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। বিদ্যমান চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র নিয়ে তেমন বিরোধ না থাকলেও অপর দুটি সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে ডান ও বাম দলগুলোর। ডান দলগুলোর যুক্তি, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হিসেবে সংবিধানে এ দুটি মূলনীতি থাকতে পারে না। অপরদিকে বাম দলগুলোর অভিমত এই চার মূলনীতির সঙ্গে প্রয়োজনে নতুন কিছু সংযুক্ত করতে তাদের আপত্তি নেই। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে জড়িত ৭২-এর সংবিধানে হাত দেওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া কমিশনের বৈঠকের অগ্রগতি নিয়েও হতাশা ব্যক্ত করেছে কোনো কোনো দল। অবশ্য জামায়াত ও সিপিবিসহ কয়েকটি বামদল এ বিষয়ে বক্তব্য রাখলেও বিএনপি এবং এনসিপি এ ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত মন্তব্য করেনি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিমের সংযোজন করতে হবে। আর সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে সাম্য ও মানবিক মর্যাদার বিষয়টি সংযোজনের দাবি জানান তিনি। তার দাবি, সিপিবি ও দুই-একটি বাম দল ছাড়া বেশিরভাগ দলই এর সঙ্গে একমত। এছাড়া লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি দল ৭২-এর সংবিধান সংশোধনের বিপক্ষে মত দিয়েছে। বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনের বিষয়ে একমত হওয়া যায়নি। যেহেতু বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই আমরা মনে করি, এ বিষয়ে আরও আলোচনা হতে হবে। এছাড়া গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকি, বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজও সংবিধানের মূলনীতি সংশোধনের বিপক্ষে মতামত তুলে ধরেন।
এদিকে, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন সংবিধানে এমন বিধান যুক্ত করার বিষয়ে একমত হয়েছে বিএনপি। তবে সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনে দলটির আপত্তি রয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী মেয়াদ সীমা নিয়ে নানা মত উঠে এলেও বিএনপি স্থায়ী কমিটি শেষমেশ একমত হয়েছে যে, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুই পূর্ণ মেয়াদ অর্থাৎ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকতে পারবেন। অন্যদিকে নারীদের জন্য সংসদে ১০০ আসন, সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা ১০০ জন এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতম দুইজনের মধ্যে একজনকে নিয়োগের বিষয়ে বিএনপি সম্মতি জানিয়েছে। তবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের বিষয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতারা মনে করেন, এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং এ প্রস্তাবে তারা একমত নন।
এদিকে, অন্তর্র্বতী সরকারের বিভিন্ন খাতে গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক উদ্যোগসমূহ উপস্থাপন করতে বুকলেট প্রকাশ করেছে সরকার। গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, বুকলেটটি অন্তর্র্বর্তী সরকারের বিভিন্ন খাতে গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক উদ্যোগসমূহ উপস্থাপন করে। এসব সংস্কার অন্তর্র্বর্তী সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের প্রতি অঙ্গীকারের প্রতিফলন। এ সংকলনটি ১৫ জুন ২০২৫ পর্যন্ত সময়ের একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে, যা একটি চলমান ও বিকাশমান প্রক্রিয়ার অংশ। এটি কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা নয় বরং একটি জীবন্ত দলিল যা সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতি ও নতুন উদ্যোগ অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত হালনাগাদ করা হবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, জাতীয় সনদ তৈরিতে সবার পক্ষ থেকে ছাড় দিতে হবে। এমনটি হলে জুলাই আন্দোলনের মতো সনদ তৈরিতেও ঐকমত্যে পৌঁছা সম্ভব বলে আশা করা যায়। সবার মনে রাখতে হবে আমরা রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। ১৬ বছরের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের পর নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। সবাই মিলে লড়াই করতে না পারার কোনও বিষয় নেই। এখানে আমরা যেভাবে পরমত সহিষ্ণুতা বজায় রেখে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছি, সবক্ষেত্রেই সবাইকে সেভাবে অগ্রসর হতে হবে। জুলাইয়ের আগেই ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা শেষ করতে চান। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা প্রয়োজন।

























