- ইরানের ছোড়া ৫৯১টি ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে ইসরায়েলে আঘাত হানে ৫০টি
- ইরানের পাঠানো ১,০৫০ ড্রোনর মধ্যে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে প্রবেশ করে ৫৭০টি
- ইসরায়েল ইরানের ১,৪৮০টিরও বেশি সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে
- হামলা চলাকালীন ইসরায়েলে সাইরেন বাজে ২০ হাজার বার
- ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে ইসরাইলের ক্ষতি ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
১২ দিনের সংঘাতে ইরান ও ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক খতিয়ান ও সার্বিক বিবরণ প্রকাশ করেছে তুরস্কের সংবাদ সংস্থা আনাদোলু। এ সময় ইরান যে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল, তার মধ্যে অন্তত ৫০টি ইসরায়েলের উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করে সরাসরি দেশটির বিভিন্ন স্থানে আঘাত হেনেছে। এই সংঘাত শুরু হয়েছিল ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ইরানের ওপর হামলার মাধ্যমে, যার প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা জবাব দেয় তেহরান। পরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় গত ২৪ জুন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। দুই পক্ষের ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত এখন প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।
ইসরায়েল এই পুরো সময়কালজুড়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ওপর কড়া সেন্সরশিপ আরোপ করে, যার ফলে দেশটির সামরিক ও নিরাপত্তা স্থাপনায় আঘাত সংক্রান্ত ছবি বা বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ বন্ধ রাখা হয়। ফলে ইসরায়েলের সামরিক ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র এখনও অস্পষ্ট। তেল আবিবভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্যাডিজ জানায়, ইসরায়েলের সেনাবাহিনী, জরুরি সেবা সংস্থা মেগান ডেভিড এ্যাডম এবং স্বাস্থ্য, কল্যাণ ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইরান ইসরায়েলের দিকে মোট ৫৯১টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, যার অন্তত ৫০টি সরাসরি লক্ষ্যভেদ করে। এছাড়া ইরান ১,০৫০টিরও বেশি ড্রোন পাঠায়, যার মধ্যে ৫৭০টি ইসরায়েলের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। তবে শুধু একটি ড্রোনই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়িয়ে যায় বলে দাবি করা হয়।
এই হামলা চলাকালীন দেশব্যাপী প্রায় ১৯ হাজার ৫০০ বার সাইরেন বাজানো হয় এবং ইসরায়েল দাবি করে যে তারা ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ৯৯ শতাংশ ড্রোন প্রতিহত করেছে। ইরানের এই হামলায় ইসরায়েলে ২৯ জন নিহত হয় এবং ৩ হাজার ৪৯১ জন আহত হন, যাদের মধ্যে অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় আহত হন বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। লক্ষ্যবস্তু এলাকা থেকে প্রায় ১১ হাজার জনকে সরিয়ে নেয়া হয় এবং কর্তৃপক্ষের কাছে ৩৮ হাজারেরও বেশি ক্ষয়ক্ষতির অভিযোগ জমা পড়ে। জবাবে ইসরায়েলি বাহিনী ইরানে ১,৪৮০টিরও বেশি সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়। ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী, এই হামলায় ইরানের ২০টি যুদ্ধবিমান, প্রায় এক হাজার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ডজনখানেক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপক (মিসাইল লঞ্চার) ধ্বংস করা হয়। তেহরান, তাবরিজ, কেরমানশাহ, লোরেস্তান ও মাশহাদসহ ইরানের অন্তত ২০টি শহরে বিমান হামলা চালানো হয়।
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এসব হামলায় ৬২৭ জন নিহত এবং কমপক্ষে চার হাজার ৮৭০ জন আহত হন।নিহতদের মধ্যে ইরানের অন্তত ২৫ জন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মোহাম্মদ বাঘেরি এবং আইআরজিসির অ্যারোস্পেস কমান্ডার আমির আলি হাজিজাদে। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের গুপ্তচররা এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং তাদের বেশ কয়েকটি অভিযানের ভিডিও প্রকাশ করে, যা নজিরবিহীন। ইরান ১১ জন পারমাণবিক বিজ্ঞানীর মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করলেও ইসরায়েল দাবি করে এই সংখ্যা ১৫ জনেরও বেশি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যৌথভাবে ইরানের ফোরদো, নাতানজ এবং ইসফাহান অঞ্চলের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালায়। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানায়, ফোরদো কেন্দ্রটি অকার্যকর হয়ে পড়েছে এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি উল্লেখযোগ্যভাবে পিছিয়ে গেছে।
সামরিক স্থাপনার বাইরেও ইসরায়েল ইরানের অবকাঠামোতে হামলা চালায়, যার মধ্যে ছিল রেড ক্রিসেন্ট, তেহরানের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, একটি বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্র এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের আটক রাখা এভিন কারাগার। ইরান জানায়, ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে ৭০০ জনের বেশি মানুষকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া ইরান দাবি করে, তারা হাজার হাজার ড্রোন ও ইউএভি (কামিকাজে মডেলসহ) জব্দ করেছে এবং গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে পূর্বে দণ্ডপ্রাপ্ত ৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। তেহরান আরও জানায়, তারা ইসরায়েলের তিনটি হার্মেস ড্রোন ও একটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। তবে ইসরায়েল এখনও এফ-৩৫ ধ্বংসের দাবি নিশ্চিত করেনি। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও এখনো ইরানের কিছু অঞ্চলে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে, এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সচল রয়েছে। ড্রোন দেখা যাওয়ার ঘটনাও অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে, ইরানের বিরুদ্ধে ১২ দিনের আগ্রাসী যুদ্ধে ইসরাইলের আনুমানিক ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সরাসরি ক্ষতি হয়েছে। সামগ্রিক ক্ষতি ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাতে পারে বলে ইসরাইলি গণমাধ্যম ও অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ইরানি গণমাধ্যম প্রেস টিভি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। এই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে সামরিক ব্যয়, ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিপূরণ এবং অবকাঠামো মেরামতের খরচ। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, পরোক্ষ অর্থনৈতিক প্রভাব এবং বেসামরিকদের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত দাবি যুক্ত হলে মোট ক্ষতির পরিমাণ ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাতে পারে। ইসরাইলি দৈনিক ইয়েদিওথ আহরোনোথ-এর মতে, যুদ্ধের কারণে এখন পর্যন্ত ইসরাইলি কোষাগারে ২২ বিলিয়ন শেকেল (৬৪৬ কোটি ডলার) ক্ষতির চাপ পড়েছে। ইসরাইলি সেনাবাহিনী অস্ত্র মজুত পুনরায় পূরণ, বাড়তি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা এবং রিজার্ভ ইউনিট সচল রাখতে অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন শেকেল (১১৭০ কোটি ডলার) চেয়েছে। এর আগে যুদ্ধের আগেই ১০ ও পরে ৩০ বিলিয়ন শেকেল বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। গাজা যুদ্ধের সময় থেকেই সৃষ্ট ঘাটতির উপর ভিত্তি করে যুদ্ধ ব্যয়ের কারণে ইসরাইল বাজেট ঘাটতি প্রায় ৬ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক মন্দা ও কর আদায়ের পরিমাণ কমে যাওয়ার পূর্বাভাসও রয়েছে, যেখানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে অন্তত ০.২ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা।
অবৈধ ইহুদিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের বিজয় :
ইরানের সুপ্রিম নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বলেছেন, অবৈধ ইহুদিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের বিজয় হয়েছে। খামেনি তার এক্স অ্যাকাউন্টে ইসরাইলকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, অবৈধ ইহুদিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে বিজয়ের জন্য আমি সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
বিশ্বের আর কোনো সামরিক বাহিনী তা পারত না :
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে ব্যাপক, সুনির্দিষ্ট হামলা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের আর কোনো সামরিক বাহিনী তা করতে পারত না এবং এখন আমেরিকান শক্তির এই অসাধারণ চর্চা শান্তির পথ খুলে দিয়েছে।’ গত বুধবার নেদারল্যান্ডসে আয়োজিত ন্যাটো সম্মেলনে এসব কথা বলেন ট্রাম্প। তিনি জানিয়েছেন, ইরানের সাথে আগামী সপ্তাহেই আলোচনা করতে যাচ্ছেন। বিবিসি এ তথ্য দিয়েছে। ট্রাম্প বলেন, ‘তারা (ইরান) একটি যুদ্ধে ছিল, তারা লড়াই করেছে এবং এখন তারা নিজেদের জগতে ফিরে গেছে। কোনো সমঝোতা হলো কি-না তা আমি কেয়ার করি না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।’ ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, শুধু ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনাই যুক্তরাষ্ট্রের হামলার একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। তিনি বলেন, ‘আরও দুটি টার্গেট ছিল যেগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি এবং সেগুলোতে শত শত মাইল দূরের সাবমেরিন থেকে হামলা করা হয়।’ ট্রাম্প জানান, কাতারের মার্কিন ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে ইরানের ছোঁড়া ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্রের সবকটিই ভূপাতিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ইরান মাত্রই একটি যুদ্ধে ছিল এবং তারা সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছে।
























