০২:১৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ভাই হারানোর দুঃখ নিয়ে মাঠে নামবেন ঋতুপর্ণা

ঋতুপর্ণা চাকমার স্নিগ্ধ হাসিটা সংক্রামকের মতো। এই মিষ্টি হাসি যে কারও মন খারাপের বেসুরো রংটা ভুলিয়ে দিতে বাধ্য। অথচ সেই ঋতুই মনের মধ্যে একটা দুঃখ বয়ে বেড়ায় সারাক্ষণ। তার মিস্টি হাসির পেছনে কতটা কষ্ট লুকানো, সেটা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। ফুটবল খেলে সেই দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করেন। রবিবার ইয়াঙ্গুনে যখন এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে বাহরাইনের বিপক্ষে মাঠে নামবেন নিশ্চয় মনের ভেতরের পুষে রাখা যন্ত্রণাটা ফুটবলের আনন্দে ভুলতে চাইবেন।
২০২২ সালের ২৯ জুন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান ঋতুপর্ণার ছোটভাই পার্বণ। যাকে আদর করে সিজি নামে ডাকতেন। ভাই হারানোর শোক কাটানো বড়োই কষ্ট ঋতুপর্ণার। সেই কষ্ট ভুলেই রবিবার মাঠে নামবেন।
নিজের ফেসবুক পেজে ভাইয়ের স্মৃতি মনে করে রবিবার একটা পোস্ট দিয়েছেন তিনি। যেখানে লিখেছেন, “আজ তোর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তিন বছর হয়ে গেল তুই আমাদের ছেড়ে চলে গেছিস। সিজি তোকে বড্ড ভালোবাসি রে। তোকে ভীষণ মিস করি।”
এরপর লিখেছেন, “আমার ভাইয়ের আত্মার শান্তির জন্য সবাই প্রার্থনা করবেন।”
ঋতুপর্ণার বাবা ব্রজবাসী চাকমা ক্যানসারে ভুগে মারা গেছেন ২০১৫ সালে। বড় তিন বোন—ভারতী চাকমা, পামপি চাকমা ও পুতুলি চাকমার বিয়ে হয়ে গেছে। চার বোনের এক ভাই হওয়ায় সবচেয়ে আদরের ছিলেন পার্বণ। সেই আদরের ভাইকে হারিয়ে তখন প্রচন্ড ভেঙে পড়েন ঋতুপর্ণা।
পার্বণের দুই বছরের বড় ঋতুপর্ণা। পিঠেপিঠি ভাই–বোন হওয়ায় দুজনের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। ২০১৭ সালে জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে ডাক পাওয়ার পর থেকে ঋতুপর্ণার সব ম্যাচ দেখেছেন পার্বণ।

সর্বশেষ সাফে নেপালের কাঠমান্ডুতে পাকিস্তানের বিপক্ষে গোলের পর তাই সবার আগে ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়েছিল ঋতুপর্ণার। তখন তিনি বলেছিলেন, “ভাইকে কখনো ভুলতে পারি না। প্রতি সেকেন্ডে মনে পড়ে। মনে হয় এখনো আমার পাশে আছে ও। গোল করার পর অনেক কেঁদেছি। মাঠে নামার আগে একটা জেদ ছিল, যেভাবেই হোক গোল পেতে হবে। ভাইকেই গোলটা উৎসর্গ করেছি।”
ঋতুপর্ণার কণ্ঠে সব সময়ই ঝরে আফসোস, “যদি গোলটা দেখত ভাই, ম্যাচ শেষেই ফোন দিত। অনূর্ধ্ব-১৯ সাফের পর বলেছিল, “দিদি, তুই তো ভাইরাল হয়ে গেছিস। সেলিব্রিটি হয়ে গেছিস।”’
ঋতুপর্ণার সঙ্গে শেষবার পার্বণের কথা হয় ২০২২ সালের ২৮ জুন। ২৩ ও ২৬ জুন মালয়েশিয়ার বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচ শেষ হওয়ার পর জাতীয় দলের ক্যাম্প ছুটি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। ঋতুপর্ণা ২৯ জুন রাঙামাটির উদ্দেশে ঢাকা থেকে বাসে রওনা দেন। সেদিন কেন জানি অজানা আশঙ্কা মনের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল তাঁর, “ও সাধারণত আমাকে কম ফোন করে। সেদিন ফোন করে বলেছিল, “দিদি, তুই কবে আসবি?
দুই ভাই–বোনের এক সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নেওয়ার কথা ছিল। এ জন্য পরদিন বাসের টিকিট কাটেন। বাসে বসে কেমন যেন অস্থির লাগছিল ঋতুপর্ণার। আগের রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন। রুমমেট তহুরা খাতুনকে ক্যাম্প ছেড়ে আসার আগে বলেছিলেন, ক্ষমা করে দিস।
ঋতুপর্ণা যখন বাড়ির পথে, দুর্ঘটনাটা ঘটে তখন। কিন্তু পথের মধ্যে থাকায় তাঁকে দুঃসংবাদ জানানো হয়নি। বাড়িতে গিয়ে জানতে পারেন নির্মম সত্য।
ফুটবল খেলার সুবাদে অনেক দেশে গেছেন ঋতুপর্ণা। প্রতিবারই দেশে ফেরার সময় ভাইয়ের পছন্দের চকলেট নিয়ে আসতেন। ইদানিং কারও জন্যই চকলেট কেনা হয় না ঋতুপর্ণার।
মা বোজোপতি চাকমার জন্য বেশি কষ্ট হয় ঋতুপর্ণার, “বোনদের তো বিয়ে হয়ে গেছে। আমি খেলার জন্য বাড়ির বাইরে থাকি। বাড়ি ছেড়ে আসার সময় নিজের আবেগ আটকে রাখতে পারি না। মায়ের সামনে কাঁদতে চাই না। কিন্তু হু হু করে কান্না চলে আসে। মা বড্ড একা।”
ভাই হারানোর কষ্টটা ভুলতে চান ঋতুপর্ণা ফুটবল মাঠে। জীবন আসলে কারও জন্য থেমে থাকে না। জীবন থেমে থাকে না বলেই ঋতুপর্ণা কাঁদেন, আবার দলকে জিতিয়ে হাসেন।
বাহরাইনের বিপক্ষেও নিশ্চয় ঋতুপর্ণার গোলে হাসবে বাংলাদেশ। আর অলক্ষ্যে ঋতুপর্ণা নিজেই কাঁদবেন। ভাইটি যে তার খুবই প্রিয় ছিল!

 

বিএম/সব

জনপ্রিয় সংবাদ

ভাই হারানোর দুঃখ নিয়ে মাঠে নামবেন ঋতুপর্ণা

আপডেট সময় : ০১:৫৮:৫০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

ঋতুপর্ণা চাকমার স্নিগ্ধ হাসিটা সংক্রামকের মতো। এই মিষ্টি হাসি যে কারও মন খারাপের বেসুরো রংটা ভুলিয়ে দিতে বাধ্য। অথচ সেই ঋতুই মনের মধ্যে একটা দুঃখ বয়ে বেড়ায় সারাক্ষণ। তার মিস্টি হাসির পেছনে কতটা কষ্ট লুকানো, সেটা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। ফুটবল খেলে সেই দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করেন। রবিবার ইয়াঙ্গুনে যখন এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে বাহরাইনের বিপক্ষে মাঠে নামবেন নিশ্চয় মনের ভেতরের পুষে রাখা যন্ত্রণাটা ফুটবলের আনন্দে ভুলতে চাইবেন।
২০২২ সালের ২৯ জুন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান ঋতুপর্ণার ছোটভাই পার্বণ। যাকে আদর করে সিজি নামে ডাকতেন। ভাই হারানোর শোক কাটানো বড়োই কষ্ট ঋতুপর্ণার। সেই কষ্ট ভুলেই রবিবার মাঠে নামবেন।
নিজের ফেসবুক পেজে ভাইয়ের স্মৃতি মনে করে রবিবার একটা পোস্ট দিয়েছেন তিনি। যেখানে লিখেছেন, “আজ তোর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তিন বছর হয়ে গেল তুই আমাদের ছেড়ে চলে গেছিস। সিজি তোকে বড্ড ভালোবাসি রে। তোকে ভীষণ মিস করি।”
এরপর লিখেছেন, “আমার ভাইয়ের আত্মার শান্তির জন্য সবাই প্রার্থনা করবেন।”
ঋতুপর্ণার বাবা ব্রজবাসী চাকমা ক্যানসারে ভুগে মারা গেছেন ২০১৫ সালে। বড় তিন বোন—ভারতী চাকমা, পামপি চাকমা ও পুতুলি চাকমার বিয়ে হয়ে গেছে। চার বোনের এক ভাই হওয়ায় সবচেয়ে আদরের ছিলেন পার্বণ। সেই আদরের ভাইকে হারিয়ে তখন প্রচন্ড ভেঙে পড়েন ঋতুপর্ণা।
পার্বণের দুই বছরের বড় ঋতুপর্ণা। পিঠেপিঠি ভাই–বোন হওয়ায় দুজনের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। ২০১৭ সালে জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে ডাক পাওয়ার পর থেকে ঋতুপর্ণার সব ম্যাচ দেখেছেন পার্বণ।

সর্বশেষ সাফে নেপালের কাঠমান্ডুতে পাকিস্তানের বিপক্ষে গোলের পর তাই সবার আগে ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়েছিল ঋতুপর্ণার। তখন তিনি বলেছিলেন, “ভাইকে কখনো ভুলতে পারি না। প্রতি সেকেন্ডে মনে পড়ে। মনে হয় এখনো আমার পাশে আছে ও। গোল করার পর অনেক কেঁদেছি। মাঠে নামার আগে একটা জেদ ছিল, যেভাবেই হোক গোল পেতে হবে। ভাইকেই গোলটা উৎসর্গ করেছি।”
ঋতুপর্ণার কণ্ঠে সব সময়ই ঝরে আফসোস, “যদি গোলটা দেখত ভাই, ম্যাচ শেষেই ফোন দিত। অনূর্ধ্ব-১৯ সাফের পর বলেছিল, “দিদি, তুই তো ভাইরাল হয়ে গেছিস। সেলিব্রিটি হয়ে গেছিস।”’
ঋতুপর্ণার সঙ্গে শেষবার পার্বণের কথা হয় ২০২২ সালের ২৮ জুন। ২৩ ও ২৬ জুন মালয়েশিয়ার বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচ শেষ হওয়ার পর জাতীয় দলের ক্যাম্প ছুটি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। ঋতুপর্ণা ২৯ জুন রাঙামাটির উদ্দেশে ঢাকা থেকে বাসে রওনা দেন। সেদিন কেন জানি অজানা আশঙ্কা মনের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল তাঁর, “ও সাধারণত আমাকে কম ফোন করে। সেদিন ফোন করে বলেছিল, “দিদি, তুই কবে আসবি?
দুই ভাই–বোনের এক সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নেওয়ার কথা ছিল। এ জন্য পরদিন বাসের টিকিট কাটেন। বাসে বসে কেমন যেন অস্থির লাগছিল ঋতুপর্ণার। আগের রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন। রুমমেট তহুরা খাতুনকে ক্যাম্প ছেড়ে আসার আগে বলেছিলেন, ক্ষমা করে দিস।
ঋতুপর্ণা যখন বাড়ির পথে, দুর্ঘটনাটা ঘটে তখন। কিন্তু পথের মধ্যে থাকায় তাঁকে দুঃসংবাদ জানানো হয়নি। বাড়িতে গিয়ে জানতে পারেন নির্মম সত্য।
ফুটবল খেলার সুবাদে অনেক দেশে গেছেন ঋতুপর্ণা। প্রতিবারই দেশে ফেরার সময় ভাইয়ের পছন্দের চকলেট নিয়ে আসতেন। ইদানিং কারও জন্যই চকলেট কেনা হয় না ঋতুপর্ণার।
মা বোজোপতি চাকমার জন্য বেশি কষ্ট হয় ঋতুপর্ণার, “বোনদের তো বিয়ে হয়ে গেছে। আমি খেলার জন্য বাড়ির বাইরে থাকি। বাড়ি ছেড়ে আসার সময় নিজের আবেগ আটকে রাখতে পারি না। মায়ের সামনে কাঁদতে চাই না। কিন্তু হু হু করে কান্না চলে আসে। মা বড্ড একা।”
ভাই হারানোর কষ্টটা ভুলতে চান ঋতুপর্ণা ফুটবল মাঠে। জীবন আসলে কারও জন্য থেমে থাকে না। জীবন থেমে থাকে না বলেই ঋতুপর্ণা কাঁদেন, আবার দলকে জিতিয়ে হাসেন।
বাহরাইনের বিপক্ষেও নিশ্চয় ঋতুপর্ণার গোলে হাসবে বাংলাদেশ। আর অলক্ষ্যে ঋতুপর্ণা নিজেই কাঁদবেন। ভাইটি যে তার খুবই প্রিয় ছিল!

 

বিএম/সব