০৭:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধীদের বিচরণ – ১ গভীর জঙ্গলে ঘেরা ইরানি পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের স্বর্গরাজ্য  

ঝোপঝাড়-গাছাপালায় গভীর অরণ্য ইরানি পাহাড়। সাধারণ কোন মানুষ ভয়ে এই গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করার সাহস করার কোনসুেযোগ নেই। অভিজ্ঞ বনের কাঠুরিরাও এই পাহাড়ে ঢুকার সাহস করে না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। দুর্গম এই পাহাড়কে আস্তানা বানিয়ে চিহ্নিত অস্ত্রধারীরা আশেপাশের এলাকায় অপরাধ করছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।। সন্ত্রাসীরা সেখানে চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণ ও মাদকের অভয়ারণ্য গড়েছে। কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ এর একটি এলাকার নাম ইরানি পাহাড়। এ পাহাড়ের পাদদেশে বসতি গড়েছেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ৬০ হাজার রোহিঙ্গা পরিবার। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশের সীমান্তবর্তী অরক্ষিত এলাকা দিয়ে পাশ্ববর্তী দেশ মায়ানমার থেকে ভয়াবহ আগ্নেয়াস্ত্র আনছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। এসব অবৈধ অস্ত্র ইরানি পাহাড়সহ আশেপাশের জঙ্গলে মজুদ করছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। এসব সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজী ও মাদক ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে এসব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের উপর। মায়ানমার সীমান্তপথে বাংলাদেশের সীমানায় এখনো অনেক পথ অরক্ষিত থাকায় মরণনেশা ইয়াবার সাথে বানের পানির মতো অস্ত্র সরবরাহ করছে মায়নমারের অপরাধীরা। অত্যধুনিক অস্ত্র অনেকটা বিনা বাঁধায় বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিচ্ছে মায়ানমার সন্ত্রাসীরা। বাংলাদেশে নানা ধরনের ইয়াবার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এসব ইয়াবা পাচারকে একক হাতে আনার জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইয়াবা পাচারের সাথে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা চট্টগ্রাম শহরসহ ঢাকায় আধুনিক অস্ত্রও সরবরাহ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দেশেরে  বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্যাডার ও টেন্ডারবাজদের কাছে আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসীরা এমন অভিযোগ উঠেছে স্থানীয়দের কাছ থেকে।
অপরাধীরা কীভাবে গড়েছে নিরাপদ ঘাঁটি?
উখিয়া-টেকনাফে বিভিন্ন  রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, ভারী ও অত্যাধুনিক অস্ত্র কেনাবেচায় জড়িত অস্ত্রধারীদের নিয়ন্ত্রণ করা হয় ইরানি পাহাড়ের আস্তানা থেকে। এর নেপথ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। এ ছাড়া রয়েছে আরও ১০-১২টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ওই দুই সন্ত্রাসী সংগঠনের গোলাগুলিতে নিহত হন দু’জন। এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তারে রোহিঙ্গা সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বিগত দিনে একাধিক বার গোলাগুলির ঘটনা ঘটিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার অপচেষ্টা চালিয়েছে।
জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে গত ছয় বছরে খুন হয়েছেন ১৮৯ জন রোহিঙ্গা। পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, গত আট মাসে ক্যাম্পগুলোতে ৫৫টি সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৬৫ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।
জেলা পুলিশের তথ্যমতে, গত ছয় বছরে আশ্রয়শিবিরগুলোতে ১৩১টি গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় ১৮৯ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় ১৩১টি মামলাতে ৯৯১ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩২০ জনের বেশি।
পুলিশের দেওয়া তথ্য  জানা যায়, আগের তুলনায় ক্যাম্পে হত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে। ২০১৭ সালে ৮ হত্যা মামলায় আসামি ছিল ২২ জন, ২০১৮ সালে ১৫ মামলায় আসামি ৩৩ জন, ২০১৯ সালে ২২ মামলায় আসামি ১০৭ জন, ২০২০ সালে ১৩ মামলায় আসামি ১২৩ জন, ২০২১ সালে ১৩ মামলায় আসামি ৬৫ জন, ২০২২ সালে ২০ মামলায় আসামি ২৩৭ জন এবং চলতি বছরের ২১ আগস্ট পর্যন্ত ৪০ হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে ৪০৪ জনকে। এ ছাড়া গত ছয় বছরে ক্যাম্পে ৪৪টি অপহরণ, ৯৪টি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা, ২৩৮টি অস্ত্র মামলায় আসামি করা হয়েছে অন্তত এক হাজার রোহিঙ্গাকে।
 এসেব অপকর্মে নেতৃত্বে দিয়ে যাঁরা ত্রাসে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা হলেন:
এই পাহাড়ে শতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীর নেতৃত্বে রয়েছে আরসার শূরা সদস্য ছমি উদ্দিন। তার সহযোগী হিসেবে রয়েছে নবী হোসেন, দীন মোহাম্মদ, মৌলভী ফজলুল কবির, মাস্টার ছৈয়দ হোসেন ও আবু তাহের। ছমি উদ্দিনের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে। অস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার রহস্য উদ্ঘাটনে কাজ করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর এমন তথ্যই পেয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যরা। তাদের তথ্যমতে, ইরানি পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের আস্তানায় নাইন এমএম, এলএমজি, রিভলবার ও মেশিনগানের মতো ভারী এবং অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে। এ কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শুধু রাতে নয়, এখন দিনেও অস্ত্রধারীদের আনাগোনা ওপেন সিক্রেট। ক্যাম্পগুলোতে একাধিক রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপ এখন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মধ্যে অজানা আতঙ্ক ভর করে। খুনাখুনি, অপহরণ, গুম, লুটপাট স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে রূপ নিয়েছে এই ভিন দেশী আশ্রয় নেয়াদের মধ্যে অপরাধীদের। এর প্রভাবে শুধু সাধারণ রোহিঙ্গা নয়, পুরো কক্সবাজারের বাসিন্দারা এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
কোন ক্যাম্পে কে কে অস্ত্রধারীদের নেতৃত্বে রয়েছে তা সংস্থাটির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। ক্যাম্প-১ এর নেতৃত্বে রয়েছে মৌলভী আব্দুর রহমান, আব্দুর রহিম ও ইব্রাহিম। ক্যাম্প-২ এর নেতৃত্বে রয়েছে হামিদ মির্জা, শাকের, কলিম উল্লা, মাস্টার রফিক, দীন মোহাম্মদ, ছৈয়দ আলম ও মো. ইসমাইল। ক্যাম্প-৩ এর নেতৃত্বে মৌলভী হাসান, শাবিদ, হামিদ ওরফে হামজা ও আব্দুল হামিদ; ক্যাম্প-৪ এর নেতৃত্বে নবী হোসেন, মোহাম্মদ জুবায়ের ও আনিছ; ক্যাম্প-৫ এর নেতৃত্বে রয়েছেন হাফেজ আব্দুল্লাহ। ক্যাম্প-৬ এর নেতৃত্বে কেফায়েত উল্লাহ ও মোহাম্মদ রফিক; ক্যাম্প-৭ এর নেতৃত্বে  শফি উদ্দিন ও আব্দুল আলিম; ক্যাম্প-৮ এর নেতৃত্বে রয়েছেন নবী হোসেন, দীন মোহাম্মদ, মৌলভী ফজলুল কবির, মাস্টার ছৈয়দ হোসেন ও আবু তাহের।
ক্যাম্প-৯ এর নেতৃত্বে মৌলভী ফজলুল কবির ও হাফেজ এহেসান; ক্যাম্প-১০ এর নেতৃত্বে সাঈদুল আলম ও সালাহ উদ্দিন প্রকাশ আবু জাদ্দুন; ক্যাম্প-১১ এর নেতৃত্বে হামিদ ওরফে শোয়াইব ও নুর কামাল; ক্যাম্প-১২ এর নেতৃত্বে আলী জোহার ও আতা উল্লাহ; ক্যাম্প-১৩ এর নেতৃত্বে মৌলভী আবদুল হালিম ও মোহাম্মদ সোলতান; ক্যাম্প-১৪ এর নেতৃত্বে রয়েছে হামিদ, সাব্বির, রেজওয়ান, ওস্তাদ খালেদ ও নবী হোসেন; ক্যাম্প-১৫ এর নেতৃত্বে রয়েছেন আবুল কালাম ও আব্দুর রশিদ। ক্যাম্প-১৬ এর নেতৃত্বে মোহাম্মদ ইউনুস ও নুর মোহাম্মদ; ক্যাম্প-১৭ এর নেতৃত্বে মোহাম্মদ হাশিম ও ওস্তাদ খালেদ; ক্যাম্প-১৮ এর নেতৃত্বে রয়েছেন মোহাম্মদ হাছন ও হাশিম। ক্যাম্প-১৯ এর নেতৃত্বে মৌলভী আনাস ও মৌলভী ইউনুস; ক্যাম্প-২০ এর নেতৃত্বে হারুন অর রশিদ, করিম উল্লাহ, আলী জোহার, মোহাম্মদ শাহ ও আব্দু শুক্কুর; ক্যাম্প-২১ এর নেতৃত্বে ওস্তাদ খালেদ ও শাহেদ এবং ক্যাম্প-২২ এর নেতৃত্বে রয়েছেন মোহাম্মদ ইসলাম, জাবু ও কালাপুতু।
পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, ভারী এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রগুলো মিয়ানমার থেকে আনা হচ্ছে। ক্যাম্পে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মিয়ানমারের আরাকান আর্মি এসব অস্ত্র সরবরাহ করছে। এ প্রসঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)-১৪ এর অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. ইকবাল বলেন, পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্প নজরদারিতে রয়েছে। এপিবিএন-৮ এর অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আমির জাফর বলেন, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুনাখুনির ঘটনা ঘটছে। এসব নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত অভিযান চলছে, গ্রেপ্তারের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় উদ্ধার হচ্ছে অস্ত্র।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, ‘সারাবছর অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলেছে। পুলিশসহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা কড়া নজরদারি রেখেছে এসব সন্ত্রাসীদের। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন পয়েন্টে একাধিক অভিযানে বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে।’
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের কুতুপালং এলাকার রাজাপালং ইউপি সদস্য প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা এলাকার বাসিন্দাদের নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কে থাকি। রোহিঙ্গারা আসার পর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণ, মাদকসহ নানা ধরনের অপরাধে যুক্ত। এলাকার অনেক মানুষকে তারা অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে।
জনপ্রিয় সংবাদ

২০২৬ শিক্ষাবর্ষে স্কুলের ছুটিতে বড় পরিবর্তন, কমলো ১২ দিন

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধীদের বিচরণ – ১ গভীর জঙ্গলে ঘেরা ইরানি পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের স্বর্গরাজ্য  

আপডেট সময় : ০৪:৫১:২৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ অক্টোবর ২০২৩
ঝোপঝাড়-গাছাপালায় গভীর অরণ্য ইরানি পাহাড়। সাধারণ কোন মানুষ ভয়ে এই গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করার সাহস করার কোনসুেযোগ নেই। অভিজ্ঞ বনের কাঠুরিরাও এই পাহাড়ে ঢুকার সাহস করে না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। দুর্গম এই পাহাড়কে আস্তানা বানিয়ে চিহ্নিত অস্ত্রধারীরা আশেপাশের এলাকায় অপরাধ করছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।। সন্ত্রাসীরা সেখানে চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণ ও মাদকের অভয়ারণ্য গড়েছে। কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ এর একটি এলাকার নাম ইরানি পাহাড়। এ পাহাড়ের পাদদেশে বসতি গড়েছেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ৬০ হাজার রোহিঙ্গা পরিবার। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশের সীমান্তবর্তী অরক্ষিত এলাকা দিয়ে পাশ্ববর্তী দেশ মায়ানমার থেকে ভয়াবহ আগ্নেয়াস্ত্র আনছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। এসব অবৈধ অস্ত্র ইরানি পাহাড়সহ আশেপাশের জঙ্গলে মজুদ করছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। এসব সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজী ও মাদক ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে এসব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের উপর। মায়ানমার সীমান্তপথে বাংলাদেশের সীমানায় এখনো অনেক পথ অরক্ষিত থাকায় মরণনেশা ইয়াবার সাথে বানের পানির মতো অস্ত্র সরবরাহ করছে মায়নমারের অপরাধীরা। অত্যধুনিক অস্ত্র অনেকটা বিনা বাঁধায় বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিচ্ছে মায়ানমার সন্ত্রাসীরা। বাংলাদেশে নানা ধরনের ইয়াবার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এসব ইয়াবা পাচারকে একক হাতে আনার জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইয়াবা পাচারের সাথে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা চট্টগ্রাম শহরসহ ঢাকায় আধুনিক অস্ত্রও সরবরাহ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দেশেরে  বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্যাডার ও টেন্ডারবাজদের কাছে আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসীরা এমন অভিযোগ উঠেছে স্থানীয়দের কাছ থেকে।
অপরাধীরা কীভাবে গড়েছে নিরাপদ ঘাঁটি?
উখিয়া-টেকনাফে বিভিন্ন  রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, ভারী ও অত্যাধুনিক অস্ত্র কেনাবেচায় জড়িত অস্ত্রধারীদের নিয়ন্ত্রণ করা হয় ইরানি পাহাড়ের আস্তানা থেকে। এর নেপথ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। এ ছাড়া রয়েছে আরও ১০-১২টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ওই দুই সন্ত্রাসী সংগঠনের গোলাগুলিতে নিহত হন দু’জন। এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তারে রোহিঙ্গা সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বিগত দিনে একাধিক বার গোলাগুলির ঘটনা ঘটিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার অপচেষ্টা চালিয়েছে।
জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে গত ছয় বছরে খুন হয়েছেন ১৮৯ জন রোহিঙ্গা। পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, গত আট মাসে ক্যাম্পগুলোতে ৫৫টি সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৬৫ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।
জেলা পুলিশের তথ্যমতে, গত ছয় বছরে আশ্রয়শিবিরগুলোতে ১৩১টি গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় ১৮৯ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় ১৩১টি মামলাতে ৯৯১ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩২০ জনের বেশি।
পুলিশের দেওয়া তথ্য  জানা যায়, আগের তুলনায় ক্যাম্পে হত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে। ২০১৭ সালে ৮ হত্যা মামলায় আসামি ছিল ২২ জন, ২০১৮ সালে ১৫ মামলায় আসামি ৩৩ জন, ২০১৯ সালে ২২ মামলায় আসামি ১০৭ জন, ২০২০ সালে ১৩ মামলায় আসামি ১২৩ জন, ২০২১ সালে ১৩ মামলায় আসামি ৬৫ জন, ২০২২ সালে ২০ মামলায় আসামি ২৩৭ জন এবং চলতি বছরের ২১ আগস্ট পর্যন্ত ৪০ হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে ৪০৪ জনকে। এ ছাড়া গত ছয় বছরে ক্যাম্পে ৪৪টি অপহরণ, ৯৪টি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা, ২৩৮টি অস্ত্র মামলায় আসামি করা হয়েছে অন্তত এক হাজার রোহিঙ্গাকে।
 এসেব অপকর্মে নেতৃত্বে দিয়ে যাঁরা ত্রাসে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা হলেন:
এই পাহাড়ে শতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীর নেতৃত্বে রয়েছে আরসার শূরা সদস্য ছমি উদ্দিন। তার সহযোগী হিসেবে রয়েছে নবী হোসেন, দীন মোহাম্মদ, মৌলভী ফজলুল কবির, মাস্টার ছৈয়দ হোসেন ও আবু তাহের। ছমি উদ্দিনের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে। অস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার রহস্য উদ্ঘাটনে কাজ করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর এমন তথ্যই পেয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যরা। তাদের তথ্যমতে, ইরানি পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের আস্তানায় নাইন এমএম, এলএমজি, রিভলবার ও মেশিনগানের মতো ভারী এবং অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে। এ কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শুধু রাতে নয়, এখন দিনেও অস্ত্রধারীদের আনাগোনা ওপেন সিক্রেট। ক্যাম্পগুলোতে একাধিক রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপ এখন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মধ্যে অজানা আতঙ্ক ভর করে। খুনাখুনি, অপহরণ, গুম, লুটপাট স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে রূপ নিয়েছে এই ভিন দেশী আশ্রয় নেয়াদের মধ্যে অপরাধীদের। এর প্রভাবে শুধু সাধারণ রোহিঙ্গা নয়, পুরো কক্সবাজারের বাসিন্দারা এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
কোন ক্যাম্পে কে কে অস্ত্রধারীদের নেতৃত্বে রয়েছে তা সংস্থাটির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। ক্যাম্প-১ এর নেতৃত্বে রয়েছে মৌলভী আব্দুর রহমান, আব্দুর রহিম ও ইব্রাহিম। ক্যাম্প-২ এর নেতৃত্বে রয়েছে হামিদ মির্জা, শাকের, কলিম উল্লা, মাস্টার রফিক, দীন মোহাম্মদ, ছৈয়দ আলম ও মো. ইসমাইল। ক্যাম্প-৩ এর নেতৃত্বে মৌলভী হাসান, শাবিদ, হামিদ ওরফে হামজা ও আব্দুল হামিদ; ক্যাম্প-৪ এর নেতৃত্বে নবী হোসেন, মোহাম্মদ জুবায়ের ও আনিছ; ক্যাম্প-৫ এর নেতৃত্বে রয়েছেন হাফেজ আব্দুল্লাহ। ক্যাম্প-৬ এর নেতৃত্বে কেফায়েত উল্লাহ ও মোহাম্মদ রফিক; ক্যাম্প-৭ এর নেতৃত্বে  শফি উদ্দিন ও আব্দুল আলিম; ক্যাম্প-৮ এর নেতৃত্বে রয়েছেন নবী হোসেন, দীন মোহাম্মদ, মৌলভী ফজলুল কবির, মাস্টার ছৈয়দ হোসেন ও আবু তাহের।
ক্যাম্প-৯ এর নেতৃত্বে মৌলভী ফজলুল কবির ও হাফেজ এহেসান; ক্যাম্প-১০ এর নেতৃত্বে সাঈদুল আলম ও সালাহ উদ্দিন প্রকাশ আবু জাদ্দুন; ক্যাম্প-১১ এর নেতৃত্বে হামিদ ওরফে শোয়াইব ও নুর কামাল; ক্যাম্প-১২ এর নেতৃত্বে আলী জোহার ও আতা উল্লাহ; ক্যাম্প-১৩ এর নেতৃত্বে মৌলভী আবদুল হালিম ও মোহাম্মদ সোলতান; ক্যাম্প-১৪ এর নেতৃত্বে রয়েছে হামিদ, সাব্বির, রেজওয়ান, ওস্তাদ খালেদ ও নবী হোসেন; ক্যাম্প-১৫ এর নেতৃত্বে রয়েছেন আবুল কালাম ও আব্দুর রশিদ। ক্যাম্প-১৬ এর নেতৃত্বে মোহাম্মদ ইউনুস ও নুর মোহাম্মদ; ক্যাম্প-১৭ এর নেতৃত্বে মোহাম্মদ হাশিম ও ওস্তাদ খালেদ; ক্যাম্প-১৮ এর নেতৃত্বে রয়েছেন মোহাম্মদ হাছন ও হাশিম। ক্যাম্প-১৯ এর নেতৃত্বে মৌলভী আনাস ও মৌলভী ইউনুস; ক্যাম্প-২০ এর নেতৃত্বে হারুন অর রশিদ, করিম উল্লাহ, আলী জোহার, মোহাম্মদ শাহ ও আব্দু শুক্কুর; ক্যাম্প-২১ এর নেতৃত্বে ওস্তাদ খালেদ ও শাহেদ এবং ক্যাম্প-২২ এর নেতৃত্বে রয়েছেন মোহাম্মদ ইসলাম, জাবু ও কালাপুতু।
পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, ভারী এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রগুলো মিয়ানমার থেকে আনা হচ্ছে। ক্যাম্পে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মিয়ানমারের আরাকান আর্মি এসব অস্ত্র সরবরাহ করছে। এ প্রসঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)-১৪ এর অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. ইকবাল বলেন, পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্প নজরদারিতে রয়েছে। এপিবিএন-৮ এর অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আমির জাফর বলেন, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুনাখুনির ঘটনা ঘটছে। এসব নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত অভিযান চলছে, গ্রেপ্তারের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় উদ্ধার হচ্ছে অস্ত্র।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, ‘সারাবছর অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলেছে। পুলিশসহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা কড়া নজরদারি রেখেছে এসব সন্ত্রাসীদের। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন পয়েন্টে একাধিক অভিযানে বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে।’
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের কুতুপালং এলাকার রাজাপালং ইউপি সদস্য প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা এলাকার বাসিন্দাদের নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কে থাকি। রোহিঙ্গারা আসার পর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণ, মাদকসহ নানা ধরনের অপরাধে যুক্ত। এলাকার অনেক মানুষকে তারা অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে।