- মানা হচ্ছে না আইন ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা
- প্রকাশ করা হচ্ছে নির্যাতিত নারীশিশুর পরিচয়
- সমাজে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন নির্যাতিতরা
‘ভুক্তভোগী, তাঁর পরিবার ও বাসস্থানসহ এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করা যাবে না যাতে তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হয়। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তো বটেই, মূলধারার গণমাধ্যমও আইন মানছে না। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক’- আইনজীবী মাহফুজুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল
‘তথ্য মন্ত্রণালয় এসব ছবি-ভিডিও অপসারণের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশের অপেক্ষায় বসে থাকে। এটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। আইন লঙ্ঘনকারী এবং তারা মূলধারার গণমাধ্যম হলে তাদেরও শাস্তির আওতায় নেওয়া উচিত’- ইশরাত হাসান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশ পায় এমন কোনো কিছু প্রচার ও প্রকাশ না করার আইন থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এমনকি এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা থাকলেও তা মানছেন না কেউ। এরপরও অহরহ প্রকাশ করা হচ্ছে ভুক্তভোগীর পরিচয়। এতে করে নির্যাতনের শিকার নারী ও তাঁর স্বজনেরা সমাজে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন। এমনকি এ যন্ত্রণা সইতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেন। এদিকে এমন পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগী ও তাঁর পরিবারকে বিড়ম্বনার হাত থেকে বাঁচাতে আইন লঙ্ঘনকারীদের শাস্তির আওতায় আনার তাগিদ আইনজ্ঞদের। এ ছাড়া সরকারকে এই বিষয়ে প্রচার বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শও দিচ্ছেন তারা। তারা বলছেন, ভুক্তভোগী, তাঁর পরিবার ও বাসস্থানসহ এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করা যাবে না–যাতে তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হয়। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তো বটেই, মূলধারার গণমাধ্যমও আইন মানছে না। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তারা বলছেন, তথ্য মন্ত্রণালয় এসব ছবি-ভিডিও অপসারণের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশের অপেক্ষায় বসে থাকে। এটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। আইন লঙ্ঘনকারী এবং তারা মূলধারার গণমাধ্যম হলে তাদেরও শাস্তির আওতায় নেওয়া উচিত।
জানা গেছে, সম্প্রতি কুমিল্লায় এক নারীকে পাশবিক নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এরপর ওই নারীর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে বিভিন্ন গণমাধ্যম। এর আগে মাগুরায় ধর্ষণ ও হত্যার শিকার শিশুটির পরিচয় প্রকাশ করা হয় সামাজিক মাধ্যমে, এমনকি মূলধারার কয়েকটি গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়। অনেকে ওই শিশুর বোনের সাক্ষাৎকারও প্রকাশ করে। দুটি ঘটনার ছবি-ভিডিও অপসারণ করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। অবশ্য এ রকম ঘটনা এর আগেও অনেক ঘটেছে। এদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, আইনে বর্ণিত অপরাধের শিকার নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা সে সম্পর্কিত সংবাদ বা তথ্য কোনো সংবাদপত্রে বা অন্য কোনো মাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ করতে হবে, যাতে ওই নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়। আর ১৪(২) ধারায় বলা হয়েছে, (১) এর বিধান লঙ্ঘন করলে দায়ী ব্যক্তি অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
অন্যদিকে, শিশু আইনের ২৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, শিশু-আদালতে বিচারাধীন কোনো মামলায় জড়িত বা সাক্ষ্য প্রদানকারী কোনো শিশুর ছবি বা এমন কোনো বর্ণনা, সংবাদ বা রিপোর্ট প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম অথবা ইন্টারনেটে প্রকাশ বা প্রচার করা যাবে না; যা সংশ্লিষ্ট শিশুকে শনাক্তকরণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য করে। শিশু আইনের ৮১ (১) ধারায় বলা হয়েছে, বিচারাধীন কোনো মামলা বা বিচার কার্যক্রম সম্পর্কে প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম অথবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোনো শিশুর স্বার্থের পরিপন্থি এমন কোনো প্রতিবেদন, ছবি বা তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। যার দ্বারা শিশুটিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শনাক্ত করা যায়। ৮১(২) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি উপধারা(১)-এর বিধান লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অনধিক এক বছর কারাদণ্ড অথবা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া ৮১(৩) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানি, সমিতি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান উপধারা (১)-এর বিধান লঙ্ঘন করলে তাদের নিবন্ধন অনধিক ২ মাসের জন্য স্থগিত রাখাসহ অনধিক ২ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করা যাবে।
এদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংবাদমাধ্যমে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশে বিধিনিষেধ না মানায় এর নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করে জাস্টিস ওয়াচ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে রিট করা হয়েছিল হাইকোর্টে। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ৮ মার্চ নির্দেশনা দেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের তৎকালীন হাইকোর্ট বেঞ্চ। যাতে ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীর পরিচয় (পূর্ণ নাম, ঠিকানা, ছবি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থলের নামসহ সংশ্লিষ্ট তথ্য) অনলাইন, সংবাদপত্র ও অন্যান্য মাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ বন্ধে পদক্ষেপ নিতে তথ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল ও বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। হাইকোর্টে ওই রিট করেছিলেন জাস্টিস ওয়াচ ফাউন্ডেশনের তখনকার নির্বাহী পরিচালক ও বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহফুজুর রহমান বলেন, ভুক্তভোগী, তাঁর পরিবার ও বাসস্থানসহ এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করা যাবে না যাতে তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হয়। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তো বটেই, মূলধারার গণমাধ্যমও আইন মানছে না। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এটি বন্ধ করতে অবশ্যই আইনে বর্ণিত শাস্তি প্রয়োগ করে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। যাতে অন্যরা এটা দেখে শিক্ষা নেয়। তাহলেই এটি বন্ধ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে পরিচয় প্রকাশ না করতে বলা হয়েছে। আইন থাকার পরও ভুক্তভোগী এবং তাঁর পরিবারের পরিচয় প্রকাশ করা হচ্ছে। এতে তাঁরা সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছেন। অথচ তথ্য মন্ত্রণালয় এসব ছবি-ভিডিও অপসারণের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশের অপেক্ষায় বসে থাকে। এটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। তাই নির্যাতনের শিকার ও তাঁর পরিবারের পরিচয় প্রকাশিত হয়, এমন কোনো ঘটনা মিডিয়ায় এলে সঙ্গে সঙ্গেই তা অপসারণ করতে হবে। সেই সঙ্গে আইন লঙ্ঘন করে যারা এসব করবে, তাদের আইনের আওতায় নিতে হবে। মূলধারার গণমাধ্যম হলে তাদেরও শাস্তির আওতায় নেওয়া উচিত। এ ছাড়া আইনের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে সরকারের পক্ষ থেকে আরও বেশি প্রচার চালানো দরকার বলে মনে করেন তিনি।























