০৯:৪৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মানবাধিকার কমিশনের অফিস ঘিরে বিতর্ক

  • সংকটপূর্ণ পরিবেশ নেই তবুও কেন অফিস প্রশ্ন
  • বিরোধিতায় ইসলামপন্থিরা ছাড়াও বামদলগুলো

 

২৯ জুন ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের (ইউএনএইসআরএইসসি) অস্থায়ী কার্যালয় স্থাপনের খসড়া সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) নীতিগতভাবে অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। তিন বছরের জন্য প্রাথমিক অনুমোদন থাকলেও দুই বছর পরে কার্যকারিতা মূল্যায়নের ভিত্তিতে এটি পুনঃবাস্তবায়নের বিষয় বিবেচনা হবে। এই উদ্যোগকে ‘আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, যিনি জানান, এটি কোনো হস্তক্ষেপ নয় বরং উন্নয়ন সহযোগিতা। জাতিসংঘ কারিগরি সহায়তার ভিত্তিতে কাজ করবে। মানবাধিকার সংক্রান্ত জাতীয় প্রচেষ্টা আরও কার্যকর করতে এ অফিস ভূমিকা রাখবে। তবে হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ ইসলামি দলগুলো সরকারের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এটি ধর্মীয় মূল্যবোধ ও তা হুমকির মুখে ফেলতে পারে। তাদের বক্তব্য, বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট মাপকাঠিতে গৃহযুদ্ধ বা জাতিগত নিধনের মতো পরিস্থিতি না থাকা সত্ত্বেও নতুন এই সংস্থা স্বায়ত্তশাসন ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের ওপর প্রভাব ফেলবে। কিছু বামপন্থি দল বিশেষ করে সিপিবিও প্রশ্ন তুলেছে যে, বাংলাদেশ সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে নেই, তাহলে কেন জাতিসংঘ অফিস এবং জাতিসংঘের উদ্দেশ্য নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছে ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হোয়াইট পেপারে বলা হয়েছে, যেসব দেশে জাতিসংঘের কার্যালয় আছে, সেগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতা তুলনীয় কিনা, সেটি বিচারের অপেক্ষায়। পাশাপাশি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পরামর্শও উঠেছে। আইন ও বিচার বিভাগের প্রতিনিধির বক্তব্য, মানবাধিকার হাইকমিশনারের ম্যান্ডেটে বর্ণিত হয়েছে, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়, এটা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, এটি দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত পদক্ষেপ যা গুম, নির্যাতন, সাংবাদিক নির্যাতন এসব বিষয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরবে। এছাড়া নারী বিষয় সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন হক একে মানবাধিকারের উপর জবাবদিহিতা ও চাপ গড়ে তুলবে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
২০২৪ সালের জুলাই আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনা নিয়ে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন বাংলাদেশের সরকারে আমন্ত্রণপূর্বক তদন্ত করে সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, সাত থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ১,০০০-১,৪০০ মানুষ নিহত হয়েছে, যার ৭৮% গুলিতেই নিহত; হাজারের অধিক গ্রেপ্তার, অনেকেই নির্যাতিত এবং সেখানে বহু আদিবাসী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আক্রান্ত। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় বিশ্বের ১৮টি দেশে সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- সুদান, ইয়েমেন, সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো (ডিআর কঙ্গো), বুরকিনা ফাসো, তিউনিসিয়া, মেক্সিকো, কলম্বিয়া, ফিলিস্তিন, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, কম্বোডিয়া, গুয়াতেমালা, কেনিয়া ও উগান্ডা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ দেশগুলো রাজনৈতিক অস্থিরতা, গৃহযুদ্ধ, সংঘাত বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর ইতিহাস বহন করে।
সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যেও এটা নিয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছে। গত মাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় জাতিসংঘের এ ধরনের কার্যালয় স্থাপন দেশের অভ্যন্তরীণ নীতিতে হস্তক্ষেপের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে একাধিক সংস্থা। অনেকেই জাতিসংঘের কার্যালয় স্থাপনের পরিবর্তে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় জাতিসংঘ মিশনের সম্ভাব্য ‘স্ট্যাটাস’ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়- যেসব দেশে জাতিসংঘের কার্যালয় রয়েছে, সেগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতা আদৌ তুলনীয় কিনা।
আইনশৃঙ্খলা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে জাতিসংঘের কার্যালয় স্থাপনের পরিবর্তে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। সভায় জননিরাপত্তা বিভাগের প্রতিনিধি বাংলাদেশের বিদ্যমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এ কার্যালয় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলেও মন্তব্য করেন। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এ বিষয়ে একটি জাতীয় সংলাপ আয়োজনের পক্ষে মত দেন। তবে আইন ও বিচার বিভাগের প্রতিনিধি সভায় উল্লেখ করেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের রেজুলেশনের মাধ্যমে মানবাধিকার হাইকমিশনারের যে ম্যান্ডেট নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গত অক্টোবরের শেষ দিকে ঢাকা সফর করেন জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের ভলকার তুর্ক। বাংলাদেশ সফরে প্রধান উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব দেন ভলকার তুর্ক। ওই সময় সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের কার্যালয় স্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছিলেন। আর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়েছিলেন, ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি এখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে। আর সংবাদ সম্মেলনে উন্নত দেশগুলোর পরিবর্তে বাংলাদেশে এ কার্যালয় স্থাপন নিয়ে ভলকার তুর্ক জানিয়েছিলেন, মানবাধিকার নিয়ে বেশ কিছু ভুল তথ্য রয়েছে। এটিকে কেউ পশ্চিমা তত্ত্ব হিসেবে দেখে, আবার কেউ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে, আবার অনেকে এটিকে চাপিয়ে দেওয়া দৃষ্টিভঙ্গিতেও দেখে। পর্যাপ্ত তহবিলের অভাবে বিশ্বের সব দেশে এ কার্যালয় স্থাপন করা যায়নি। এ কারণে যেখানে প্রয়োজন, সেখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বাংলাদেশ সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এ পরিবর্তন সহজ নয়। বাংলাদেশের সহযোগিতা প্রয়োজন। আর আমরা সেই প্রস্তাবই দিয়েছি।
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল এটা। আগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে আসতে দেওয়া হতো না। এখন বাংলাদেশে জাতিসংঘের অফিস স্থাপন হলে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার ওপর সরাসরি নজরদারি ও তথ্য সংগ্রহ হবে। ফলে কোনো ইস্যু বা ঘটনার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও গুরুত্ব বাড়বে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো আগের তুলনায় বেশি জবাবদিহিতার মধ্যে আসবে।
হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ মহিবুল্লাহ বাবুনগরী ৫ জুলাই ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অফিস খুলতে দেয়া হবে না। বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যার সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় কাঠামো ইসলামী মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই দেশের সংস্কৃতি, পরিবারব্যবস্থা, নৈতিক রীতিনীতিকে অক্ষুণ্ন রাখা আমাদের ধর্মীয় ও নাগরিক দায়িত্ব। সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে কার্যালয় স্থাপনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও আশঙ্কা প্রকাশ করছি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পাটির্র (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, কোনো একটি দেশ যদি দীর্ঘ মেয়াদে সংকটে পড়ে যায় তাহলে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অফিস প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশ তো এমন কোনো দীর্ঘ মেয়াদে সংকটে পড়ে নাই যে তাদের অফিস লাগবে। জাতিসংঘ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নিরপেক্ষ ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে এমন কোনো প্রমাণ নাই। তারা সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদীর স্বার্থরক্ষা করছে। মানুষের মধ্যে এই শঙ্কাই আছে। তারা মানবাধিকার নয়, ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে আসতে চায় কী না সেটাই এখন প্রশ্ন।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

স্মৃতিসৌধে তারেক রহমান

মানবাধিকার কমিশনের অফিস ঘিরে বিতর্ক

আপডেট সময় : ০৭:২০:৪১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫
  • সংকটপূর্ণ পরিবেশ নেই তবুও কেন অফিস প্রশ্ন
  • বিরোধিতায় ইসলামপন্থিরা ছাড়াও বামদলগুলো

 

২৯ জুন ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের (ইউএনএইসআরএইসসি) অস্থায়ী কার্যালয় স্থাপনের খসড়া সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) নীতিগতভাবে অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। তিন বছরের জন্য প্রাথমিক অনুমোদন থাকলেও দুই বছর পরে কার্যকারিতা মূল্যায়নের ভিত্তিতে এটি পুনঃবাস্তবায়নের বিষয় বিবেচনা হবে। এই উদ্যোগকে ‘আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, যিনি জানান, এটি কোনো হস্তক্ষেপ নয় বরং উন্নয়ন সহযোগিতা। জাতিসংঘ কারিগরি সহায়তার ভিত্তিতে কাজ করবে। মানবাধিকার সংক্রান্ত জাতীয় প্রচেষ্টা আরও কার্যকর করতে এ অফিস ভূমিকা রাখবে। তবে হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ ইসলামি দলগুলো সরকারের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এটি ধর্মীয় মূল্যবোধ ও তা হুমকির মুখে ফেলতে পারে। তাদের বক্তব্য, বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট মাপকাঠিতে গৃহযুদ্ধ বা জাতিগত নিধনের মতো পরিস্থিতি না থাকা সত্ত্বেও নতুন এই সংস্থা স্বায়ত্তশাসন ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের ওপর প্রভাব ফেলবে। কিছু বামপন্থি দল বিশেষ করে সিপিবিও প্রশ্ন তুলেছে যে, বাংলাদেশ সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে নেই, তাহলে কেন জাতিসংঘ অফিস এবং জাতিসংঘের উদ্দেশ্য নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছে ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হোয়াইট পেপারে বলা হয়েছে, যেসব দেশে জাতিসংঘের কার্যালয় আছে, সেগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতা তুলনীয় কিনা, সেটি বিচারের অপেক্ষায়। পাশাপাশি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পরামর্শও উঠেছে। আইন ও বিচার বিভাগের প্রতিনিধির বক্তব্য, মানবাধিকার হাইকমিশনারের ম্যান্ডেটে বর্ণিত হয়েছে, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়, এটা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, এটি দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত পদক্ষেপ যা গুম, নির্যাতন, সাংবাদিক নির্যাতন এসব বিষয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরবে। এছাড়া নারী বিষয় সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন হক একে মানবাধিকারের উপর জবাবদিহিতা ও চাপ গড়ে তুলবে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
২০২৪ সালের জুলাই আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনা নিয়ে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন বাংলাদেশের সরকারে আমন্ত্রণপূর্বক তদন্ত করে সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, সাত থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ১,০০০-১,৪০০ মানুষ নিহত হয়েছে, যার ৭৮% গুলিতেই নিহত; হাজারের অধিক গ্রেপ্তার, অনেকেই নির্যাতিত এবং সেখানে বহু আদিবাসী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আক্রান্ত। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় বিশ্বের ১৮টি দেশে সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- সুদান, ইয়েমেন, সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো (ডিআর কঙ্গো), বুরকিনা ফাসো, তিউনিসিয়া, মেক্সিকো, কলম্বিয়া, ফিলিস্তিন, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, কম্বোডিয়া, গুয়াতেমালা, কেনিয়া ও উগান্ডা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ দেশগুলো রাজনৈতিক অস্থিরতা, গৃহযুদ্ধ, সংঘাত বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর ইতিহাস বহন করে।
সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যেও এটা নিয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছে। গত মাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় জাতিসংঘের এ ধরনের কার্যালয় স্থাপন দেশের অভ্যন্তরীণ নীতিতে হস্তক্ষেপের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে একাধিক সংস্থা। অনেকেই জাতিসংঘের কার্যালয় স্থাপনের পরিবর্তে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় জাতিসংঘ মিশনের সম্ভাব্য ‘স্ট্যাটাস’ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়- যেসব দেশে জাতিসংঘের কার্যালয় রয়েছে, সেগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতা আদৌ তুলনীয় কিনা।
আইনশৃঙ্খলা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে জাতিসংঘের কার্যালয় স্থাপনের পরিবর্তে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। সভায় জননিরাপত্তা বিভাগের প্রতিনিধি বাংলাদেশের বিদ্যমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এ কার্যালয় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলেও মন্তব্য করেন। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এ বিষয়ে একটি জাতীয় সংলাপ আয়োজনের পক্ষে মত দেন। তবে আইন ও বিচার বিভাগের প্রতিনিধি সভায় উল্লেখ করেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের রেজুলেশনের মাধ্যমে মানবাধিকার হাইকমিশনারের যে ম্যান্ডেট নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গত অক্টোবরের শেষ দিকে ঢাকা সফর করেন জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের ভলকার তুর্ক। বাংলাদেশ সফরে প্রধান উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব দেন ভলকার তুর্ক। ওই সময় সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের কার্যালয় স্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছিলেন। আর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়েছিলেন, ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টি এখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে। আর সংবাদ সম্মেলনে উন্নত দেশগুলোর পরিবর্তে বাংলাদেশে এ কার্যালয় স্থাপন নিয়ে ভলকার তুর্ক জানিয়েছিলেন, মানবাধিকার নিয়ে বেশ কিছু ভুল তথ্য রয়েছে। এটিকে কেউ পশ্চিমা তত্ত্ব হিসেবে দেখে, আবার কেউ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে, আবার অনেকে এটিকে চাপিয়ে দেওয়া দৃষ্টিভঙ্গিতেও দেখে। পর্যাপ্ত তহবিলের অভাবে বিশ্বের সব দেশে এ কার্যালয় স্থাপন করা যায়নি। এ কারণে যেখানে প্রয়োজন, সেখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বাংলাদেশ সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এ পরিবর্তন সহজ নয়। বাংলাদেশের সহযোগিতা প্রয়োজন। আর আমরা সেই প্রস্তাবই দিয়েছি।
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল এটা। আগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে আসতে দেওয়া হতো না। এখন বাংলাদেশে জাতিসংঘের অফিস স্থাপন হলে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার ওপর সরাসরি নজরদারি ও তথ্য সংগ্রহ হবে। ফলে কোনো ইস্যু বা ঘটনার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও গুরুত্ব বাড়বে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো আগের তুলনায় বেশি জবাবদিহিতার মধ্যে আসবে।
হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ মহিবুল্লাহ বাবুনগরী ৫ জুলাই ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অফিস খুলতে দেয়া হবে না। বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যার সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় কাঠামো ইসলামী মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই দেশের সংস্কৃতি, পরিবারব্যবস্থা, নৈতিক রীতিনীতিকে অক্ষুণ্ন রাখা আমাদের ধর্মীয় ও নাগরিক দায়িত্ব। সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে কার্যালয় স্থাপনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও আশঙ্কা প্রকাশ করছি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পাটির্র (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, কোনো একটি দেশ যদি দীর্ঘ মেয়াদে সংকটে পড়ে যায় তাহলে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অফিস প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশ তো এমন কোনো দীর্ঘ মেয়াদে সংকটে পড়ে নাই যে তাদের অফিস লাগবে। জাতিসংঘ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নিরপেক্ষ ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে এমন কোনো প্রমাণ নাই। তারা সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদীর স্বার্থরক্ষা করছে। মানুষের মধ্যে এই শঙ্কাই আছে। তারা মানবাধিকার নয়, ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে আসতে চায় কী না সেটাই এখন প্রশ্ন।