১০:০১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যশোর-ঝিনাইদহের জেলে বাওড় পাড়ের মানুষ

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঝিনাইদহ ও যশোহর অঞ্চলের ৬ বাঁওড় পাড়ের জেলে সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো। বাওড় গুলোই ছিল তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। সেটা গত এপ্রিল মাসে ভূমি মন্ত্রানালয় কেড়ে নিয়ে ইজারা দিয়েছে। যে কারণে বাঁওড় পাড়ের প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ কর্মক্ষম হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি ইজারাদাররা বাঁওড় গুলিতে কৃত্রিম উপায়ে মাছ উৎপাদন করায় জীব বৈচিত্র্য ও দেশী জাতীয় মাছ ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে এসে পৌছেছে।

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের বলুহর ও জয়দিয়া, মহেশপুরের কাঠগড়া ও ফতেপুর, কালীগঞ্জের মর্জাদ এবং যশোহর চৌগাছা উপজেলার বেড়গোবিন্দপুর বাঁওড়। এ ছয়টি বাঁওড়ে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ানে ভূমি মন্ত্রাণালয়ে সাথে মৎস্য অধিদপ্তরের চুক্তির মাধ্যমে ১৯৭৯ সাল থেকে বিল বাঁওড় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে মাছ চাষ শুরু হয়। এখানে সুবিধা ভোগীরা ছিলেন বাঁওড় পাড়ের জেলেরা। ১৯৮৬ সাল থেকে বাঁওড়টি রাজস্ব খাতে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে আরো কয়েক
দফা চুক্তি বৃদ্ধি করে ভূমি মন্ত্রাণালয়। এখানে উৎপাদিত মাছের ৩৫ শতাংশ পেত মৎস্য অধিদপ্তর, ভূমি মন্ত্রাণালয় ২৫ শতাংশ এবং জেলে সম্প্রদায় পেত ৪০ শতাংশ। প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত রানি মাছের ১শত ভাগই পেত বাঁওড় পাড়ের জেলেরা। সর্বশেষ ভূমি মন্ত্রাণালয় সাথে মৎস্য মন্ত্রাণালয়ে চুক্তির মেয়াদ ছিল গত এপ্রিল মাস ২০২৩ সাল পর্যন্ত। পরে আর ভূমি মন্ত্রাণালয় চুক্তিবৃদ্ধি না করে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই গত ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ভূমি
মন্ত্রাণালয় জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এই ছয়টি বাঁওড় ইজারা প্রক্রিয়া শুরু করে। এপ্রিলেইজারাদারদের বাঁওড় বুঝিয়ে দেয়া হয়। জলমহল ইজারা প্রদানের জন্য বিজ্ঞপ্তিতে নিবন্ধনকৃত ও প্রকৃত মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির আবেদনের কথা বলা হলেও এখানে একাধিক মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি’র বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা নিয়ে মৎস্যজীবি নন এমন ব্যক্তিদের বাঁওড় ইজারা পাইয়ে দেয়ার গুরুতর অভিযোগ করেছে বাওড় পাড়ের জেলেরা। বাঁওড় পাড়ের জেলেরা কেমন আছে জানতে সরেজমিনে এ প্রতিবেদক কোটচাঁদপুর জয়দিয়া বাঁওড় পাড়ে গেলে দেখা যায় বাঁওড়ের ঘাটে প্রচুর জেলে ও তাদের পরিবারের লোকজন দাড়িয়ে বাঁওড়ের দিকে চেয়ে আছে। এ সময় সাংবাদিক দেখে অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

জয়দিয়া বাঁওড় ও মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি’র সভাপতি শীতল কুমার হালদার বলেন-আর সংসার টানতে পারছি না। বাঁওড় নেই আমরা পথে বসে গেছি। আমার বাবা ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে এই বাঁওড় থেকে মাছ ধরে সংসার চালিয়ে আমাদেরকে বড় করেছেন। বাবা তিন বছর আগে গত হয়েছেন। আমরা বাঁওড় পাড়ের জেলেরা এই কাজই শিখে বাঁওড়ের মাছ ধরে সংসার চালিয়ে আসছিলাম। পরিবারের ৬জন সদস্য ছেলে কলেজে পড়ে, মেয়ে পড়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। বাঁওড়
পাড়ের জেলেরা আগে বাঁওড়ের উৎপাদিত বড় মাছের ৪০ শতাংশসহ প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত বাঁওড়ের রানি মাছ ধরে সম্পূর্ণ নিজেরা নিত। এখন সে রানি মাছ গুলি ধরা তো দুরে থাক ইজারাদাররা আমাদেরকে বাঁওড়েও নামতে দেয় না। কি করবো ঝুঝে উঠতে পারছিনা। এখন দেখছি আমাদের আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই। বলুহর বাঁওড় ও মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি গোপাল হালদার বলেন- আমরা বাঁওড় পাড়ের মৎসজীবিরা কর্মক্ষম হয়ে গেছি। বাবা- দাদারা এ বাঁওড় থেকে মাছ ধরেই সংসারের খরচ যোগাতেন। আমরাও একই পেশাতে ছিলাম।
বাঁওড় না থাকায় একেবাই পথে বসে গেছি। তিনি বলেন-একই অবস্থা প্রায় ৬ বাঁওড় পাড়ের জেলে সম্প্রদায়ের। ফতেপুর মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির সভাপতি শান্তি হালদার বলেন-আমরা ধারদেনা করে বাওড়টি ইজারা নিয়েছি। মাছ ছেড়েছি, সামনে কপালে কি আছে বলতে পারছিনা।
জয়দিয়া বাঁওড়ের সাবেক মৎস্যজীবিদের দলপতি নিত্য হালদার বলেন-বাঁওড় পূর্বের ন্যায় ফিরে পেতে ৬ বাঁওড় পাড়ের মৎস্যজীবিদের পক্ষ থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলাটি হাইকোর্টে চুড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় আছে। তারপরও ইজারাদাররা বাঁওড় পাড়ের জেলেদের মারধোর করে জোরপূর্বক মাছ ধরছেন।

যশোর বিল বাঁওড় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মোঃ আলফাজ উদ্দীন শেখ বলেন-এ বাঁওড় গুলি আমাদের আওতায় ৪২ বছর ছিলো সে সময় বাঁওড় পাড়ের জেলেদের আত্মসামাজিক মান উন্নয়নে কাজ করে গেছে এ প্রকল্পটি। পাশাপাশি পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঁওড়ের বড় মাছের চাষ ও দেশীয় ছোট মাছের প্রজনন ঘটিয়ে নানা প্রজাতির মাছের চাহিদা মিটাতে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সক্ষম হয়েছে প্রকল্পটি। বাঁওড়টি রাখার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি কিন্ত পারিনি। বাঁওড় গুলি ভূমি মন্ত্রালয় ইজারা দিয়ে দিয়েছেন। যে কারণে বাওড় পাড়ের জেলেরা তো বেকার হয়েছে পাশাপাশি বাঁওড় সংশ্লিষ্ট ১৩০ থেকে ১৪০ জন দৈনিক মুজুরী ভিত্তিক কর্মিও বেকার হয়ে গেছে। বর্তমানে এ বাঁওড় কেন্দ্রিক আমাদের আর কিছুই করার নেই। বলুহর বাঁওড় ম্যানেজার সিদ্দিকুর রহমান বলেন-আমরা বাঁওড় গুলিতে মাছ চাষ করতাম মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রজাতির মাছের সাইজ ও সংখ্যা বিবেচনা করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। মাছ ধরার সময়ও নির্দ্ধারণ করা থাকতো, ছোট মাছ ধরা হতোনা। একই সাথে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করার জন্য তথা বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণ ও প্রজনন বৃদ্ধির জন্য অভয়াশ্রম করা হতো। সেই সাথে প্রজনন কালিন সময় মাছ ধরা বন্ধ রাখা হত ফলে এক দিকে বিপন্ন প্রজাতির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেত অন্যদিকে জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষিত হতো। বর্তমান ইজারাদারা এ বিষয়ে যত্নশীল না হয়ে অধিক মুনাফার জন্য কৃত্তিম উপায়ে মাছ চাষ করছেন। যখন তখন মাছ ছাড়ছেন এবং ধরছেন। যে কারণে দেশীয় মাছ ও জীববৈচিত্র্য বাঁওড় গুলি থেকে একেবারে ধ্বংস হতে বসেছে।

জানা গেছে-কোটচাঁদপুর বলুহর বাঁওড় সংলগ্ন সরকারী মৎস্য হ্যাচারী কমপ্লেক্সসহ অন্যান্য বাঁওড় গুলির আশপাশে আবাদী জমির পানি স্যালো পাম্পের মাধ্যমে বাঁওড় থেকে নেয়া হত। ইজারাদাররা এই পানি বাঁওড় থেকে নেয়া বন্ধ করতে বিভিন্ন ফন্দি ফিকিরি করছেন। একাধিক আবাদী জমির মালিকরা আশংকা প্রকাশ করে বলছেন- বাঁওড় থেকে পানি নেয়া বন্ধ করে দিলে একদিকে যেমন শত শত একর জমি চাষ বাঁধা গ্রস্থ্য হবে। অন্যদিকে সরকারী মৎস্য হ্যাচারী
কমপ্লেক্সও পড়বে পানি সংকটে।বলুহর বাওড় ইজারা পাওয়া কোটচাঁদপুর মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির সভাপতি শীতল হালদার বলেন-বাওড় থেকে পানি উত্তোলন কেউ যেন না করতে পারে সে জন্য ইতি মধ্যেই জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন করেছি। এ ছাড়াও তিনি বলেন-আমার মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি কাউকে
ইজারা পাইয়ে দেয় নাই বা আমরা বাঁওড় সাব-লিজও দিই নাই।
কোটচাঁপুর বলুহর বাওড় পাড়ের কৃষক রেজাউল ইসলাম জানান, বাওড়ের ধারেই আমার সাড়ে ৪ বিঘা জমি আমি শুকনা মৌসুমে স্যালো মেশিন দিয়ে বাওড়ের পানি দিয়ে চাষ-আবাদ করে আসছি। কিন্তু বর্তমানে ইজারাদাররা পানি নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে করে আমরা আর্থিক দিক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি।

বাওড় পাড়ের আরেক কৃষক ফারুক হোসেন জানান, আমার বাপ দাদারা এই বাওড়ের পানি দিয়ে চাষ-আবাদ করে আসছি কিন্তু ইজারা দেওয়ার পর ইজারাদারের লোকজন বাওড় থেকে পানি নিতে দিচ্ছে না। আমাদের জমিতে বরিংও করা নেই। আমরা এই বাওড়ের পানি দিয়েই জমিতে সেচ দিয়ে শীতকালীন সবজি সহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করে আসছি। এখন কি করবো বুঝে উঠতে পারিছিনা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক এসএম রফিকুল ইসলাম বলেন, ভূমি মন্ত্রনালয় এবং মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রনালয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্মাক্ষর হয়েছিল।
সেই সমঝোতা স্মারক বলেই এই বাওড়গুলো পরিচালনা করা হতো। এরপর বাংলা ১৪২৯ সালে এই স্মারকের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ভূমি মন্ত্রনালয় মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রনালয়ের প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে এই আর বাড়ানো হবে না। ভূমি মন্ত্রনালয়ের এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা ইজারা দেওয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করেন। ভূমি মন্ত্রনালয়ের এই প্রক্রিয়া শেষে যারা দরপত্র অনুযায়ী বাওড় ইজারা নিয়েছেন ভূমি মন্ত্রনালয় নির্দেশে আমরা তাদের হাতে দরপত্র বুঝিয়ে দিয়েছি। এর প্রেক্ষিতে যারা এতোদিন এই বাওড়ের সূবিধা ভোগ করে আসছিল তারা এটা থেকে বঞ্চিত হলো বলে দাবি করছেন। যারা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলো তারা একটি
স্মারলিপি দিয়েছেন। সেই স্মারক লিপিতে তাদের হতাশা এবং কষ্টের কথা উল্লেখ করেছেন আমি সেই স্মারক লিপি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় থেকে যে সিদ্ধান দেবেন আমরা সেই আলোকে ব্যবস্থা গ্রহন করবো।

জনপ্রিয় সংবাদ

সব রেকর্ড ভেঙে স্বর্ণের দামে নতুন ইতিহাস, ভরি ছাড়াল দুই লাখ ২৭ হাজার

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যশোর-ঝিনাইদহের জেলে বাওড় পাড়ের মানুষ

আপডেট সময় : ০৮:৩৬:৩৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঝিনাইদহ ও যশোহর অঞ্চলের ৬ বাঁওড় পাড়ের জেলে সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো। বাওড় গুলোই ছিল তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। সেটা গত এপ্রিল মাসে ভূমি মন্ত্রানালয় কেড়ে নিয়ে ইজারা দিয়েছে। যে কারণে বাঁওড় পাড়ের প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ কর্মক্ষম হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি ইজারাদাররা বাঁওড় গুলিতে কৃত্রিম উপায়ে মাছ উৎপাদন করায় জীব বৈচিত্র্য ও দেশী জাতীয় মাছ ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে এসে পৌছেছে।

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের বলুহর ও জয়দিয়া, মহেশপুরের কাঠগড়া ও ফতেপুর, কালীগঞ্জের মর্জাদ এবং যশোহর চৌগাছা উপজেলার বেড়গোবিন্দপুর বাঁওড়। এ ছয়টি বাঁওড়ে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ানে ভূমি মন্ত্রাণালয়ে সাথে মৎস্য অধিদপ্তরের চুক্তির মাধ্যমে ১৯৭৯ সাল থেকে বিল বাঁওড় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে মাছ চাষ শুরু হয়। এখানে সুবিধা ভোগীরা ছিলেন বাঁওড় পাড়ের জেলেরা। ১৯৮৬ সাল থেকে বাঁওড়টি রাজস্ব খাতে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে আরো কয়েক
দফা চুক্তি বৃদ্ধি করে ভূমি মন্ত্রাণালয়। এখানে উৎপাদিত মাছের ৩৫ শতাংশ পেত মৎস্য অধিদপ্তর, ভূমি মন্ত্রাণালয় ২৫ শতাংশ এবং জেলে সম্প্রদায় পেত ৪০ শতাংশ। প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত রানি মাছের ১শত ভাগই পেত বাঁওড় পাড়ের জেলেরা। সর্বশেষ ভূমি মন্ত্রাণালয় সাথে মৎস্য মন্ত্রাণালয়ে চুক্তির মেয়াদ ছিল গত এপ্রিল মাস ২০২৩ সাল পর্যন্ত। পরে আর ভূমি মন্ত্রাণালয় চুক্তিবৃদ্ধি না করে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই গত ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ভূমি
মন্ত্রাণালয় জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এই ছয়টি বাঁওড় ইজারা প্রক্রিয়া শুরু করে। এপ্রিলেইজারাদারদের বাঁওড় বুঝিয়ে দেয়া হয়। জলমহল ইজারা প্রদানের জন্য বিজ্ঞপ্তিতে নিবন্ধনকৃত ও প্রকৃত মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির আবেদনের কথা বলা হলেও এখানে একাধিক মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি’র বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা নিয়ে মৎস্যজীবি নন এমন ব্যক্তিদের বাঁওড় ইজারা পাইয়ে দেয়ার গুরুতর অভিযোগ করেছে বাওড় পাড়ের জেলেরা। বাঁওড় পাড়ের জেলেরা কেমন আছে জানতে সরেজমিনে এ প্রতিবেদক কোটচাঁদপুর জয়দিয়া বাঁওড় পাড়ে গেলে দেখা যায় বাঁওড়ের ঘাটে প্রচুর জেলে ও তাদের পরিবারের লোকজন দাড়িয়ে বাঁওড়ের দিকে চেয়ে আছে। এ সময় সাংবাদিক দেখে অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

জয়দিয়া বাঁওড় ও মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি’র সভাপতি শীতল কুমার হালদার বলেন-আর সংসার টানতে পারছি না। বাঁওড় নেই আমরা পথে বসে গেছি। আমার বাবা ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে এই বাঁওড় থেকে মাছ ধরে সংসার চালিয়ে আমাদেরকে বড় করেছেন। বাবা তিন বছর আগে গত হয়েছেন। আমরা বাঁওড় পাড়ের জেলেরা এই কাজই শিখে বাঁওড়ের মাছ ধরে সংসার চালিয়ে আসছিলাম। পরিবারের ৬জন সদস্য ছেলে কলেজে পড়ে, মেয়ে পড়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। বাঁওড়
পাড়ের জেলেরা আগে বাঁওড়ের উৎপাদিত বড় মাছের ৪০ শতাংশসহ প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত বাঁওড়ের রানি মাছ ধরে সম্পূর্ণ নিজেরা নিত। এখন সে রানি মাছ গুলি ধরা তো দুরে থাক ইজারাদাররা আমাদেরকে বাঁওড়েও নামতে দেয় না। কি করবো ঝুঝে উঠতে পারছিনা। এখন দেখছি আমাদের আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই। বলুহর বাঁওড় ও মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি গোপাল হালদার বলেন- আমরা বাঁওড় পাড়ের মৎসজীবিরা কর্মক্ষম হয়ে গেছি। বাবা- দাদারা এ বাঁওড় থেকে মাছ ধরেই সংসারের খরচ যোগাতেন। আমরাও একই পেশাতে ছিলাম।
বাঁওড় না থাকায় একেবাই পথে বসে গেছি। তিনি বলেন-একই অবস্থা প্রায় ৬ বাঁওড় পাড়ের জেলে সম্প্রদায়ের। ফতেপুর মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির সভাপতি শান্তি হালদার বলেন-আমরা ধারদেনা করে বাওড়টি ইজারা নিয়েছি। মাছ ছেড়েছি, সামনে কপালে কি আছে বলতে পারছিনা।
জয়দিয়া বাঁওড়ের সাবেক মৎস্যজীবিদের দলপতি নিত্য হালদার বলেন-বাঁওড় পূর্বের ন্যায় ফিরে পেতে ৬ বাঁওড় পাড়ের মৎস্যজীবিদের পক্ষ থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলাটি হাইকোর্টে চুড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় আছে। তারপরও ইজারাদাররা বাঁওড় পাড়ের জেলেদের মারধোর করে জোরপূর্বক মাছ ধরছেন।

যশোর বিল বাঁওড় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মোঃ আলফাজ উদ্দীন শেখ বলেন-এ বাঁওড় গুলি আমাদের আওতায় ৪২ বছর ছিলো সে সময় বাঁওড় পাড়ের জেলেদের আত্মসামাজিক মান উন্নয়নে কাজ করে গেছে এ প্রকল্পটি। পাশাপাশি পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঁওড়ের বড় মাছের চাষ ও দেশীয় ছোট মাছের প্রজনন ঘটিয়ে নানা প্রজাতির মাছের চাহিদা মিটাতে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সক্ষম হয়েছে প্রকল্পটি। বাঁওড়টি রাখার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি কিন্ত পারিনি। বাঁওড় গুলি ভূমি মন্ত্রালয় ইজারা দিয়ে দিয়েছেন। যে কারণে বাওড় পাড়ের জেলেরা তো বেকার হয়েছে পাশাপাশি বাঁওড় সংশ্লিষ্ট ১৩০ থেকে ১৪০ জন দৈনিক মুজুরী ভিত্তিক কর্মিও বেকার হয়ে গেছে। বর্তমানে এ বাঁওড় কেন্দ্রিক আমাদের আর কিছুই করার নেই। বলুহর বাঁওড় ম্যানেজার সিদ্দিকুর রহমান বলেন-আমরা বাঁওড় গুলিতে মাছ চাষ করতাম মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রজাতির মাছের সাইজ ও সংখ্যা বিবেচনা করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। মাছ ধরার সময়ও নির্দ্ধারণ করা থাকতো, ছোট মাছ ধরা হতোনা। একই সাথে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করার জন্য তথা বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণ ও প্রজনন বৃদ্ধির জন্য অভয়াশ্রম করা হতো। সেই সাথে প্রজনন কালিন সময় মাছ ধরা বন্ধ রাখা হত ফলে এক দিকে বিপন্ন প্রজাতির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেত অন্যদিকে জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষিত হতো। বর্তমান ইজারাদারা এ বিষয়ে যত্নশীল না হয়ে অধিক মুনাফার জন্য কৃত্তিম উপায়ে মাছ চাষ করছেন। যখন তখন মাছ ছাড়ছেন এবং ধরছেন। যে কারণে দেশীয় মাছ ও জীববৈচিত্র্য বাঁওড় গুলি থেকে একেবারে ধ্বংস হতে বসেছে।

জানা গেছে-কোটচাঁদপুর বলুহর বাঁওড় সংলগ্ন সরকারী মৎস্য হ্যাচারী কমপ্লেক্সসহ অন্যান্য বাঁওড় গুলির আশপাশে আবাদী জমির পানি স্যালো পাম্পের মাধ্যমে বাঁওড় থেকে নেয়া হত। ইজারাদাররা এই পানি বাঁওড় থেকে নেয়া বন্ধ করতে বিভিন্ন ফন্দি ফিকিরি করছেন। একাধিক আবাদী জমির মালিকরা আশংকা প্রকাশ করে বলছেন- বাঁওড় থেকে পানি নেয়া বন্ধ করে দিলে একদিকে যেমন শত শত একর জমি চাষ বাঁধা গ্রস্থ্য হবে। অন্যদিকে সরকারী মৎস্য হ্যাচারী
কমপ্লেক্সও পড়বে পানি সংকটে।বলুহর বাওড় ইজারা পাওয়া কোটচাঁদপুর মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির সভাপতি শীতল হালদার বলেন-বাওড় থেকে পানি উত্তোলন কেউ যেন না করতে পারে সে জন্য ইতি মধ্যেই জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন করেছি। এ ছাড়াও তিনি বলেন-আমার মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি কাউকে
ইজারা পাইয়ে দেয় নাই বা আমরা বাঁওড় সাব-লিজও দিই নাই।
কোটচাঁপুর বলুহর বাওড় পাড়ের কৃষক রেজাউল ইসলাম জানান, বাওড়ের ধারেই আমার সাড়ে ৪ বিঘা জমি আমি শুকনা মৌসুমে স্যালো মেশিন দিয়ে বাওড়ের পানি দিয়ে চাষ-আবাদ করে আসছি। কিন্তু বর্তমানে ইজারাদাররা পানি নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে করে আমরা আর্থিক দিক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি।

বাওড় পাড়ের আরেক কৃষক ফারুক হোসেন জানান, আমার বাপ দাদারা এই বাওড়ের পানি দিয়ে চাষ-আবাদ করে আসছি কিন্তু ইজারা দেওয়ার পর ইজারাদারের লোকজন বাওড় থেকে পানি নিতে দিচ্ছে না। আমাদের জমিতে বরিংও করা নেই। আমরা এই বাওড়ের পানি দিয়েই জমিতে সেচ দিয়ে শীতকালীন সবজি সহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করে আসছি। এখন কি করবো বুঝে উঠতে পারিছিনা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক এসএম রফিকুল ইসলাম বলেন, ভূমি মন্ত্রনালয় এবং মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রনালয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্মাক্ষর হয়েছিল।
সেই সমঝোতা স্মারক বলেই এই বাওড়গুলো পরিচালনা করা হতো। এরপর বাংলা ১৪২৯ সালে এই স্মারকের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ভূমি মন্ত্রনালয় মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রনালয়ের প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে এই আর বাড়ানো হবে না। ভূমি মন্ত্রনালয়ের এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা ইজারা দেওয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করেন। ভূমি মন্ত্রনালয়ের এই প্রক্রিয়া শেষে যারা দরপত্র অনুযায়ী বাওড় ইজারা নিয়েছেন ভূমি মন্ত্রনালয় নির্দেশে আমরা তাদের হাতে দরপত্র বুঝিয়ে দিয়েছি। এর প্রেক্ষিতে যারা এতোদিন এই বাওড়ের সূবিধা ভোগ করে আসছিল তারা এটা থেকে বঞ্চিত হলো বলে দাবি করছেন। যারা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলো তারা একটি
স্মারলিপি দিয়েছেন। সেই স্মারক লিপিতে তাদের হতাশা এবং কষ্টের কথা উল্লেখ করেছেন আমি সেই স্মারক লিপি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় থেকে যে সিদ্ধান দেবেন আমরা সেই আলোকে ব্যবস্থা গ্রহন করবো।