০৭:৩৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নিজ দেশে শান্তিতে বসবাস করতে চান ঋষি সম্প্রদায়

◉নিজের কাজটা যেন ঠিকমতো করতে পারি: হীরালাল বাবু
◉আমরা এই দেশে শান্তিতে বসবাস করতে চাই: বাবুল ঋষি
◉দুইটা ভাত যেন প্যাট ভইরা খাইতে পারি: কিশোর ঋষি

দেশে বসবাসকারী ঋষি সম্প্রদায়ের সংখ্যা আসলে কত তার সঠিক পরিসংখ্যান বের করা কঠিন। কেননা, একেক গবেষণায় এদের সংখ্যা একেকরকম দেখানো হয়েছে। তবে, ঋষিরা নিজেদের সংখ্যা ২০ লাখ বলে দাবি করেছেন। বর্তমানে দেশে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এই সময় ঋষিরা নিজেদের সাংবিধানিক অধিকার, সামাজিক ক্ষমতায়ন ও সরকারি সেবায় প্রবেশাধিকার সংরক্ষণের দাবি জানান। একই সঙ্গে কাজের সুষ্ঠু পরিবেশের পাশাপাশি নিজ দেশে শান্তিতে বসবাস করতে চান। দৈনিক সবুজ বাংলার সঙ্গে আলাপকালে ঋষিরা এভাবেই তাদের মনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন।

২০১৮ সালে পরিচালিত পিপিআরসি ও সেড এর গবেষণায় দেখা গেছে, ভূমির অধিকার ও নিরাপত্তা, সামাজিক বঞ্চনা ও আয় বৈষম্য, প্রশিক্ষিত কর্মসংস্থানের সুযোগের ঘাটতি, শোভন কর্মপরিবেশ, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সুযোগ ও সুরক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সুরক্ষা, গণতান্ত্রিক অধিকারের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে দেশের ঋষি সম্প্রদায়। এই অবস্থার উত্তরণে তাদের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি, তাদের জীবনমানের উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে সব ধরনের নাগরিক | অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। গবেষক কসিমো জেনের মতে, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে ঋষি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ২,৩৪,৩১৫ জন। তখন তাদের অবস্থান ছিল ঢাকা (৩০,১৫৯), ময়মনসিংহ (৩৫,৬২২), কুষ্টিয়া (৪৪,৭৩৯), খুলনা (৩০,৬৬৮), যশোর (৫৮,৫৮৮০) জেলায়।

১৯৮০ সালের দিকে খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার ১৪টি উপজেলার ৩০৭টি ঋষি পাড়ায় ৩৮,২১৯ জন ঋষি ছিল। এর মধ্যে, তালা, ডুমুরিয়া, সাতক্ষীরা এবং কলারোয়ায় এদের সংখ্যা বেশি ছিল। পাশাপাশি বাগেরহাট জেলায় তখন প্রায় ৮ হাজারের মতো ঋষি ছিল। জেনের ২০০২ সালের গবেষণাকালে খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় ঋষিদের সংখ্যা চিল
১,২০,০০০ যা দুটি জেলার মোট জনসংখ্যার ১.৪৩ ভাগ। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় ঋষি জনগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস রয়েছে। সাতক্ষীরাভিত্তিক ঋষিদের অধিকার সংগঠন পরিত্রাণ এর দাবি, শুধুমাত্র খুলনা বিভাগে ঋষিদের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। পিপিআরসি ও সেড এর ২০১৮ সালে করা গবেষণায় সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা এবং বাগেরহাট জেলার ঋষি অধ্যুষিত ৫৩টি পাড়ার মোট ৯০৮৮টি পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫১,৭৪৫ জন। গতকাল রোববার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় গণপূর্তের একটি টিনশেড ভবনের সামনের রাস্তায় কালো ছাতার নিচে বসে স্যারদের কালো জুতাগুলো চকচকে করছেন হীরালাল ঋষি বাবু। শোভন কর্মপরিবেশের কথা চিন্তা করলে যা একেবারেই যায় না। একদিকে মাথার উপর প্রখর রৌদ্র অন্যদিকে রাস্তায় ছুটে চলা গাড়ির সারি। সঙ্গে আছে গাড়ির তীব্র হর্ণ। হীরালাল বাবুর এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। তিনি বলেন, গত ৩০ বছর ধরে ঢাকা শহরে এই জুতা সেলাইয়ের কাজ করি। এ নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই? তিনি বলেন, আমি সারাদিন কাজ করি। এই দিয়ে সংসার চালাই। আমাদের জন্য কোনো সরকার কখনো কিছু করেনি। কোনো আন্দোলনে যাই না। কিন্তু কয়দিন আগে শাহবাগে গেছি। হিন্দুদের বাড়ি যেন আর না পোড়ায় এই দাবি জানাতে। তিনি বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের বাড়ি। বাবা কৃষিকাজ করত। কিন্তু এখন আমি এই কাজ করি। পরিবারের ৫ সন্তান। তিন মেয়ে, ২ ছেলে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। দুই ছেলে পড়ে। তিনি বলেন, ‘দেশের সরকারের কাছে একটাই চাওয়া নিজের কাজটা যেন ঠিকমতো করতে পারি।’ সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির ভবনের সামনে বসে বাবুল (মতিলাল) ঋষি জুতা মেরামতের কাজ করছেন। তিনি বলেন, গত ২৪ বছর ধরে ঢাকায় এই কাজ করি। গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মজলিশপুরে। আমার বাবাও জিপিও মোড়ে জুতা সেলাইয়ের কাজ করত। সে এখন মারা গেছে। আমার খুব ইচ্ছা ছেলেমেয়েগুলোকে লেখাপড়া শেখাব। তাই, আমার যতই কষ্ট হোক ওদের পড়ার খরচে কোনো কমতি রাখি না। তিনি বলেন, আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না। তবে, পূজা কমিটিতে থাকি। আমার একটাই চাওয়া যেন দেশে শান্তিতে থাকতে পারি। অনেকেই বলে, হিন্দুদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে। আমি কোথাও যেতে চাই না। এটাই আমার দেশ। এটা আমার ভিটেমাটি। আমি এখানেই থাকব।

১৯৭১ সালে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন আমার দাদাকে অনেকেই বলেছিল, ভিটেমাটি, জমি বিক্রি করে ভারতে চলে যাও। আমার দাদা তখন বলেছে, এটা আমার দেশ। মরতে হলে এখানেই মরব। আমি ধান-জমি ফেলে কোথাও যাব না। তিনি বলেন, নতুন সরকারের কাছে একটাই চাওয়া আমরা এই দেশে শান্তিতে বসবাস করতে চাই। আর ছেলেমেয়েগুলোকে লেখাপড়া শেখাতে চাই। তাদের যেন আমার মতো এই কাজ না করতে হয়। দৈনিক বাংলা মোড়ের ফুটপাতের কাছে বসে জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন কিশোর ঋষি। তিনি বলেন, নিজের কাজ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি তুলি জমা দিই। এছাড়া কোনো রাজনীতি করি না। আমার দুই ছেলে তারা সেলুনে কাজ করে। নারায়ণগঞ্জেই থাকি। দুইটা ভাত যেন প্যাট ভইরা খাইতে পারি এটাই চাওয়া আর কিছু কারো কাছে চাই না। গবেষক ফিলিপ গাইন বলেন, ঋষি জনগোষ্ঠী বংশপরম্পরায় চর্মকার, চামড়া শ্রমিক এবং বাদক। এদেরকে মুচি বা চামার নামেও চিন্থিত করা হয়। তবে, এই শব্দদুটো তাদের জন্য অসম্মানজনক। হিন্দু সমাজে অস্পৃশ্য বা দলিত জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে এরা একটি। বর্তমানে অনেকে নিজেকে দলিত বলে পরিচয় দেন।

তাদের মতে, দলিত শব্দের অর্থ হচ্ছে সামাজিক শোষণ, স্বাধীনতা, দারিদ্র্য এবং সকল ধরণের বৈষম্যকে বোঝায়। তিনি বলেন, ঋষিদের অনেকের বাঙালিদের ব্যাপারে মনোভাব বেদনাদায়ক। এদের প্রতি অবজ্ঞা সুষ্পষ্ট। অনেক সময় আমাদের সংবিধানই তাদের এ মনোভাব উসকে দেয়। আমাদের সংবিধান বলে দিচ্ছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও রাষ্ট্রভাষা বাংলা। তাহলে যাদের ধর্ম ইসলাম নয় এবং যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয় তারা কীভাবে রাষ্ট্র থেকে সমান সুরক্ষা পাবে? তাদের জন্য সংবিধানে সান্ত্বনাও আছে। সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদ-এ আছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতি, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ তবে, একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গ্রামে যেসব ঋষিরা থাকে তারা নিশ্চয় অর্থ কষ্টে থাকতে পারেন কিন্তু যারা রাজধানী ঢাকায় কাজ করে তারা বেশ সচ্ছল। কারণ, তারা সকালে এসে প্রথমেই স্যারের জুতাটা চকচকে করে দেবার কাজ করছেন। অনেকের সঙ্গে কিন্তু অনেক বড় অফিসারের বেশ ভালো সম্পর্কও হয়ে যায়। তারা অনেকেই অনেক উচ্চপদস্থ ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত অনেককিছু জানেন। কারণ, প্রতিদিন দেখা হয়, কাজ হয়, এমন করতে করতে অনেকেরই তারা আপনজন হয়ে ওঠেন। অনেকে তাদের আর্থিক সাহায্যও করে। তারাও
অনেককে তাদের পেশার বাইরে অনেক ধরনের মানসিকসহ সাহায্য সহযোগিতা করে।

জনপ্রিয় সংবাদ

মনোনয়নপত্র জমার সময় আর বাড়ছে না: নির্বাচন কমিশন

নিজ দেশে শান্তিতে বসবাস করতে চান ঋষি সম্প্রদায়

আপডেট সময় : ০৭:১২:২৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

◉নিজের কাজটা যেন ঠিকমতো করতে পারি: হীরালাল বাবু
◉আমরা এই দেশে শান্তিতে বসবাস করতে চাই: বাবুল ঋষি
◉দুইটা ভাত যেন প্যাট ভইরা খাইতে পারি: কিশোর ঋষি

দেশে বসবাসকারী ঋষি সম্প্রদায়ের সংখ্যা আসলে কত তার সঠিক পরিসংখ্যান বের করা কঠিন। কেননা, একেক গবেষণায় এদের সংখ্যা একেকরকম দেখানো হয়েছে। তবে, ঋষিরা নিজেদের সংখ্যা ২০ লাখ বলে দাবি করেছেন। বর্তমানে দেশে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এই সময় ঋষিরা নিজেদের সাংবিধানিক অধিকার, সামাজিক ক্ষমতায়ন ও সরকারি সেবায় প্রবেশাধিকার সংরক্ষণের দাবি জানান। একই সঙ্গে কাজের সুষ্ঠু পরিবেশের পাশাপাশি নিজ দেশে শান্তিতে বসবাস করতে চান। দৈনিক সবুজ বাংলার সঙ্গে আলাপকালে ঋষিরা এভাবেই তাদের মনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন।

২০১৮ সালে পরিচালিত পিপিআরসি ও সেড এর গবেষণায় দেখা গেছে, ভূমির অধিকার ও নিরাপত্তা, সামাজিক বঞ্চনা ও আয় বৈষম্য, প্রশিক্ষিত কর্মসংস্থানের সুযোগের ঘাটতি, শোভন কর্মপরিবেশ, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সুযোগ ও সুরক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সুরক্ষা, গণতান্ত্রিক অধিকারের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে দেশের ঋষি সম্প্রদায়। এই অবস্থার উত্তরণে তাদের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি, তাদের জীবনমানের উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে সব ধরনের নাগরিক | অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। গবেষক কসিমো জেনের মতে, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে ঋষি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ২,৩৪,৩১৫ জন। তখন তাদের অবস্থান ছিল ঢাকা (৩০,১৫৯), ময়মনসিংহ (৩৫,৬২২), কুষ্টিয়া (৪৪,৭৩৯), খুলনা (৩০,৬৬৮), যশোর (৫৮,৫৮৮০) জেলায়।

১৯৮০ সালের দিকে খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার ১৪টি উপজেলার ৩০৭টি ঋষি পাড়ায় ৩৮,২১৯ জন ঋষি ছিল। এর মধ্যে, তালা, ডুমুরিয়া, সাতক্ষীরা এবং কলারোয়ায় এদের সংখ্যা বেশি ছিল। পাশাপাশি বাগেরহাট জেলায় তখন প্রায় ৮ হাজারের মতো ঋষি ছিল। জেনের ২০০২ সালের গবেষণাকালে খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় ঋষিদের সংখ্যা চিল
১,২০,০০০ যা দুটি জেলার মোট জনসংখ্যার ১.৪৩ ভাগ। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় ঋষি জনগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস রয়েছে। সাতক্ষীরাভিত্তিক ঋষিদের অধিকার সংগঠন পরিত্রাণ এর দাবি, শুধুমাত্র খুলনা বিভাগে ঋষিদের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। পিপিআরসি ও সেড এর ২০১৮ সালে করা গবেষণায় সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা এবং বাগেরহাট জেলার ঋষি অধ্যুষিত ৫৩টি পাড়ার মোট ৯০৮৮টি পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫১,৭৪৫ জন। গতকাল রোববার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় গণপূর্তের একটি টিনশেড ভবনের সামনের রাস্তায় কালো ছাতার নিচে বসে স্যারদের কালো জুতাগুলো চকচকে করছেন হীরালাল ঋষি বাবু। শোভন কর্মপরিবেশের কথা চিন্তা করলে যা একেবারেই যায় না। একদিকে মাথার উপর প্রখর রৌদ্র অন্যদিকে রাস্তায় ছুটে চলা গাড়ির সারি। সঙ্গে আছে গাড়ির তীব্র হর্ণ। হীরালাল বাবুর এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। তিনি বলেন, গত ৩০ বছর ধরে ঢাকা শহরে এই জুতা সেলাইয়ের কাজ করি। এ নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই? তিনি বলেন, আমি সারাদিন কাজ করি। এই দিয়ে সংসার চালাই। আমাদের জন্য কোনো সরকার কখনো কিছু করেনি। কোনো আন্দোলনে যাই না। কিন্তু কয়দিন আগে শাহবাগে গেছি। হিন্দুদের বাড়ি যেন আর না পোড়ায় এই দাবি জানাতে। তিনি বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের বাড়ি। বাবা কৃষিকাজ করত। কিন্তু এখন আমি এই কাজ করি। পরিবারের ৫ সন্তান। তিন মেয়ে, ২ ছেলে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। দুই ছেলে পড়ে। তিনি বলেন, ‘দেশের সরকারের কাছে একটাই চাওয়া নিজের কাজটা যেন ঠিকমতো করতে পারি।’ সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির ভবনের সামনে বসে বাবুল (মতিলাল) ঋষি জুতা মেরামতের কাজ করছেন। তিনি বলেন, গত ২৪ বছর ধরে ঢাকায় এই কাজ করি। গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মজলিশপুরে। আমার বাবাও জিপিও মোড়ে জুতা সেলাইয়ের কাজ করত। সে এখন মারা গেছে। আমার খুব ইচ্ছা ছেলেমেয়েগুলোকে লেখাপড়া শেখাব। তাই, আমার যতই কষ্ট হোক ওদের পড়ার খরচে কোনো কমতি রাখি না। তিনি বলেন, আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না। তবে, পূজা কমিটিতে থাকি। আমার একটাই চাওয়া যেন দেশে শান্তিতে থাকতে পারি। অনেকেই বলে, হিন্দুদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে। আমি কোথাও যেতে চাই না। এটাই আমার দেশ। এটা আমার ভিটেমাটি। আমি এখানেই থাকব।

১৯৭১ সালে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন আমার দাদাকে অনেকেই বলেছিল, ভিটেমাটি, জমি বিক্রি করে ভারতে চলে যাও। আমার দাদা তখন বলেছে, এটা আমার দেশ। মরতে হলে এখানেই মরব। আমি ধান-জমি ফেলে কোথাও যাব না। তিনি বলেন, নতুন সরকারের কাছে একটাই চাওয়া আমরা এই দেশে শান্তিতে বসবাস করতে চাই। আর ছেলেমেয়েগুলোকে লেখাপড়া শেখাতে চাই। তাদের যেন আমার মতো এই কাজ না করতে হয়। দৈনিক বাংলা মোড়ের ফুটপাতের কাছে বসে জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন কিশোর ঋষি। তিনি বলেন, নিজের কাজ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি তুলি জমা দিই। এছাড়া কোনো রাজনীতি করি না। আমার দুই ছেলে তারা সেলুনে কাজ করে। নারায়ণগঞ্জেই থাকি। দুইটা ভাত যেন প্যাট ভইরা খাইতে পারি এটাই চাওয়া আর কিছু কারো কাছে চাই না। গবেষক ফিলিপ গাইন বলেন, ঋষি জনগোষ্ঠী বংশপরম্পরায় চর্মকার, চামড়া শ্রমিক এবং বাদক। এদেরকে মুচি বা চামার নামেও চিন্থিত করা হয়। তবে, এই শব্দদুটো তাদের জন্য অসম্মানজনক। হিন্দু সমাজে অস্পৃশ্য বা দলিত জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে এরা একটি। বর্তমানে অনেকে নিজেকে দলিত বলে পরিচয় দেন।

তাদের মতে, দলিত শব্দের অর্থ হচ্ছে সামাজিক শোষণ, স্বাধীনতা, দারিদ্র্য এবং সকল ধরণের বৈষম্যকে বোঝায়। তিনি বলেন, ঋষিদের অনেকের বাঙালিদের ব্যাপারে মনোভাব বেদনাদায়ক। এদের প্রতি অবজ্ঞা সুষ্পষ্ট। অনেক সময় আমাদের সংবিধানই তাদের এ মনোভাব উসকে দেয়। আমাদের সংবিধান বলে দিচ্ছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও রাষ্ট্রভাষা বাংলা। তাহলে যাদের ধর্ম ইসলাম নয় এবং যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয় তারা কীভাবে রাষ্ট্র থেকে সমান সুরক্ষা পাবে? তাদের জন্য সংবিধানে সান্ত্বনাও আছে। সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদ-এ আছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতি, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ তবে, একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গ্রামে যেসব ঋষিরা থাকে তারা নিশ্চয় অর্থ কষ্টে থাকতে পারেন কিন্তু যারা রাজধানী ঢাকায় কাজ করে তারা বেশ সচ্ছল। কারণ, তারা সকালে এসে প্রথমেই স্যারের জুতাটা চকচকে করে দেবার কাজ করছেন। অনেকের সঙ্গে কিন্তু অনেক বড় অফিসারের বেশ ভালো সম্পর্কও হয়ে যায়। তারা অনেকেই অনেক উচ্চপদস্থ ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত অনেককিছু জানেন। কারণ, প্রতিদিন দেখা হয়, কাজ হয়, এমন করতে করতে অনেকেরই তারা আপনজন হয়ে ওঠেন। অনেকে তাদের আর্থিক সাহায্যও করে। তারাও
অনেককে তাদের পেশার বাইরে অনেক ধরনের মানসিকসহ সাহায্য সহযোগিতা করে।