শিরোপা জয়ের সম্ভাবনায় অনেকটা এগিয়ে থেকে চেলসির বিপক্ষে যেভাবে ধরাশায়ী হয়েছে পিএসজি, তাতে দলটির কারো কারো মেজাজ হারানো স্বাভাবিকই বটে। তবে কোচ লুইস এনরিকের ক্ষেত্রেও তেমন কিছু হলে, অবাক হতেই হয়। প্রতিপক্ষের জোয়াও পেদ্রোকে ধাক্কা দেওয়ার অভিযোগের প্রশ্নে এই স্প্যানিশ কোচ অবশ্য সাফাই গাইলেন যে, দুই দলের খেলোয়াড়দের আলাদা করার চেষ্টা করছিলেন তিনি। ক্লাবের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগসহ ট্রেবল জয়ী পিএসজির এই দলকে নিয়ে উচ্চাশা ছিল অনেক বেশি। ৩২ দলের এবারের ক্লাব বিশ্বকাপেও ফাইনালের আগ পর্যন্ত তাদের পারফরম্যান্স ছিল দুর্দান্ত। সেমি-ফাইনালে তারা যেভাবে রিয়াল মাদ্রিদকে গুঁড়িয়ে দেয়, তাতে তাদের শিরোপা জয়ের সম্ভাবনাও বেড়ে যায় অনেক। কিন্তু শিরোপার মঞ্চে এসে নিজেদের পুরোপুরি যেন হারিয়ে ফেলল দলটি। নিউ জার্সির মেটলাইফ স্টেডিয়ামে ৮২ হাজারের বেশি দর্শকের সামনে রোববারের ফাইনালে তাদেরকে ৩-০ গোলে বিধ্বস্ত করে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দলটি। সবগুলো গোলই হয় প্রথমার্ধে। পিএসজি এই মুহূর্তে নিশ্চিতভাবে নিজেদের সেরা ছন্দে আছে। চ্যাম্পিয়নস লিগসহ ট্রেবল জিতেই ক্লাব বিশ্বকাপের মঞ্চে এসেছিল তারা। প্রতিযোগিতার ফাইনাল নিশ্চিত করার পথে আতলেতিকো মাদ্রিদ, ইন্টার মায়ামি, বায়ার্ন মিউনিখ এবং রিয়াল মাদ্রিদকে উড়িয়ে দিয়েছে তারা।

অন্যদিকে সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স এবং ছন্দের দিক থেকে পিএসজির ধারেকাছেও ছিল না চেলসি। দুই দলের এমন বিপরীতমুখী অবস্থানই হয়তো পিএসজিকে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল এবং তারা মাঠে নামার আগেই।
ফাইনালের আগ পর্যন্ত প্রতিপক্ষের জালে ১৬ গোল করার বিপরীতে মাত্র একটি হজম করা পিএসজি দ্বিতীয়ার্ধের পারফরম্যান্সে কিছুটা উন্নতি করলেও লড়াইয়ে প্রাণ ফেরাতে পারেনি। শেষ দিকে তাদের মেজাজ হারানোর শুরু নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট বাকি থাকতে পেছন থেকে চেলসির মার্ক কুকুরেইয়ার চুল টেনে ধরে লাল কার্ড দেখেন পিএসজি মিডফিল্ডার জোয়াও নেভেস।
শেষের বাঁশি বাজার পর হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে দুই দলের কয়েক জন। এরই মাঝে জোয়াও পেদ্রোর মুখে আঘাত করতে দেখা যায় এনরিকেকে, যা নিয়ে শুরু হয়েছে তীব্র সমালোচনা।
নিজের অমন আচরণের কারণ ব্যাখ্যায় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করলেন বার্সেলোনা ও স্পেনের সাবেক কোচ এনরিকে।
‘এমন চাপের ও রোমাঞ্চকর লড়াই শেষে নিজের অনুভূতি প্রকাশে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমাদের সবার জন্যই ম্যাচটা ছিল অনেক স্নায়ুচাপের। (যা হয়েছে) তা এড়ানো অসম্ভব হতো।’
‘(ওই ঘটনায়) সবাই জড়িয়ে পড়েছিল। যা হয়েছে, তা অবশ্যই খুব ভালো কিছু নয়, এমন চাপের ম্যাচের শেষ ফল ছিল ওটা।’ ম্যাচ শেষের প্রতিক্রিয়ায় লড়াইয়ের অসহনীয় চাপের কথা বারবার বললেন এনরিকে। তাতেই আপত্তিকর ওই ঘটনার উৎপত্তি বলে মনে করেন তিনি।
‘আমি (ঘটনার মাঝে চেলসি কোচ) এন্টসো মারেস্কাকেও দেখেছি। তাকে অন্যদের ধাক্কা দিতে দেখেছি এবং আমাদের সব খেলোয়াড়দের আলাদা করতে হতো। এত বেশি চাপ কীভাবে তৈরি হলো, ঠিক জানি না।’ ‘কিন্তু আমাদের সবার উচিত ছিল এমন পরিস্থিতি এড়ানো। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার উদ্দেশ্য ছিল ফুটবলারদের আলাদা করা, যাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ না হয়ে যায়।’ শেষটা ভীষণ বাজেভাবে হলেও ২০২৪-২৫ মৌসুম কিন্তু দুর্দান্ত কেটেছে পিএসজির। বিশেষ চলতি বছরে তাদের পারফরম্যান্স ছিল অবিশ্বাস্য। তারই সুবাদে জানুয়ারি থেকে একে একক ফরাসি সুপার কাপ, ফরাসি কাপ, লিগ আঁ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ট্রফি ঘরে তোলে এনরিকের দল।
নিজেদের চ্যাম্পিয়নস ধরে নিয়েছিল। আর এ কারণেই হয়তো ফাইনালের মতো ম্যাচে যে শরীরীভাষায় ও আগ্রাসী মেজাজে পিএসজির খেলার কথা ছিল, সেটা দেখা যায়নি। যা শেষ পর্যন্ত পিএসজিকে পিছিয়ে দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পিএসজির আক্রমণভাগকে দেখা গেছে অপ্রতিরোধ্য ছন্দে। বড় ম্যাচগুলোতে তাদের করা গোলের সংখ্যা দেখলেই চিত্রটা স্পষ্ট হওয়া যাবে। সেমিফাইনালের কথাই ধরা যাক। সেদিন রিয়াল মাদ্রিদকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে দেয় পিএসজি। এর আগে ইন্টার মায়ামি ও আথলেতিকো মাদ্রিদের জালে ৪ বার করে বল জড়ায় তারা। অথচ সেই আক্রমণভাগ ফাইনালে একেবারেই নিষ্প্রভ ছিল। দলের অন্যতম সেরা তারকা উসমান দেম্বেলে যেমন পুরো ৯০ মিনিট মাঠে থেকে মাত্র ১টি শট নিতে পেরেছেন।
প্রথমার্ধে পিএসজির রক্ষণকে নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলায় মেতেছিলেন কোল পালমার। তাঁকে থামানোর কোনো পরিকল্পনাই যেন ছিল না পিএসজির। ফলে পিএসজির রক্ষণকে শুরু থেকেই চেপে ধরেন এই ইংলিশ ফরোয়ার্ড। ৯০ মিনিটে ৪টি শট নিয়ে ২টি গোল করেছেন পালমার। আর অন্য গোলটিও হয়েছে তাঁর অ্যাসিস্টে।পরিসংখ্যান দিয়ে অবশ্য পালমারের অবদান বোঝা যাবে না। অ্যাটাকিং থার্ডে যখনই পালমারের পায়ে বল গেছে, তখনই পিএসজির জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শুধু ফাইনালেই নয়, টুর্নামেন্টজুড়ে পালমার দারুণ খেলেছেন। সব মিলিয়ে ৩ গোল এবং ২টি অ্যাসিস্ট করা এই ইংলিশ তারকা জিতেছেন প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বলও।
কিছুদিন ধরে প্রতিপক্ষ দলগুলোকে কৌশলের মাস্টারক্লাসে কুপোকাত করেছেন পিএসজি কোচ এনরিকে। কিন্তু কাল সেই এনরিকে ডাগআউটে দাঁড়িয়ে দেখলেন চেলসি কোচ এনজো মারেসকার মাস্টারক্লাস। মারেসকার প্রথম ম্যাচ জিতে নেওয়ার যে কৌশল, সেটি দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছে তাঁর শিষ্যরা। শুরু থেকেই গতিময় ও আগ্রাসী ফুটবল উপহার দেয় তারা। মূলত পিএসজিকে তাদের কৌশলেই চেপে ধরার মন্ত্র নিয়ে মাঠে নামে চেলসি। প্রেসিংয়ের পর প্রেসিংয়ে একরকম কোণঠাসা করে রাখা হয় প্যারিসের দলটিকে। পিএসজিকে মাঠে জায়গা নিয়েও খেলতে দেয়নি চেলসি। শেষ পর্যন্ত এই চাপ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর আর কোনো সুযোগই পায়নি পিএসজি। প্রথমার্ধেই ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় তারা। ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড হোয়াও পেদ্রোর ক্লাব বিশ্বকাপে খেলারই কথা ছিল না। ২ জুলাই ব্রাইটন ছেড়ে চেলসিতে আসেন তিনি। এরপর তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় চেলসির ক্লাব বিশ্বকাপ স্কোয়াডে। দুই দিন পর টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনালে অভিষেকও হয়ে যায় তাঁর। তবে হোয়াও পেদ্রো নিজেকে চেনান সেমিফাইনালে।
ফ্লুমিনেন্সের বিপক্ষে সেই ম্যাচে চেলসির ২-০ গোলের জয়ে দুটি গোলই আসে তাঁর কাছ থেকে। এরপর গতকাল ফাইনালেও গোল করেছেন পেদ্রো। মূলত তাঁর করা ম্যাচের তৃতীয় গোলটিই পিএসজির ঘুরে দাঁড়ানোর রাস্তা একরকম বন্ধ করে দেয়। সব মিলিয়ে এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে চমকের কথা বললে পেদ্রোর চেলসি দলে অন্তর্ভুক্তির কথাই বলতে হবে, যা শেষ পর্যন্ত চেলসিকে শিরোপা জিততেও সহায়তা করেছেন।


























