লিওনেল মেসির আবেগের বিস্ফোরণ ছিল বাস্তব, অকপট এবং চমকপ্রদ।
আর্জেন্টিনার এই কিংবদন্তি শেষ মুহূর্তে একটি অসাধারণ অ্যাসিস্ট করেন মার্কেলো উইগানডটকে, যেটি ইন্টার মায়ামিকে আজ বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) ২-১ ব্যবধানে নাটকীয় জয় এনে দিয়েছে এটলাসের বিপক্ষে লিগস কাপ ২০২৫-এর প্রথম ম্যাচেই।
রেফারি হুয়ান ক্যালদেরন পেরেজ প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে গোলটি বৈধ ঘোষণা করলে, মেসি দৌড়ে গিয়ে আলিঙ্গন করেন তার বন্ধু, সতীর্থ এবং দেশবাসী রদ্রিগো ডি পলকে, ইন্টার মায়ামির জার্সিতে যার ছিল এটা অভিষেক ম্যাচ।
কিন্তু এর পরপরই ঘটল এক অপ্রত্যাশিত দৃশ্য—মেসি হঠাৎ করেই মুখ ফিরিয়ে গিয়ে একরাশ আবেগে চিৎকার করে কিছু কথা বলেন প্রতিপক্ষ এটলাসের খেলোয়াড় মাতিয়াস কোকারোর উদ্দেশে, যিনি বর্তমানে সিএফ মন্ট্রিয়াল থেকে ধারে খেলছেন। তিনি মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলেও উদযাপন করেন। যদিও পরে দুজনকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করতে দেখা যায়।
মেসির এমন রূপ দেখে ম্যাচ শেষে এটলাসের কোচ গনজালো পিনেডা (পূর্বে আটলান্টা ইউনাইটেডের কোচ) বলেন, ‘গোলের পর মেসির সেলিব্রেশন আমাকে অবাক করেছে। এটা প্রমাণ করে যে, সে ম্যাচকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে এবং তার জেতার মানসিকতাও। ফুটবল ইতিহাসের সবকিছু জিতেও সে ফুটবলকে এখনো দিয়ে যাচ্ছে।’
মায়ামির অধিনায়ক মেসি বলেন, ‘আবহাওয়া বেশ গরম ছিল, আগের ম্যাচ না খেলাটা তেমন একটা সাহায্য করেনি এই ম্যাচে বরং উল্টো খারাপ হয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে এটা মনে হতে পারে ভালো, কিন্তু আমার জন্য এটা খারাপ কারণ আমার প্রতিনিয়ত খেলা দরকার। এবং আমি যত রেগুলার খেলবো তত আমার কাছে শারীরিকভাবে নিজেকে ফিট মনে হবে।’
মায়ামির বার্তা স্পষ্ট–তারা শিরোপা চায়
মেসির এই আবেগ যেন একটা ফাইনাল ম্যাচের মুহূর্ত মনে করিয়ে দিলেও, এটি ছিল মাত্র ইন্টার মায়ামির লিগস কাপ ২০২৫-এর প্রথম ম্যাচ। আর এখানেই যেন প্রতিযোগিতার অন্য দলগুলোর জন্য রয়েছে সতর্কবার্তা।
ম্যাচ শেষে মেসি বলেন, ‘গতকাল আমেরিকার কোনো দলই জিততে পারেনি। তাই আমাদের জয়ের গুরুত্ব অনেক, কারণ আমরা একে অপরের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘এটা এমন এক টুর্নামেন্ট যেখানে আমরা সবসময় ভালো করি। আমরা আজ দারুণ খেলেছি, কঠিন এক প্রতিপক্ষের বিপক্ষে।’
মেসির এই ক্ষুধাই ছিল ইন্টার মায়ামির জয়ের অন্যতম কারণ, বিশেষ করে তিনি এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে মাঠে ফিরেছেন। আগের ম্যাচে তিনি সাইডলাইনে বসে ছিলেন, যেখানে মায়ামি গোলশূন্য ড্র করেছিল সিনসিনাটির সঙ্গে।
শেষ মুহূর্তের রোমাঞ্চ
ডি পল, যিনি এই ম্যাচে অভিষেক করলেন এবং একটিও পূর্ণ অনুশীলন না করেই মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন পুরো ৯০ মিনিট, মেসির প্রথম অ্যাসিস্ট থেকে সেগোভিয়াকে দিয়ে গোল করালেন।
তবে আটলাস দল সহজে হার মানেনি। তারা চাপ সামলে ৮০তম মিনিটে সমতা ফেরায় রিভালদো লোজানোর গোলে। মনে হচ্ছিল ম্যাচটি ড্র হতে যাচ্ছে।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেই পরিচিত নাটকীয়তা—মেসির পাস, উইগানডটের গোল, আর মায়ামির বিজয়।
ডি পল বলেন, ‘আমরা আসলে আগেই ম্যাচ শেষ করে দিতে পারতাম, কিন্তু তা হয়নি। শেষ বলেই গোল করতে হলো। আর এটা তো নাটকেরই অংশ—শেষ মুহূর্তে জয়।’
শিরোপার ক্ষুধা
ডি পল হয়তো নতুন যোগ দিয়েছেন এই দক্ষিণ ফ্লোরিডার গ্ল্যামারাস প্রকল্পে, কিন্তু তিনি দ্রুত মানিয়ে নিয়েছেন। ২০২৩ সালে মেসির হাত ধরে শুরু হওয়া ইন্টার মায়ামির যুগ প্রথম থেকেই ছিল নাটকীয়তায় ভরা। এবারও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন তারা।
মায়ামির কোচ হাভিয়ের মাশ্চেরানো বলেন, ‘এই প্রতিযোগিতা খুব ছোট, তাই প্রতিটি ম্যাচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রতিটি খেলোয়াড় জেতার জন্য সর্বোচ্চটা দিচ্ছে।’
আর্জেন্টিনা ও বার্সেলোনায় মেসির সাবেক সতীর্থ মাশ্চেরানো লিগস কাপের নতুন ফরম্যাটের প্রশংসা করে বলেন, ‘এই পরিবর্তনটা ভালো হয়েছে, যেটা বেশি বেশি করে মেক্সিকান দলের বিপক্ষে খেলতে সুযোগ করে দিয়েছে।’
এখন মেসি যখন লড়াইয়ে নামেন, পুরো দলও যেন তাঁর সঙ্গেই এগিয়ে চলে। তাদের পরবর্তী ম্যাচ শনিবার রাতে নেকাক্সার বিপক্ষে, যারা বুধবার আটলান্টাকে ৩-১ গোলে হারিয়েছে।
মাশ্চেরানো বলেন, ‘দিনশেষে, আমরা খেলি জেতার জন্য। আর সেটাই ফুটবলের সৌন্দর্য। আমরা খুব ভালো খেলিনি, কিন্তু ম্যাচটা জিতেছি শেষ মুহূর্তে, রীতিমতো নাটকীয়ভাবে। এটা আমাদের যাত্রার আরেকটি ধাপ মাত্র, তবে এমনভাবে শুরু করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
৪০০-এর মাইলফলকের আরও কাছে
আজ ম্যাচে ২টি এ্যাসিস্ট করে মেসি তার ক্যারিয়ার এ্যাসিস্ট স্যংখ্যা ৩৮৮-তে নিয়ে গেলেন। বহু বছর ধরেই এ্যাসিস্ট সংখ্যায় তিনি সবার ওপরে। ৪০০ এ্যাসিস্টের মাইলস্টোন স্পর্শ করার পথে আরও দুই ধাপ এগিয়ে গেলেন তিনি। বাকি আছে আরও ১২টি এ্যাসিস্ট করা, যা খুবই সম্ভব বলে মনে করেন মেসিভক্তরা।
ম্যাচসেরার কীর্তি
বয়সটা হয়ে গেছে ৩৮। কিন্তু এখনও প্রায় প্রতি ম্যাচেই ম্যাচসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটা নিজের করে নিচ্ছেন মেসি। আজও তিনি সর্বাধিক ৯.০ রেটিং পেয়েছেন এবং যথারীতি তাকে ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটি দিতে বিন্দুমাত্র ভাবতে হয়নি বিচারকদের। আমেরিকান ফুটবলে এটা মেসির এই বছরে ১১তম ম্যাচসেরা হওয়া, যা আমেরিকান ফুটবলে এক বছরে সর্বাধিক। আর সার্বিকভাবে এটা ক্যারিয়ারে মেসির ৩৯৬তম বারের মতো ম্যাচসেরা হওয়া, যা বহু বছর ধরেই বিশ্বরেকর্ড।
আরকে/সবা


























